ঠিক সেই মুহূর্তে লাল টকটকে একটা সোয়টার হাতে এলসা বাড়ির দিক থেকে এলো। অ্যামিয়াস ওকে দেখে বলে, চলো চলো, পোজ দেবে চলো, আর সময় নষ্ট করতে চাই না। ইজলের সামনে গিয়ে মিয়াস দাঁড়ালো। ওর পা-টা একটু কঁপছিলো, তবে কি মদ খুব বেশি খেয়েছে। যে রকম চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি চলছে তাতে ও এটা করবে আর আশ্চর্যের কি আছে!
বিরক্তির সুর গলায় ফুটিয়ে বললো, যেন আগুনের মতো গরম বিয়ারটা। কেন যে এখানে বরফ রাখা হয় না কে জানে?
তখন ক্যারোলিন বলেছিলো, আমি এখুনি ফ্রিজের ঠান্ডা বিয়ার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ধন্যবাদ, কোনো রকমে অসন্তোষ চাপা দিয়ে কথাটা অ্যামিয়াস বলেছিলো।
তারপর ক্যারোলিন আমাদের সঙ্গে নিয়ে কামান বাগানের দরজা ভেজিয়ে বাড়িতে এলো। চত্বরে বসে পড়লাম আমরা বাড়ির মধ্যে ক্যারোলিন ঢুকে গেলো। অ্যাঞ্জেলা মিনিট পাঁচেক পরে কয়েক বোতল বীয়ার আর গ্লাস নিয়ে এলো। বেশ গরম ছিল দিনটা, আমরা তার সদগতি করতে লাগলাম সানন্দে। এমন সময় দেখি ক্যারোলিন অ্যামিয়াসকে এক বোতল বীয়ার নিয়ে দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে চেয়েছিলেন যেতে মেরিডিথ, কিন্তু বাঁধা দিয়ে ক্যারোলিন জোর করেই চলে গেলো একলা। আমি ভেবেছিলাম ক্যারোলিন ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছে। একলা থাকতে দিতে চাইছে না অ্যামিয়াস আর এলসাকে, অথচ মনে হয় আজ বোকার মতোই না আমি তখন ও কথা ভেবেছিলাম।
ওকে চলে যেতে দেখেছিলাম আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে আমি আর দাদা। কি করবো আমরা তখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। অ্যাঞ্জেলা এমন সময় ডাকলো আমাকে সমুদ্রে স্নান করতে যাবার জন্যে। একলা পাওয়া মেরিডিথকে মুস্কিল হচ্ছে দেখে শুধু বলে গেলাম যাবার সময় দুপুরে খাওয়ার পর। মাথা নেড়ে সায় দিলেন দাদা।
অনেকক্ষণ অ্যাঞ্জেলার সাথে সাঁতার কেটে রৌদ্র স্নান করছিলাম একটা পাথরের ওপর শুয়ে। আর বকবক করছিলো না অ্যাঞ্জেলা, ফলে আমি ভাববার সময় পেয়ে গেলাম। ঠিক করলাম আমি ক্যারোলিনকে দুপুরে খাওয়ার পর আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুরির ব্যাপারে প্রশ্ন করবো সরাসরি। চলবে না দাদাকে দিয়ে করলে, উনি বড্ড দুর্বল চিত্ত মানুষ। ক্যারোলিন বাধ্য হবে চাপ পড়লে ফিরিয়ে দিতে বিষটা, না দেয় যদি, ওটা কাজে আর লাগাতে পারবে না। আর বেশ পোড় খাওয়া মেয়ে এলসা, কম বয়স, নিশ্চয়ই গণ্ডগোল বাধাবে না বিষ নিয়ে। অত্যন্ত চালাক চতুর মেয়ে, নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চলবেই। ক্যারোলিন আবার এ ব্যাপারে ভীষণ বিপজ্জনক মানুষ, ভারসাম্য নেই মনের। অনেক কিছু করে ফেলতে পারে আবেগের ঘোরে। ওর নার্ভগুলোও ভালো নয়। তবে একটা কথা আমি তখন পারছিলাম না মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে–কোনো ভুল করছেন না তো দাদা? আবার চুরি তো চাকর বাকরও করতে পারে? নিশ্চয়ই জানেন, অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ব্যাপার বিষের ব্যাপারটা ভরসা করা যায় না এর ওপর।
