তাহলে কি ছিলেন? আর আমি ঠিক ঐ জিনিসটাই জানতে চাই ভালোভাবে। জানতে চাইলো পোয়ারো।
বুঝেছি বুঝেছি, কিভাবে উনি ঐ কাজটা করলেন? সত্যিই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কিন্তু মহিলাটিকে বিয়ের আগে থাকতেই চিনতাম। ওঁর নাম তখন ছিলো ক্যারোলিন স্পলডিং। অশান্ত খুব, ওঁর জীবন ছিলো দুঃখের। যখন খুব ছোট ক্যারোলিন তখন ওঁর বাবা মারা যান। ক্যারোলিন বিধবা মাকে খুব ভালোবাসতেন। অবশ্য পরে ওর মা আবার বিয়ে করেন। একটা বাচ্চাও হয়। সত্যিই তার পরের ব্যাপারটা খুব দুঃখের। মাঝে মাঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্যে অদ্ভুত এক ঈর্ষা দেখা দেয়।
কাউকে কি ক্যারোলিন ঈর্ষা করতেন?
নিশ্চয়ই। ঘটে যায় একটা বিশ্রী ঘটনাও একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মেরেছিলেন নিজের সৎ বোনকে। একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় বোনটার, আর বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো মুখটাও। অবশ্য পরে সব সময় ঐ ব্যাপারটা নিয়ে ক্যারোলিন দুঃখ প্রকাশ করতেন।..আর যত সামান্যই হোক না কেন বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা, এটাকে খুব ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে ধরা হয়েছিলো বিচার চলার সময় জুরির সামনে।
বৃদ্ধ একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, সরকার পক্ষ ঐ ঘটনাটা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছিলেন যে ভীষণ রাগী চরিত্রের ক্যারোলিন এবং প্রতিহিংসাপরায়ণা। অবশ্য ঠিক নয় কথাটা। না, ঠিক নয়।
বৃদ্ধ সলিসিটার আর এক দফা থেমে আবার শুরু করলেন স্মৃতি রোমন্থন করা। ক্যারোলিন প্রায়ই অ্যাল্ডারবেরিতে এসে স্পলডিং থাকতেন। খুব ভালো ঘোড়ায় চড়তেন, বুদ্ধিমতীও বটে। ওঁকে রিচার্ড ক্রেল খুব পছন্দ করতেন। তাকে খুব ভালোবাসতেন মিসেস ক্ৰেলও। নিজের বাড়িতে সুখ-শান্তি ক্যারোলিন পেতেন না। বেশ হাসিখুশি থাকতেন অ্যাল্ডারবেরিতে এলে। ক্যারোলিনের গভীর বন্ধুত্ব ছিলো অ্যামিয়াসের বোন ডায়না ক্রেলের সঙ্গে। তখন প্রায়ই অ্যাল্ডারবেরিতে আসতে পাশের গ্রামের ফিলিপ আর মেরিডিথ ক্লিক। বরাবরই লোভী নোংরা স্বভাবের ছিলো ফিলিপ, টাকা পয়সা কি করে কামাতে হয় এ ছাড়া অন্য চিন্তা থাকতো না তার মাথায়। দোষ নেই স্বীকার করতে আমি পছন্দ করতাম না ছেলেটাকে। তবে খুব ভালো গল্প বলতো তা শুনেছি আর দারুণ সৎ ছিলো বন্ধুত্বের ব্যাপারে। তখন সকলেই মেরিডিথকে বলতো ন্যাকা-বোকা অভিমানী ছেলে। সব সময়ে গাছপালা, লতাপাতা, প্রজাপতি, পাখি, পোকামাকড় নিয়ে পড়ে থাকতো, যাকে আজকাল বলে প্রকৃতি পাঠ। ওদের বাবার মনে ঐ ছোকরা দুটোর জন্যে কম দুঃখ ছিলো না। একটা ছেলেও তার মনের মতো হলো না, যারা মাথা