তোমার ভালোবাসার অভিলাষ যদি এতই মহৎ হয়, বিবাহ চাও পরিণতিতে, তবে খবরটুকু পাঠিয়ে দিও আগামীকাল, যাতে চলে যেতে আমি পারি তোমার কাছে, তুমি আয়োজন করবে যখন এবং যেখানে উৎসবের। অঞ্জলি দেব আমার সমস্ত সম্পদ তোমার চরণে হে নাথ যেখানে নিয়ে যাবে, তোমার সাথে সেখানেই যাবো।
যৌবনের কথা হলো এই, জুলিয়েটের মুখে ভালোবাসার কথা। সংযম নেই কোনো, নেই কোনো পিছিয়ে আসা, তথাকথিত আনত নয়না কুমারীর সলাজ ভঙ্গী নেই। এখানে যৌবন মদমত্ত নারী সাহসিকা, অকুতোভয় হয়ে উঠেছে। শেক্সপীয়ার ভালোই জানতেন দেখছি যৌবন কি জিনিস। রোমিওকে নির্বিচারে আলাদা করে বেছে নিচ্ছে জুলিয়েট। ওথেলোকে চেয়ে বসেছে ডেসডিমোনা। কোনো দ্বিধা নেই তাদের জন্যে, দ্বন্দ্ব নেই তার দাবীতে অচল অহংকারী যৌবন–অটল হয়ে আছে।
চিন্তান্বিতভাবে পোয়ারো বললো, আপনি তাহলে বলছেন জুলিয়েটের ভাষাতেই এলসা গ্ৰীয়ার কথা বলেছিলো?
হ্যাঁ, বড়লোকের লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে ও ছিলো–যুবতী, সুন্দরী, ধনী। পুরুষ সঙ্গীকে মনের মতো খুঁজে পেয়েই দাবী করে বসলো তাকে। তবে অবিবাহিত যুবক রোমিওকে নয়। মাঝ বয়সী এক বিবাহিত চিত্রশিল্পীকে। এলসার কোনো বিধিনিয়ম জানা ছিলো না নিজের কামনাকে সংযত করার মতো। নিয়ে নাও যা চাও, একটাই আমাদের জীবন,–ওর জপমালা ছিলো আধুনিকতার এই মূলমন্ত্রটিই।
মিঃ জোনাথন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারের পিঠে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, তবে এক হিংস্র জুলিয়েট। যুবতী, নিষ্ঠুর অথচ দুর্বল ভীষণভাবে। পাশার চাল দেয় মরিয়া হয়ে হারবে হয়, নয় জিতবে। এবং ও জিতেছিলো তা তো মনে হয়… কিন্তু তারপর শেষ মুহূর্তে গিয়ে–শোনা গেল মৃত্যুর পদধ্বনি–সেইসঙ্গে এলসা গ্ৰীয়ার যে কিনা প্রাণবন্ত, আনন্দের উত্তাপে ভরা সে মরে গেলো। শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণা, নিষ্ঠুর, কঠোর হৃদয় এক মেয়ে রয়ে গেলো, সেই মহিলাটিকে যে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলো যে সব সুখকে এলসার জীবনের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
মিঃ জোনাথন হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বললেন–আরে দেখুন তো ভাই, কি বলতে কি বলেছি, আমাকে এইটুকু অতি নাটকীয়তার জন্য ক্ষমা করবেন। স্কুল জীবনবোধসম্পন্ন যুবতী ছিলো এলসা। ওর চরিত্রে আকর্ষণীয় কোনো দিকই নেই আমার মতো গোলাপ সাদা যৌবন, ভরপুর হৃদয়ের আবেগে, বিবর্ণ’ ইত্যাদি। আর কি থাকে এইটুকু বাদ দিলে মেয়েটির জন্যে, একজন খ্যাতিমান পুরুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মামুলী একটা যুবতী হৃদয়ের সিংহাসনে বসাবার জন্যে ।
