আমাকে জাহাজে করে তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো, আমার কাছে সে যে দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার ছিলো। শেষ পর্যন্ত কানাডায় পৌঁছলাম আমি, দেখা হলো সাইমন মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। তারপর মনট্রিয়ালে মাসী লুইসি আর মেসো সাইমনের সঙ্গে আমি থাকতে লাগলাম। মাসীরা মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই বলতেন তারা শীগগীরই আসবেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে গেলে ওদের কথা ভুলেই গেলাম। কেমন যেন একটা আবছা ধারণা আমার জন্মে গেল তারা যেন আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। যদিও সেকথা খোলাখুলিভাবে আমাকে কেউ বলেননি। এবং যা হয় এরপর আমি আর ভাবতাম না মা বাবার কথা। আমার মাসীর বাড়িতে বেশ সুখেই দিন কাটতে লাগলো। আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন মাসী আর মেসো। আমি স্কুলে ভর্তি হলাম। অনেক বন্ধু বান্ধব হলো। আমার যে একটা অন্য নাম আছে তাও আমার মনে রইলো না। আমার যে লেমারচেন্ট পদবী নয় তাও গেলাম ভুলে। কানাডাতে ঐ নামই চলবে তা মাসী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এবং আমারও মনে হয়েছিলো হয়তো নিয়মটা তাই। কিন্তু ঐ যে পরে বলেছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম আমি যে অন্য একটা নাম আমার আগে ছিলো।
কার্লা তারপর হঠাৎ তার একটু অহংকারীর মত মুখটা উঁচু করে বললো, দেখুন আমাকে, মনে হয় না যে দেখলে এমন একটা মেয়ে এ যে কোনো কিছুতেই সে ঘাবড়াবার পাত্রী নয়, বা কোনো দুঃশ্চিন্তা এর থাকতে পারে। অবস্থা আমার সচ্ছল, স্বাস্থ্যও সুন্দর। খারাপ নই দেখতেও, উপভোগ করতে জানি জীবনকে। যখন কুড়ি বছর বয়স ছিলো আমার তখন নিজেকে ছোট মনে করতাম না পৃথিবীতে কারুর চেয়ে।
কিন্তু আমার জীবনে তারপর থেকেই এল এক সমস্যা। নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে শুরু করলো। প্রসঙ্গঃ আমার বাবা মা। কে ছিলেন তারা? কি করতেন? হয়তো আমি উঠে পড়ে লাগতামও সবকিছু জানবার জন্যে।
মাসীরা কিন্তু তার আগেই আমাকে জানিয়েছিলেন সত্যি কথাটা। তখন পা দিয়েছি আমি একুশে। আমাকে ওঁরা অবশ্য বাধ্যই হয়েছিলেন বলতে কারণ আমার হাতে আমার টাকাকড়ি এখন তুলে দেওয়া হলো, আর জানেন আমার হাতে ঠিক তখনই এলো চিঠিটা। আমাকে উদ্দেশ্য করে যে চিঠিটা লিখে রেখে গিয়েছিলেন আমা মা মারা যাবার আগে।
মেয়েটির মুখের ভাব মায়ের প্রসঙ্গ আসতেই কেমন যেন মলিন হয়ে উঠলো। সেই উজ্জ্বলতা আর নেই তার চোখের দৃষ্টিতে। তার বদলে সেখানে ফুটে উঠলো ছায়াঘেরা ছোট্ট দীঘির মতো শান্ত গভীরতা। আবার মেয়েটি বলতে শুরু করলো, আর আমি ঠিক তখনই সত্যি কথাটা জানতে পারলাম যে খুনের অপরাধে আমার মা দণ্ড পেয়েছিলেন। মেয়েটি আর কথা বলতে পারলো না কয়েক সেকেন্ড, আবার মুখ খুললো ধীরে ধীরে, আর একটা ব্যাপার আছে আপনাকে যেটা বলতেই হবে। আমার বিয়ের কথা এক জায়গায় ঠিক আছে। মাসীরা বলেছিলেন আমার বয়েস একুশ না হওয়া পর্যন্ত যেন আমি অপেক্ষা করি। ওরা কেন ও কথা বলেছিলেন তা এখন বুঝতে পারি।
একটু নড়েচড়ে উঠলো পোয়ারো, তারপর মুখ খুললো প্রথম, কি প্রতিক্রিয়া হলো আপনার বাগদত্তের ঐ কথা শুনে?
