তার ভেতরের আদিম নারী সত্ত্বা প্রেমিকাকে হারিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পাঁচিলের ওপর থেকে আঁচড়ে-কামড়ে ফেলে দিতে চাইছিলো ক্যারোলিনকে, কেমন যেন ধারণা হয়েছিলো এলসার অ্যামিয়াসকে ছুরি মেরেছে ক্যারোলিন। ও অবশ্য বুঝেছিলো, কোনো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে।
ওকে ধরে ফেললাম আমি, তারপর ব্যাপারটা নিজের হাতে উইলিয়ামস তুলে নিলেন। সত্যি ভালো গভর্নেসটি, এ মানতেই হবে আমাকে। চেঁচামেচি যে এই পরিস্থিতিতে করতে নেই, শান্ত থাকতে হয় এই সব কথা বলে এলসাকে ঠান্ডা করে দিলো মিনিট খানেকের মধ্যে। সত্যিই বুদ্ধিমতী মহিলাটি, এবং যা ধরে তা আর ছাড়ে না। ফলে একপাশে দাঁড়িয়ে এলসা কাঁপতে লাগলো।
আর ক্যারোলিন..মনে পড়ে যতদূর, খুলে পড়েছিলো মুখোেশ। এক পাশে ভীষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো বলতে পারেন আপনি হতভম্ব হবার মতো হয়েছিলো। কিন্তু আসলে একটুও হয়নি। ওকে ধরিয়ে দিচ্ছিল ওর চোখ দুটোই। ক্যারোলিন ভীষণ সাবধানীর মতো লক্ষ্য করে চলেছিলো সব কিছু। মনে হয় আমার ভয় ওকে আস্তে আস্তে গ্রাস করছিলো…।
খুব আস্তে কথা বললাম আমি ওর কাছে গিয়ে, এতো আস্তে যা শুনতে পেলো না বাকি মহিলা। আমি বলেছিলাম, খুনী কোথাকার, শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুকে তুমি খুন করলে।
নিজেকে অদ্ভুত ভাবে গুটিয়ে নিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠলো ক্যারোলিন, না, …না, করেছে ও নিজেই…।
ক্যারোলিনের চোখে আমি চোখ রাখলাম, তুমি পুলিশকে ও সব গল্প বোলো। বলেও ছিলো ক্যারোলিন, কিন্তু বিশ্বাস করেনি পুলিশ।
ফিলিপ ব্রেকের বিবৃতির সমাপ্তি–
বিবৃতি মেরিডিথ ব্লেকের
প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
কথা দিয়েছিলাম আমি তাই ষোলো বছর আগে ঘটে গিয়েছিলো যে দুঃখজনক ঘটনা, তার মনে পড়ে যতোটা সেই বিবরণ আপনাকে জানাচ্ছি লিখিত ভাবে। বলে রাখি প্রথমেই সম্প্রতি আপনার সঙ্গে দেখা হবার সময়ে আপনি যা যা বলেছিলেন খুব গভীরভাবে সে সম্বন্ধে আমি চিন্তা করেছি। আমি ভেবে দেখলাম আগে যা বিশ্বাস করতাম এখন সেই কথাই বিশ্বাস করছি আরও বেশি পরিমাণে যে ক্যারোলিন ক্রেল বিষ দেয়নি তার স্বামীকে। সব সময়েই কথাটা বেখাপ্পা লাগতো আমার কাছে। কিন্তু কোনো অন্য কারণ না থাকায় এবং নিজের তার আচরণের জন্যে আমিও অন্যদের ভেড়ার মতো মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম অভিমতটাকে, তাছাড়া ও না খুন করলে আর কে করতে পারে খুন।
আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে অনেক ভেবেছি বিষয়টা নিয়ে আমি। বিকল্প যে যুক্তি সে সময়ে দেখানো হয়েছিল এবং আসামীপক্ষ বিচারের সময় থেকে যা বলা হয়েছিলো বিশ্লেষণ করেছি সবকিছু। যুক্তিটা হলো সেই এই যে আত্মহত্যা করেছে অ্যামিয়াস ক্রেল। যতটুকু জানি আমি অ্যামিয়াসকে তার ভিত্তিতে সে সময়ে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো যুক্তিটাকে আমার। মনে করি বর্তমানে আমার বদলানো উচিত অভিমত। প্রথমেই বলি এবং গুরুত্ব আছে কথাটার যথেষ্ট যে ঐ কথাটা ক্যারোলিনও বিশ্বাস করতো। আমরা যদি এখন মেনে নিই একথা যে অন্যায় ভাবে ঐ সুন্দরী নম্র স্বভাবের মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো তবে মর্যাদা দিতে হয় তার বহুঁকালিক বিশ্বাসটিকে। ও অ্যামিয়াসকে আমাদের সকলের চেয়ে অনেক ভালোভাবে চিনতো। যদি ওটাকে ক্যারোলিন আত্মহত্যা মনে করে থাকে তবে অবিশ্বাসী অ্যামিয়াসের বন্ধুরা যাই বলে থাকুক না কেন ওটা আত্মহত্যাই।
একটা তত্ত্ব আমি খাড়া করছি–বিবেক বলে একটা বস্তু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেলের মধ্যে, চাপা অনুতাপও ছিলো মনের মধ্যে এর, ওই কাজটা ও করে থাকতে পারে। চরম হতাশার আবর্তে পড়ে এবং এই ধরনের ওর মানসিক যন্ত্রণার কথা বেশি ভালো করে স্ত্রী ছাড়া আর কে পারে জানতে বলুন। যদিও ঐ ধরনের কোনো কিছু কখনো শুনিনি বলতে আমি। তবে ঠিক এ কথাও অনেক গুজবের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে এই ধরনের যা আদৌ সন্দেহ করা যায় না এবং তার প্রকাশ হঠাৎ হলে বেশ আশ্চর্য হয়ে যাই আমরা। সম্মানিত ও সংযমী মানুষের মধ্যে জীবনের অনেক স্থূল দিক লুকিয়ে থাকতে পারে। অনেক সময় অর্থলোভী মানুষের মধ্যে দেখা দেয় অসাধারণ শিল্পবোধ। কোমলতা, স্নেহ থেকে আপাত নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়ে। নিষ্ঠুর প্রবৃত্তির চাপ থাকে হাসিখুশি মানুষের মধ্যে।
ফলে হতে পারে এটা যে অ্যামিয়াস ক্রেলের মধ্যেও ছিলো একটা আত্মধিক্কারের বোধ। সে যতই চেঁচামেচি বাইরে করুক না কেন, তাকে সহ্য করতে হতো বিবেকের দংশন সংগোপনে। এটা অযৌক্তিক হলেও আপাত দৃষ্টিতে, আমার মনে হচ্ছে কেমন যেন অবিশ্বাস্য করার নয় কথাটা বারবার ক্যারোলিনও বলেছিলো। আর আমি বলছি আজ, উড়িয়ে দেবার নয় কথাটা।
এবারে আসা যাক প্রকৃত ঘটনায়, অর্থাৎ এই নতুন বিশ্বাসের আলোতে আমাদের প্রকৃত ঘটনার মূল্যায়ন করি।
মনে হয় আমার এক্ষেত্রে অ্যাল্ডারবেরিতে এলসার প্রথম আসার সময় অর্থাৎ কয়েক সপ্তাহ আগে ঐ দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটার ক্যারোলিনের সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিলো আমার তার বর্ণনা দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আগেই তো আমি বলেছি আপনাকে যে আমার ক্যারোলিনের প্রতি প্রগাঢ় স্নেহ আর বন্ধুত্বের মনোভাবটা অজানা ছিলো না তার। ফলে সহজেই আমার কাছে সে তার মনের গোপন কথা বলতে দ্বিধা করতো না। মনে মনে ও যে অশান্তিতে ভুগছে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, তবুও একদিন যখন প্রশ্ন করে বললো যে সত্যি সত্যিই কী অ্যামিয়াস জড়িয়ে পড়েছে এলসার ব্যাপারে, তখন পারিনি আশ্চর্য না হয়ে।