মঁসিয়ে পোয়ারো শুনুন, আমার কথাটা পরিষ্কারভাবে বোঝার চেষ্টা করুন–আমি আপনাকে একটি খুনের কেসের তদন্ত করার জন্যে নিয়োগ করতে চাইছি।
কি বলতে চাইছেন আপনি?
হ্যাঁ, চাইছি। খুনের কেস খুনেরই কেস, তা সে গতকালই হয়ে থাক, খুনটা বা ষোলো বছর আগেই হয়ে থাক তাতে যায় আসে না এমন কিছু।
কিন্তু…।
মঁসিয়ে পোয়ারো দাঁড়ান, আপনি এখনও শোনেননি সবটা, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার আছে।
বলুন। আবার গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে পোয়ারো।
নির্দোষ ছিলেন আমার মা। কার্লা লেমারচেন্ট বললো।
পোয়ারো নিজের নাকটা ঘসতে ঘসতে বিড়বিড় করে বললো, ও হ্যাঁ, স্বাভাবিক খুবই..তাই অনুমান করেছিলাম আমিও…।
ভাবালুতার ব্যাপার নয় কিন্তু এটা। একটা চিঠি আছে মার লেখা। আমার জন্যে এটা রেখে গিয়েছিলেন মারা যাবার আগে। চিঠিটা আমাকে একুশে পা দিলে দেওয়া হয়। মা ওটা আমাকে একটি মাত্র কারণেই লিখেছিলেন–যেন কোনো সন্দেহ না থাকে আমার মনে। এটুকুই চিঠির মূল বক্তব্য। মা করেননি ও কাজটা আর আমি যেন বিনা দ্বিধায় সে কথাটা বিশ্বাস করি।
এরকুল পোয়ারোর দিকে যৌবন দীপ্ত একটি মুখ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দেখে ধীরে ধীরে সে বললো, তা তো বটেই…।
মৃদু হেসে কার্লা বললো, না, ঐ রকম ছিলেন না আমার মা। মনে করছেন আপনি হয়তো মিথ্যে কথাটা–মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে একটা আবেগের ঘোরে!…না মঁসিয়ে পোয়ারো, শুনুন কতগুলো এমন জিনিস থাকে যা খুব ভাল বোঝে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, মনে রাখে, আমার মনে আছে আমার মার কথা–যদিও টুকরো টুকরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, তবে কি ধরনের মানুষ তিনি ছিলেন তা মনে আছে। কখনো মিথ্যে কথা মা বলতেন না এমন কি স্নেহ মমতা দেখাতে গিয়েও না। মনে দুঃখ পাবে জানলেও সব সময়ে তিনি সত্যি কথাটা বলতেন। তার স্বাভাবিক এক অনীহা ছিল মিথ্যে সম্বন্ধে। উনি যে খুব ভালবাসতেন আমাকে তা মনে হয় না, তবে মাকে খুব বিশ্বাস করতাম আমি। এখনও করি। যদি মা বলে থাকেন বাবাকে খুন করেননি তিনি, তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই পারে না থাকতে যে খুন করেছেন মা। বিশেষ করে মৃত্যু আসন্ন এটা যখন উনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন তখন এই ধরনের একটা কথা যা কিনা মিথ্যে তা তিনি লিখে যেতে পারেন বলে বিশ্বাস হয় না আমার।
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো মন খুব একটা সায় না দিলেও! যেন মেনে নিচ্ছে কথাটা। বলে চললো কার্লা, এবং জনকে বিয়ে করার ব্যাপরে সেই কারণেই আমার কোনো দ্বিধা নেই। কারণ মার দিক থেকে ও ধরনের কিছু ঘটেনি তা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু জনের ব্যাপারটা আলাদা। সাধারণ সব মেয়েরই মত ও মনে করে নিজের মাকে আমিও নির্দোষ ভাবছি। ফলে পরিষ্কার হওয়া উচিত ব্যাপারটা। এবং মঁসিয়ে পোয়ারো ও কাজটা করতে হবে আপনাকেই।