যদি বিখ্যাত শিল্পী না হতেন অ্যামিয়াস ক্রেল…বলতে শুরু করতেই পোয়ারো মিঃ জোনাথন সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন ঘাড় নেড়ে, ঠিক, ঠিক, ব্যাপারটা দারুণ ধরেছেন। বীরপূজা করে আজকালকার এলসারা। কিছু একটা করতে হবে পুরুষটিকে, কেউকেটা হতে হবে একজন।…অবশ্য ব্যাঙ্কের কেরাণী বা বীমার দালালের মধ্যেই ক্যারোলিন ক্রেল তার মনের মানুষ খুঁজে নিতে পারতো। মানুষ হিসেবে ক্যারোলিন অ্যামিয়াসকে ভালোবেসেছিলো, শিল্পী হিসেবে নয়। ক্যারোলিন অমার্জিত ছিলো না এলসা গ্ৰীয়ারের মতো… অথচ এলসা যুবতী, সুন্দরী, কিন্তু ও ভারী অসহায় আমার মনে হতো।
পোয়ারো শুতে গেলো নানা রকম চিন্তা মাথায় নিয়ে। ওর চিন্তা ব্যক্তিত্বের সমস্যা নিয়ে। একটা বেহায়া মেয়ে ছাড়া এলসা আর কিছু নয় এডমণ্ডের চোখে। অথচ সে হলো শাশ্বত জুলিয়েট আর ক্যারোলিন ক্রেল বৃদ্ধ জোনাথনের দৃষ্টিতে। ক্যারোলিন সম্বন্ধে প্রত্যেকে ভিন্নতর কথা বলেছে। ক্যারোলিনের পরাজিতের মনোভাবের জন্যে স্যার মন্টেগু ক্যারোলিনের নিন্দে করেছেন। যেন রোমান্সের প্রতিমূর্তি ক্যারোলিন কমবয়েসী ফগের মতে। ক্যারোলিন নিছক এক মহিলা এডমণ্ডসের দৃষ্টিতে। ক্যারোলিনকে মিঃ জোনাথন বলেছেন এক অবাধ্য ঝোড়ো হাওয়া।
দেখলে কি দৃষ্টিতে দেখতে এরকুল পোয়ারো, আর এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের ওপরই পোয়ারোর অভীষ্ট সিদ্ধির ব্যাপারটি নির্ভর করছে।
পোয়ারো এখন পর্যন্ত আলাপ করেছে যত লোকের সঙ্গে তাদের মধ্যে সন্দেহ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি একজনও যে আর যাই হোক ক্যারোলিন ক্রেল, খুনীও বটে সেই সঙ্গে।
.
পঞ্চম অধ্যায়
পুলিস সুপারিনটেণ্ডেন্ট
চিন্তামগ্ন হয়ে অবসরপ্রাপ্ত পুলিস সুপার হেল পাইপে টান দিয়ে বললেন, আপনার এই চিন্তাটা মঁসিয়ে পোয়ারো বেশ উদ্ভট কিন্তু।
হয়তো বলতে পারেন সামান্য অসম্ভব, খুব সাবধানে ওর কথায় পোয়ারো সায় দিলো।
দেখুন বহুদিন আগেকার ব্যাপারটা, কথাটা হেল শুরু করতেই মনে মনে এরকুল পোয়ারো সামান্য বিরক্ত হয়ে উঠলো, যেমন বিরক্ত লাগে একই কথা বারবার শুনতে।
হা একটু বেড়ে যায় বৈ কি অসুবিধেটা, বিনীতভাবে বললো পোয়ারো।
খুঁচিয়ে তোলা অতীতকে, পুলিশ সুপার হেল প্রায় আপন মনে বলতে লাগলেন, তাও যদি একটা এর কোনো উদ্দেশ্য থাকতো…।
একটা উদ্দেশ্য আছে।
কি সেটা?
অনেকে তো আনন্দ পায় সত্যকে খুঁজে বের করার জন্যে, তাদেরই একজন আমি। তাছাড়া আপনি নিশ্চয়ই ঐ কমবয়সী মেয়েটিকে ভুলে যাবেন না।
হা, হা দেখা তো উচিত মেয়েটির দিকটাও। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো মাফ করবেন, উদ্ভাবনী শক্তির তো সীমা নেই আপনার। মেয়েটিকে একটা কিছু বানিয়ে দিন না বলে।