ঘামায় শিকার করা মাছ ধরা নিয়ে। মেরিডিথ পশু পাখি শিকার করার বদলে ভালোবাসতো ওদের পর্যবেক্ষণ করতে। আর গ্রাম ছেড়ে তো ফিলিপ চলো গেলো শহরে, অর্থ উপার্জন করতে হবে তার নেশা। সৈন্যবাহিনীর এক অস্থায়ী অফিসারের সঙ্গে ডায়নার বিয়ে হলো। আদৌ ভদ্রলোক লোকটা ছিলো না। এদিকে অ্যামিয়াস প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা অপরূপ সুন্দর দেখতে এতো জিনিস থাকতে পৃথিবীতে কেন যে নেশায় পড়লো ছবি আঁকার, কে পারে বলতে। এইসব কারণেই বোধহয় দুঃখে মারা যান রিচার্ড ক্রেল।
তারপর ক্যারোলিন স্পলডিংকে এক সময়ে বিয়ে করলো অ্যামিয়াস। সব সময়েই ওদের ঝগড়াঝাটি লেগে থাকতো মন কষাকষি, তবে ঠিক ছিলো ভালোবাসার বাঁধনটা। দুজনের জন্য দুজনেই পাগল হয়ে থাকতো। এবং এইভাবেই চলতো ওরা। কিন্তু অ্যামিয়াসও ছিলো ক্রেল পরিবারের পুরুষদের মতো বেশি মাত্রায় অহংকারী। ভালোবাসতো ঠিকই ক্যারোলিনকে তবে ক্যারোলিনকে কোনোদিনই বুঝবার চেষ্টা করেনি। চলতো নিজের খেয়াল খুশি মতো। অ্যামিয়াস আর পাঁচটা মেয়েকে আমার মতে ভালোবাসতে পারতো, কিন্তু ছবি আঁকার চেয়ে কাউকেই বড় করে নয়। অ্যামিয়াসের প্রথম প্রেম ছিলো ছবি। এবং কখনোই বেশি প্রাধান্য কোনো মেয়েকে শিল্পের চেয়ে দেয়নি। ওর জন্যে যে সব মেয়েরা প্রেরণা জোগাতো অ্যামিয়াস তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তো কিন্তু ওটা ফুরোলেই তার তাদের ভুলে যেতে সময় লাগতো না বিন্দুমাত্র। ভাবপ্রবণ বা রোমান্টিকও খুব বেশি ছিলো না। আবার ভোগী যে শুধু ছিলো তাও নয়। তবে তারই মধ্যে কিছুটা টান ছিল স্ত্রীর প্রতি। ক্যারোলিন খানিকটা স্বামীর চরিত্রের দুর্বলতার দিকটা মেনেই নিয়েছিলো বলতে হবে। এটাও জানতো যে তার স্বামী এক অসাধারণ শিল্পী। তাই শ্রদ্ধাও করতো। মাঝে মাঝে হৃদয়গত ব্যাপারে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করতো তারপর ফিরে আসতো একসময় নেশা ছুটে গেলে এবং প্রায়ই সেই মেয়েটার ছবি নিয়ে ফিরে আসতো।
কারুর কিছু বলার থাকতো না এলসা গ্ৰীয়ারের ব্যাপারেও। কিন্তু এলসা গ্ৰীয়ার…মিঃ জোনাথন মাথা নাড়লেন হতাশ ভাবে।
মিঃ জোনাথন হঠাৎ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলেন, বেচারী আহা বেচারী…।
ওঃ তাহলে আপনার করুণা হয় মেয়েটির সম্বন্ধে?
হয়তো বুড়ো হয়ে গেছি বলেই হয়। তবে মঁসিয়ে পোয়ারো আমি দেখেছি আমার চোখ জলে ভরে ওঠে যৌবনের এই অসহায়ত্ব দেখে। আঘাত পায় কত অল্পেতে, আবার এই যৌবন কী ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। যতটা এর উদারতা, ততটা স্বার্থপরতাও। মিঃ জোনাথন কথাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। উল্টো দিকে কাঁচের আলমারী থেকে বই একটা পেড়ে এনে পড়তে শুরু করলেন একটা পাতা,