যে হতাশা এই কটা কথার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছিলো তা আমি বর্ণনা করতে পারবো না ভাষায়। যেন বাণীরূপ দেওয়া হয়েছে পরম সত্যকে। এই বিচ্যুতির ফলে অ্যামিয়াসের সব যে হারিয়ে ফেলেছিলো ক্যারোলিন। ঐ তো একমাত্র পথ পালাবার। বোকার মতো বিষটা সম্বন্ধে যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম তাতেই তো ক্যারোলিন পথের সন্ধান পেয়ে যায়। এবং যে অংশটা ফিডো থেকে পড়ে শোনাই তাতে এক মহান মৃত্যুর সুন্দর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো।
এখনো বিশ্বাস আমার ক্যারোলিন বিষ এনেছিলো আত্মহত্যা করার জন্যেই, পরিত্যাগ করেছে ওকে আমিয়াস এই হতাশা আর হয়তো দুঃখবোধ থেকেই ক্যারোলিন ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটাও আমার ধারণা যে ওকে বিষ চুরি করতে দেখেও থাকতে পারে অ্যামিয়াস, কিংবা কথাটা পরে জানতে পেরেছিলো।
জানতে পারায় ওটা নিশ্চয়ই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তার মনের ওপর। তার ব্যবহারে ভয় পেয়েছিলো, আজ কত নীচে নামতে হচ্ছে ক্যারোলিনকে এই ভেবে। কিন্তু এলসাকে শত দুঃখ অনুশোচনা সত্ত্বেও ছাড়ার কথাও ভাবতে পারেনি। অবশ্য বোঝা যায় সেটা, এলসার আকর্ষণ এড়ানো কঠিন।
অ্যামিয়াস যেন চিন্তাই করতে পারে না এলসাকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা, আবার এটাও জানে যে ক্যারোলিন বাঁচতে পারে না ওকে বাদ দিয়ে। ফলে ও ঠিক করেছিলো জটিল এই জাল থেকে বেরিয়ে আসার একটিমাত্র পথ খোলা আছে এবং সেটা হচ্ছে কাজে লাগানো নিজের কোনাইনটাকে।
আর ও কোনাইন যেভাবে খেলো সেটা বেশ খাপ খেয়ে যায় ওর চরিত্রের সঙ্গে। ও বোধ হয় ছবি আঁকাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো পৃথিবীতে। এবং আক্ষরিক অর্থে মনকে বরণ করার মতো হাতে তুলি নিয়ে সে পথটাই বেছে নিয়েছিলো। ভীষণ ভালোবেসেছিল যে মেয়েটাকে ও তাঁকে দেখতে দেখতে বোধ হয় মরাটাকেই জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা হিসেবে বেছে নেয়। অ্যামিয়াস হয়তো ভেবেছিলো মেয়েটার মঙ্গল হবে ওর মৃত্যুতেই…।
এই তত্ত্বটাকে স্বীকার করছি যুক্তি দিয়ে খাড়া করতে চাইলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় কিছু অদ্ভুত তথ্যের ব্যাখ্যা। যেমন ক্যারোলিনের শুধু আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে খালি কোনাইনের বোতলে কেন? আমার বক্তব্য তার উত্তরে ওটা অ্যামিয়াস ধরার পরে যেভাবে রাখা হয়েছিলো কাপড় জামার মধ্যে তাতে আঙুলের ছাপ ঘষা লেগে উঠে যাওয়াটা বিচিত্র নয়। এবং ওর মৃত্যুর পর ক্যারোলিন নিশ্চয়ই ঘেঁটেছিলো বোতলটা। হয়তো কেউ ওটা ছুঁয়েছে কি না দেখতে চেয়েছিলো। এটা নিশ্চয়ই সম্ভব, আর আঙুলের ছাপ বিয়ারের বোতল সম্বন্ধে সাক্ষীরাই তো বলেছিলো যে বিষ খাবার পর কাঁপা কাঁপা হাতের ছাপ মানুষের অমন বিকৃত হওয়া সম্ভব।