আপনার কথাটা ঠিক তা ধরে নিচ্ছি…কিন্তু ইতিমধ্যে তা কেটে গেছে ষোলটা বছরও।
কাজটা খুবই কঠিন তা মানছি। কিন্তু এ কাজটা আপনি ছাড়া আর কেউই করতে পারবে না।
দুটো চোখ এরকুল পোয়ারোর ঝিকমিক করে উঠলো, এ হে হে, একেবারে আমাকে তুলে দিচ্ছেন গাছে।
আপনার কথা আমি শুনেছি, সব কেস যে করেছেন তাও জানি, জোগাড় করেছি কি ভাবে করেছেন সে খবরও। বেশিটা আপনি নির্ভর করেন মনঃস্তত্ত্বের ওপর, তাই না? আর কখনও তো ওটা বদলায় না। সিগারেটের টুকরো, পায়ের ছাপ, নুয়ে পড়া ঘাস–ওগুলো তো নশ্বর জিনিস, আপনার নিশ্চয়ই ওসবে দরকার হবে না। তবে খুঁটিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন ঘটনার পুরো বিবরণটা, তখনকার মানুষজনের সঙ্গেও দরকার পড়লে কথা বলতে পারেন। এখনও বেঁচে আছেন তাদের প্রায় সকলেই…এবং তারপর..তারপর…চেয়ারে হেলান দিয়ে আপনার কথাতেই বলছি শুধু চিন্তা করে তুলে ধরতে পারেন প্রকৃত ঘটনার স্বরূপ…।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এরকুল পোয়ারো,-গোঁফে এক হাত দিয়ে তা দিতে দিতে বললো, মাদমোয়াজেল, দারুণ সম্মানিত বোধ করছি আমি। আমি আপনার এই অগাধ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো। আমি দায়িত্ব নিলাম খুনের রহস্য ভেদ করার। ষোল বছর আগেকার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করে তুলে ধরবোই প্রকৃত সত্যকে আমি।
উঠে দাঁড়িয়েছে কালাও, উজ্জ্বল আভা তার চোখেও, কিন্তু শুধু মুখে বললো, বেশ।
পোয়ারো বললো আঙুল তুলে, এক মিনিট আর, সত্যের স্বরূপ আমি প্রকাশ করবো তা আমি বলেছি। পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন আমার মধ্যে ওঠে না। আপনার মা নির্দোষ আপনি বলেছেন, এখন সেটা আমি মেনে নিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত যদি তিনিই প্রমাণিত হন দোষী? কি হবে তখন?
অহংকারীর মতো কার্লা ঘাড় বেঁকালো, তার মেয়ে আমি। সত্যি কথাটা আমি জানতে চাই।
ঠিক আছে, দেখা হবে আবার তাহলে।
.
প্রথম খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
আসামী পক্ষের উকিল :
আমার মনে আছে কি না ক্রেল মামলা? স্যার মন্টেগু ডিপ্লিচ প্রশ্ন করলেন, নিশ্চয়ই আছে, মনে আছে খুব ভালোভাবেই বেশ আকর্ষণ ছিলো মহিলার, তবে কিছু একটা গণ্ডগোলও ছিল মাথায়। বড্ড বেশি আত্মসংযমের অভাব।
পোয়ারোর দিকে স্যার মন্টেগু আড়চোখে তাকালেন, কিন্তু কেন আমাকে ওকথা জিজ্ঞেস করছেন?
দরকার আছে আমার। এটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, স্যার মন্টেগু তার কুখ্যাত নেকড়ে হাসি হাসলেন, যে হাসি ধরিয়ে দিতো অতীতে সাক্ষীদের হৃৎকম্প বলে খ্যাতি আছে। আমি হেরে গিয়েছিলাম এই মামলাটায়। পারিনি মহিলাকে বাঁচাতে।