টেনে বন্ধ করলাম জানালাটা, তারপর বেরিয়ে এলাম দরজায় তালা দিয়ে। হতভম্ব তো বটেই খানিকটা বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি। চমকে উঠলে হঠাৎ আমার বুদ্ধি আর কাজ করতে চায় না ঠিকমতো।
উত্তেজিত হয়ে উঠলাম প্রথমে, তারপর ঘিরে ধরলো আশংকা এসে, শেষে ভয় পেলাম ভীষণ, জিজ্ঞেস করলাম বাড়ির লোকজনদের–না, কেউ তারা ঢোকেনি ল্যাবরেটারিতে। খানিকক্ষণ আরও চিন্তা করার পর ভাইকে আমি ফোন করে ঠিক করলাম তার মতামত নেওয়া।
আমার চেয়ে ফিলিপ বুদ্ধিমান, চট করে সবকিছু বুঝতে পারে। ঐ চুরি যাওয়ার ব্যাপারটার গুরুত্ব সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে যেতে বললো আমাকে আলোচনা করার জন্যে ওর কাছে।
দেখা হলো বাইরে গিয়ে গভর্নেস মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে। উনি এসেছিলেন ওপার থেকে ফাঁকিবাজ ছাত্রীর সন্ধানে। ও ব্যাপারে ওঁকে আমি কিছুই বললাম না। অ্যাঞ্জেলার ভীষণ প্রিয় ছিলো আমার বাগানের আপেল গাছটা, তাই বাগানে গিয়ে খোঁজ করতে বললাম মিস উইলিয়ামাসকে। তাড়াতাড়ি নৌকো বেয়ে তীরে গিয়ে অ্যাল্ডারবেরির দিকে চলে গেলাম। আমার ভাই ওখানে আগে থাকতেই অপেক্ষা করছিলো।
সেদিন যে পথ দিয়ে আমি আর আপনি গিয়েছিলাম বাড়ির দিকে, সেই পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা। সেদিন তো ঐ জায়গাটা আপনি নিজে দেখেছেন, অতএব বুঝতে পারছেন কামান বাগানের পাঁচিলের পাশ দিয়ে সেদিন যেতে যেতে যা কথা হচ্ছিল বাগানের ভেতরে সবই আমরা শুনেছি। উপায় ছিলো না, না শুনে।
কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন চটাচটি করছিলো। এটুকু জানা ছাড়া অবশ্য আমি মন দিয়ে আদৌ শুনিনি বলা হচ্ছিলো কি কি কথা।
তবে ভয় দেখানোর মতো ক্যারোলিনকে কোনো কথা বলতে শুনিনি। অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। যাতে স্কুলে ওকে না পাঠানো হয় এই নিয়ে ক্যারোলিন কাকুতি-মিনতি করছিলো, অথচ নাছোড়বান্দা অ্যামিয়াসও, গরগর করছিলো ও রাগে, না ঠিক যখন হয়ে গেছে সব ওকে যেতেই হবে তখন। যাতে গুছিয়ে নেয় জিনিসপত্র অ্যাঞ্জেলা সেটা ক্যারোলিনের দেখার ভার।
পৌঁছেছি কামান বাগানের দরজার কাছে হঠাৎ ক্যারোলিন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিলো ওকে। একটু হাসলো নিজের অজান্তেই আমাকে দেখে, বললো ওরা আলোচনা করছিলো অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে এলসা ঐ পথ দিয়ে এলো, তাড়াতাড়ি ছবিটা শষ করতে চাইছিলো অ্যামিসও।
আমরা কোনো ব্যবস্থা নিইনি সঙ্গে সঙ্গে বলে পরে ফিলিপ দোষ দিয়েছিলো নিজেকে। কিন্তু ওভাবে আমি তখন ভাবিনি। কল্পনাও করতে পারিনি আমরা যে খুন করার মতো একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে কেউ। (আমার তাছাড়া এখনও বিশ্বাস কেউ চিন্তাও করেনি খুনের কথা)। একথা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমরা যে আমাদের কিছু একটা করা উচিত, তবে এখনও আমি বলবো প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে সাবধানে চিন্তা করার কথা আলোচনা করে ভুল করিনি আমরা। কি ঠিক করা উচিত এটা প্রয়োজন ছিলো স্থির করা–আমি দু-একবার ভেবেছিলাম একথাও যে ভুল করছি না তো আমি। আগেরদিন কি বোতলটা সত্যি সত্যিই ভরা ছিলো? একেবারে সবকিছু সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে আমি পারি না (আমার ভাই ফিলিপ যেমন হয়)। স্মৃতিশক্তি মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। যতো চিন্তা করতে লাগলাম আমি ঠিক কোথায় রেখেছিলাম বোতলটা ততোই সব গুলিয়ে ফেলতে লাগলাম। ফলে বেশ রেগে গিয়েছিলো ফিলিপ আমার ওপর।
আলোচনা স্থগিত রইলো তখনকার মতো, কথা ছিলো লাঞ্চ হবার পর হবে। (বলে রাখি একটা কথা অ্যান্ড’রবেরিতে ইচ্ছে করলেই স্বাধীনতা ছিলো আমার খুশিমতো লাঞ্চ খাবার)।
পরে বিয়ার এনে দিলো আমাদের অ্যাঞ্জেলা আর ক্যারোলিন। জিজ্ঞেস করলাম অ্যাঞ্জেলাকে কেন পড়াশোনায় ও কঁকি দিচ্ছে, মিস উইলিয়ামস ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এও বললাম, ওর কপালে বকুনী আছে। স্নান করতে গিয়েছিলো সমুদ্রে, জানালো অ্যাঞ্জেলা, কিন্তু যখন সব জামাকাপড়ই ওর স্কুলে যাবার জন্যে নতুন হচ্ছে তখন ওকে দিয়ে কেন মিছিমিছি মিস উইলিয়ামস পুরনো জামাটা সেলাই করতে চাইছেন ওর সেটা মাথায় ঢুকছে না।
নিভৃতে ফিলিপের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না দেখে ব্যাপারটা নিয়ে একা একা ভাববার জন্যে হাঁটতে শুরু করলাম আমি কামান বাগানের দিকে। ওদিকে একটা বেঞ্চ পাতা ছিলো গাছপালার ফাঁকে, আমি আপনাকে জায়গাটা দেখিয়েছিলাম। সিগারেট ধরালাম ওখানে বসে, তারপর চিন্তা করতে করতে দেখছিলাম চারপাশটা। এলসা পোজ দিয়ে বসে আছে চোখ পড়লো।
সেই দিনকার ওর রূপটা আমি ভুলবো না কোনোদিনও। সে কাঠ হয়ে বসেছিলো, একটা হলদে জামা গায়ে, প্যান্ট গাঢ় নীল রঙের আর গলায় জড়ানো লাল রঙের সোয়েটার।
যৌবন আর স্বাস্থ্যের উজ্জ্বল আভা ওর মুখে। ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা মিষ্টি গলায় বলে চলেছিলো। মনে হতে পারে এটা শুনে যে আড়ি পাতছিলাম আমি, কিন্তু তা নয়। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো আমাকে এলসাও। অ্যামিয়াস আর এলসা দুজনেই জানতো যে ওখানে বসে আছি আমি। মেয়েটা আমাকে হাত নেড়ে ডেকে বলেওছিলো অ্যামিয়াস একেবারে অভদ্রের মতো ব্যবহার করছে সেদিন সকাল থেকে। একটুও বিশ্রাম নিতে দিচ্ছে না ওকে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে সারা শরীর। ব্যথাও করছে।