এবং কিছু না ঘটে যতক্ষণ, কিছু বলাও যায় না।
অনেক সময় কেটে গেছে এইসব চিন্তা করতে করতে। ছুটলাম আমি আর অ্যাঞ্জেলা, সময় হয়ে গেছে লাঞ্চ খাওয়ার। সবাই টেবিলে বসে পড়েছে অ্যামিয়াস বাদে। অ্যামিয়াস কামান বাগানেই থেকে গেছে। ও প্রায়ই এ রকম করে, তবে আমার সেদিন মনে হয়েছিলো অ্যামিয়াস এলো না ঝঞ্জাট এড়াবার জন্যে।
কফি খেলাম চত্বরে বসে। কেমন দেখাচ্ছিল ক্যারোলিনকে, কী করছিলো ক্যারোলিন এটা মনে করতে পারছি না কিছুতেই, ভালো হতে পারলে। তবে একটুও ওকে মনে হয়নি উত্তেজিত। ও একটা আস্ত শয়তানি।
কারণ ঠান্ডা মাথায় বিষ খাইয়ে কাউকে মারাটা শয়তানি ছাড়া আর কি। ও যদি এর চেয়ে স্বামীকে রিভলবার চালিয়ে খুন করতো, তাহলেও ওর সম্বন্ধে যা হোক অন্য কিছু ধারণা করতাম। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় এইভাবে বিষ খাওয়ানো প্রতিশোধ নেবার জন্যে…এ যে ভাবাই যায় না।
ক্যারোলিন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো–অ্যামিয়াসকে কফি দিয়ে আসতে হবে। ও জানতো অথচ..যা হবার ততক্ষণে হয়ে গেছে, আর বেঁচে নেই অ্যামিয়াস। ওর সঙ্গে মিস উইলিয়ামস গেলো। তবে ডেকে ছিলো কিনা ক্যারোলিন তা মনে নেই।
চলে গেলো দুজনে। এমনি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন মেরিডিথ। আমি দাদার কাছে একটা অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি ছুটতে ছুটতে আসছেন এমন সময় দেখি, সাদা হয়ে গেছে মুখটা, হাঁফাতে হাঁফাতে কোনো রকমে বললেন, ডাকতে হবে ডাক্তার…শিগগীর…অ্যামিয়াস…
চমকে উঠলাম আমি, ও কি অসুস্থ…মনে হচ্ছে মরে যাবে?
মেরিডিথ বললেন, মনে হয় তো আমার মরে গেছে।
মুহূর্তের জন্যে আমরা এলসার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর তীব্র চিৎকার হঠাৎ কানে এলো। যেন বিলাপ করছেন বাস্তুলক্ষ্মী।
কেঁদে উঠলো, এলসা, মরে গেছে? মরে গেছে…। এলসা ছুটে চলে গেলো আহত হরিণীর মতো। ও যেন প্রতিশোধ নেবার হিংসাতে পাগল হয়ে উঠেছে।
কোনো রকমে মেরিডিথ বললেন, যাও ওর সঙ্গে। টেলিফোন করতে যাচ্ছি আমি। ওকে ধরো, বলা যায় না কি করে ফেলে।
আমি এলসার পেছনে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি ছুটলাম। আর একটু হলে ও ক্যারোলিনকে খুব সহজেই মেরে ফেলতে পারতো। জীবনে কখনো দেখিনি শোক আর ঘৃণার এমন অভিব্যক্তি। খুব পলেস্তারা বসে গেছে শিক্ষা-দীক্ষার। এলসার মিল মজদুর বাবা আর তার মায়ের রূপটা তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে।