অবিশ্বাস্য! বিড় বিড় করলেন রবার্টস।
মোটেই না। মিসেস অলিভার বলে উঠলেন গোয়েন্দা গল্পে যে রকম ঘটে, যার ওপর কম সন্দেহ হয়, দেখা যায় সে-ই আসল খুনী। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
আচ্ছা মিসেস লরিমারের চিঠিটা নিশ্চয়ই জাল?রবার্টস ফিরে তাকলেন পোয়ায়োর দিকে।
নিঃসন্দেহে, তিনটে চিঠিই জাল।
তাহলে মিস মেরিডিথও নিজের নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন?
সেটাই স্বাভাবিক। নকলটাও খুব দক্ষতা নিয়ে করা হয়েছিল। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে ঠিকই ধরা পড়ল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামতের দরকার হত না, মিসেস লরিমার যে আত্মহত্যা করেছেন, পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো তাই বলে।
মসিয়ে পোয়ারো, মিসেস লরিমারের মৃত্যুটা যে আদৌ আত্মহত্যা নয়, একেবারে পরিকল্পনা করা খুন এটা আপনি সন্দেহ করলেন কিভাবে?
চেইন লেনে। তার বাড়িতে বৃদ্ধা কাজের লোকের সঙ্গে কথা বলে।
তাঁর কাছ থেকেই বোধহয় খবর পেয়েছিলেন, যে অ্যানা মেরিডিথ আগের দিন সন্ধ্যায় দেখা করতে আসেন মিসেস লরিমারের সঙ্গে?
হ্যাঁ, অন্যান্য খবরের সঙ্গে এটাও সে বলেছিল। তাছাড়া আসল খুনী কে, সে সম্বন্ধেও মনে মনে আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, মানে মিঃ শেটানের খুনী কে আমি জানতাম এবং তিনি মিসেস লরিমার নন, এও জানতাম।
মিস মেরিডিথকে আপনি সন্দেহ করলেন কেন? ডাঃ রবার্টস বললেন।
ধৈর্য্য ধরুন। ডাক্তার রবার্টসকে বাধা দিলেন পোয়ারো।
সবটাই বলব আমি। তবে আমার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এক এক করে বাছাই করে বলা। সেভাবেই বলব। মিসেস লরিমার খুন করেননি, মিঃ শেটানকে। মোরে ডেসপার্ডও তাকে খুন করেননি। শুনলে আরও অবাক হবেন এই খুনের পেছনে মিস মেরিডিথের কোন হাত ছিল না–
সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো, তার মৃদু কোমল কণ্ঠস্বর বাতাস ছুঁয়ে গেল। তাহলে বুঝতে পারছেন ডাক্তার রবার্টস, বাকি থাকেন আপনি। আপনিই মিঃ শেটানকে খুন করেছেন এবং মিসেস লরিমারকেও।
মিনিট তিনেক কারোর মুখেই কথা ফুটল না।
একটা চাপা অস্বস্তিকর নীরবতায় থমথম করছে সারা ঘর। হঠাৎ রবার্টস বীভৎস ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আপনি কি পাগল মঁসিয়ে পোয়ারো? মিঃ শেটানকে আমি খুন করিনি আর মিসেস লরিমারকে খুন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। মিঃ ব্যাটেল এসব আজগুবি কথা শুনবার জন্যই আমাকে ডেকে এনেছেন?