বুঝিয়ে বলতে হবে আর একটা জিনিস। ক্যারোলিনের মনোভাব বিচারের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমার এখন মনে হয় আমি জেনে গেছি তার কারণ। আমার ল্যাবরেটারি থেকে ক্যারোলিনই বিষটা চুরি করেছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো স্বামীর পথ থেকে আত্মহত্যা করে সরে যাওয়া। ঐ রকম একটা মনের হয়তো বিষাদময় পরিস্থিতিতে নিজেকেই ক্যারোলিন স্বামীর মৃত্যুর কারণ বলে শুরু করেছিলো ভাবতে–নিজেকে হয়ত বুঝিয়ে ছিলো যে তার স্বামীকে সেই খুন করার অপরাধে অপরাধী–যদিও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো যে অপরাধের, সত্যি সত্যিই তেমন কোনো অপরাধ সে করেনি আক্ষরিক অর্থে অনুমান এমন করা অসঙ্গত নয় আমার পক্ষে।
মনে হয় আমার এটা হতে পারে। এবং যদি তাই হয় তবে কার্লাকে প্রকৃত ঘটনাটা বোঝানো আপনার পক্ষে বোধ হয় সহজ হবে। সে ঐ যুবককে স্বচ্ছন্দে বিয়ে করতে পারে। এবং সন্তুষ্ট থাকতে পারে এটা জেনে যে ওর মা আসলে অবসান ঘটাতে চেয়েছিলো নিজেরই জীবনের।
দুঃখের বিষয় এই যে আপনি এসব কথা জানতে চাননি আমার কাছ থেকে অথচ আসল ঘটনা হলো এটাই আমার মনে পড়ে যতদূর। বাদ পড়ে গিয়েছিলো যে সব কথা এবার আমি সে সব পূরণ করে দিতে চাই। অ্যামিয়াসের মারা যাবার আগের দিন ঘটেছিলো যা যা তাতো আপনাকে আগেই বলেছি। ঐ দিনটায় কথায় এবারে আসছি।
ঘুম ভালো হয়নি রাতে বন্ধুদের ব্যাপারে আমার যে বিপজ্জনকভাবে ঘটনাবলী মোড় নিয়েছিলো তার জন্যে আমার ভীষণ উদ্বেগ ছিলো। অনেক রাত পর্যন্ত আমি জেগে জেগে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম চরম বিপর্যয়টাকে কীভাবে এড়ানো যায়। আমি ভোর ছ’টার সময় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম গাঢ় ঘুমে। আমার ঘুম ভাঙাতে পারেনি ভোরের চা-ও, যখন শেষে উঠলাম তখন প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে, ভীষণভাবে মাথা ভার হয়ে আছে। মনে হলো তার একটু পরে ঠিক তলার ঘরটাতে কে যেন চলাফেরা করছে, আমি যে ঘরটাকে ল্যাবরেটারি হিসেবে ব্যবহার করি।
একটা কথা এখানে বলে রাখি, শব্দ যেটা আসছিলো সেটা হতে পারে বেড়াল ঢুকে পড়ার জন্যেও। একটু ভোলা জানলার শার্সিটা, যেন অসাবধানে গতরাতে ওটা কেউ তুলে রেখে গেছিলো ওইভাবে। তবে বড়জোর একটা বেড়াল ঐ ফঁক দিয়ে ঢুকতে পারে। আমি শুধু শব্দের কথা উল্লেখ করলাম এইটুকু ব্যাখ্যা করার জন্যে যে আমি কেন ল্যাবরেটারিতে এসেছিলাম।
যেটুকু সময় লাগে পোষাক পরতে, আমি ল্যাবরেটারিতে ঢুকলাম তারপরেই, দেখলাম অন্য বোতলের সারি থেকে কোনাইনের বোতলটা একটু বেরিয়ে এসেছে। নজর ঐভাবে পড়ার পর চমকে উঠলাম আমি, খানিকটা বেশ খালি দেখাচ্ছে বোতলটা। বোতলটা প্রায় ভর্তি ছিলো আগেরদিন, আজ প্রায় খালি হয়ে আছে।