জনের? এসব পরোয়া করে না জন। আমাকে ও বললো ও এসব ঘটনা নিয়ে রাজী নয় মাথা ঘামাতে। ও আর আমি বলতে জন আর কার্লাকে শুধু বোঝে, ও চিন্তা করে না অতীত সম্বন্ধে। মেয়েটি আবার একটু ঝুঁকে বসে বললো, এখনও কিন্তু আমরা বাগদত্ত। কিন্তু এটা উড়িয়ে দেবার ব্যাপার নয় তা তো আপনি বোঝেন, আমার কাছে এমন কি জনের কাছেও নয়…মাথা ঘামাচ্ছি না অতীতটা নিয়ে, কিন্তু ভবিষ্যৎ?–হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠলো মেয়েটির, দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো আমরা তো নিশ্চয়ই বিয়ের পর বাচ্চা চাইবো এবং আমাদের সন্তান এরকম একটা অস্বস্তিকর আশংকার মধ্যে মানুষ তোক এটা আমি চাই না।
পোয়ারো বললো, কিন্তু আপনি কি এটা বুঝতে পারেন না যে এই ধরনের হিংসাত্মক বা পাপের ঘটনা প্রত্যেক পরিবারের অতীত ইতিহাসে বিরল নয়?
ঠিক বুঝতে পারছেন না আপনি। আপনার কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু সাধারণতঃ তা কেউ জানে না বা মনে রাখে না। আমি যে জেনে ফেলেছি, তাছাড়া এই ধরনের ঘটনাটা যে আমার নিকটতম আত্মীয়ের জীবনে ঘটে গেছে। আমি দেখেছি মাঝে মাঝে জন যেন কেমন ভাবে তাকায় আমার দিকে। ধরুন ওকে যদি বিয়ের পর আমি আমার দিকে ঐভাবে তাকাতে দেখি?
কিভাবে মারা যান আপনার বাবা?
কার্লা অকপটভাবে পরিষ্কার করে বললো, বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো।
বুঝেছি, কথা বলে পোয়ারো চুপ করে গেলো।
কার্লা একটু পরে নির্লিপ্ত অথচ শান্তভাবে বললো, ধন্যবাদ আপনার সহৃদয়তার জন্যে। আমার কথাটা আপনি যে বুঝতে পেরেছেন এতে কৃতজ্ঞ আমি। আপনি যে আমাকে স্তোক দেবার চেষ্টা করেননি মামুলী সান্ত্বনার কথা বলে এতেই মনে হয় কাজ হবে আমার।
আমি ভালই বুঝেছি আপনার ব্যাপারটা। একটা কথা বুঝতে পারছি না…আপনি আমার কাছ থেকে কি চান?
কার্লা খুব সরলভাবে জানালো, জনকে বিয়ে করতে চাই আমি। সত্যিই চাই। আমি মা হতে চাই দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ের। এবং বাস্তবে যেন সেটা সম্ভব হয় আপনাকে তার জন্যে সাহায্য করতে হবে।
তার মানে–মানে আমি আপনার জনের সাথে কথা বলি আপনি কি তাই চান? না, না, বড্ড বেশি করে বোকামির কাজ হয়ে যাবে। যা বলতে চাইছিলেন আপনি তার সঙ্গে যেন এর কোথায় একটা দারুণ অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। খুলে বলুন না কি চান আপনি?