মঁসিয়ে পোয়ারোর বক্তব্যটা শুনলেই আপনি ভাল করবেন ডাঃ রবার্টস। ব্যাটেলের শান্তস্বর ভেসে এল।
যদিও কিছুদিন আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে একমাত্র আপনার পক্ষেই মিঃ শেটানকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু আমার হাতে কোন সঠিক প্রমাণ ছিল না। কিন্তু পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রবার্টসের দিকে। কিন্তু মিসেস লরিমারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে আপনি প্রত্যক্ষদর্শী থেকে জানা গেছে যে আদালতে দাঁড়িয়ে আপনার অপকীর্তির সাক্ষ্য দিতে পারবে।
রবার্টসের হাবভাব ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো, চোখের দৃষ্টিতে একটা উজ্জ্বল চকচকে আভা। আপনি আবোল তাবোল বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
একটুও ভুল নয়। আজ ভোরে আপনি ঝিয়ের কাছে বাজে ভাওতা দিয়ে মিসেস লরিমারের শোবার ঘরে ঢুকলেন–গত রাত্রে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে মিসেস লরিমার তখন গভীর ঘুমে অচেতন। আপনি আবার বৃদ্ধা ঝিকে ভাওতার দিয়ে বললেন, মিসেস লরিমার খুব সম্ভবত মারা গেছেন তবুও একবার শেষ চেষ্টা করবেন আপনি। এজন্য তাকে ব্রাণ্ডি আর গরম জল আনতে পাঠান, ঘরে কেউ ছিল না। ঝি একবার মাত্র উঁকি দিয়ে তার কর্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিল, তাই তিনি মৃত কি জীবিত এটা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আপনি হয়ত জানেন না ডাক্তার রবার্টস সেই ভোরে জানালায় জমে থাকা বরফ পরিস্কার করতে একজন উইণ্ডো-ক্লীনার্স মিসেস লরিমারের জানালার কাঁচ পরিস্কার করতে এসেছিল। ব্যাপারটা সেই দেখে, তার মুখ থেকেই শোনা যাক।
পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন-ভেতরে এসো স্টিফেন্স।
একটু পরেই শ্রমিক শ্রেণীর দশাসই চেহারার একজন লোক ঘরে ঢুকলো, ডান হাতে ধরা একটা ক্যাম্বিসের টুপি। তাতে গোল করে লেখা-চেলসী উইণ্ডো ক্লীনার্স অ্যাসোসিয়েশান।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঘরের মধ্যে কাউকে কি তুমি চিনতে পেরেছ?
লোকটা চারিদিকে তাকিয়ে দেখল তারপর ডাক্তারকে দেখিয়ে বলে উঠল, এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছি।
শেষ যখন তুমি এঁকে দেখ, কি করছিলেন তখন এই ভদ্রলোক?
আজ ভোরবেলা, তখন বোধহয় আটটাও বাজেনি, চেইন লেনে এক ভদ্রমহিলার ঘরের জানলায় জমে থাকা বরফ সাফ করছিলাম। এই ভদ্রলোক তখন ভদ্রমহিলার বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে সিরিঞ্জ দেখে ভেবেছিলাম বোধহয় ডাক্তার। ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়ে ছিলেন, খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে। ঘুমের ঘোরে একবার চোখ মেলে তাকালেন। এই ভদ্রলোক তখন ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা খুব দ্রুত ভদ্রমহিলার হাতে ফুঁড়ে দিলেন, ভদ্রমহিলা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন চোখ বুজে। আমি সেখানে আর অপেক্ষা না করে অন্য দিকে এগোলাম।
বাঃ অপূর্ব, অপূর্ব! পোয়ারো বলে উঠলেন, তাহলে ডাক্তার রবার্টস?
একটা সাধারণ-সাধারণ শক্তিবর্ধক ওষুধ তোতলাতে শুরু করলেন রবার্টস, তার জ্ঞান ফেরাবার জন্য
সাধারণ শক্তিবর্ধক? পোয়ারো তীব্র দৃষ্টিতে ডাক্তার রবার্টসের দিকে। এন-মিথাইল-সাইক্লো হেক্সানিল-ম্যালাথিন ইউরিয়া। যাকে বলে এভিপ্যান। ছোটখাটো অপারেশান-এর সময়ে সেই জায়গাটা অসাড় করতে লাগে। শিরার মধ্যে বেশি পরিমাণ এভিপ্যান ইনজেক্ট করলে সঙ্গে সঙ্গে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়তে বাধ্য। ভোয়রাম্যাল বা ঐ জাতীয় ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের পর এভিপ্যান প্রয়োগ প্রচণ্ড বিপজ্জনক। মিসেস লরিমারের হাতের ওপর আমি তো একটা ইনজেকশানের চিহ্ন দেখেছিলাম। পুলিশ সার্জেনকে ব্যাপারটা জানানোর পর তারা পরীক্ষা করে আমাকে এই তথ্য জানান।