- বইয়ের নামঃ প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী
প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস
১. অদ্ভুত পার্টি চলছিল
মিঃ শেটানের অদ্ভুত পার্টি চলছিল : ডিনার টেবিলে আলোচনা চলছে এখন?
বিষ-ই হল মহিলাদের প্রধান হাতিয়ার। মন্তব্য করে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন মিঃ শেটান, আপনারা কি বলেন? অবশ্য বলবারই বা কি আছে। কত মহিলা তো খুন করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
শেটানের কথায় সায় দিয়ে মিসে অলিভার বলেন, যা বলেছেন।
পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শেটানের দিকে তাকালেন। ডিনার টেবিলে প্রথম দিককার একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন শেটান। ঘরের নীলাভ আলোয় তার দু-চোখের ধূর্ত চাহনী যেন আরও ক্র হয়ে উঠেছে। শেটান কি উদ্দেশ্যে একের পর এক এ ধরনের মন্তব্য করে চলেছেন? পোয়ারো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পোয়ারো সহ আজ শেটানের নিমন্ত্রিতের সংখ্যা আটজন। পুলিশ সুপার ব্যাটেল, গোয়েন্দা গল্পের লেখিকা মিসেস অলিভার, সিক্রেট সার্ভিসের কর্নেল রেস এই তিনজনকে-ই পোয়ারো ভালভাবে চেনেন। কিন্তু বাকি চারজন? ডাঃ রবার্টস, মিসেস লরিমার, মিস মেরিডিথ এবং মেজর ডেসপার্ড এদের পরিচয় পোয়ারোর অজ্ঞাত।
পোয়ারোর মনে পড়ল, শেটান তাঁকে জীবন্ত অপরাধ প্রদর্শনী দেখতে আজকের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিসের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন তিনি? ডিনারের শেষে হঠাৎ খুনের বিভিন্ন পদ্ধতির কথা আলোচনার অর্থ-ই বা কি?
চারপাশে তাকিয়ে নিলেন শেটান। তার মুখে সূক্ষ্ম শয়তানী হাসি, তবে আমি বলব–কাউকে খুন করতে ডাক্তারদের জুড়ি নেই। সুযোগ সুবিধাও বেশি
শেটানের কথা শেষ হবার আগেই ডাঃ রবার্টস প্রতিবাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ আপনার ভুল ধারণা মিঃ শেটান। কখনো সখনো মানুষের মৃত্যুর কারণ আমরা ডাক্তাররা হই বটে তবে সে নিছক দুর্ঘটনা। মানুষ খুন? না না কক্ষনো না।
শেটানের পরবর্তী মতামতের অপেক্ষায় আগ্রহে বসে রইলেন পোয়ারো।
একটু পরেই–
আমি যদি ভাবি কাউকে খুন করব– থমথমে গলায় শেটান বললেন, তবে খুব সোজা পথেই এগোব। এই ধরুন শিকার করতে গিয়ে কাউকে মেরে বসা লোকে জানবে নিছক দুর্ঘটনা। অথবা কোন রুগীকে ভুল করে ওষুধের বদলে বিষাক্ত কিছু খাইয়ে দেওয়া- একটু চুপ করে আবার সকলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিলেন শেটান, তবে কথা হল এত অভিজ্ঞ লোক বর্তমান থাকতে আমি এসবে মতামত দেবার কে?
সমস্ত ঘর নিস্তব্ধ। পোয়ারো লক্ষ্য করলেন শেটানের মুখে সেই মৃদু শয়তানী হাসি।
.
ডিনারের পর ড্রয়িংরুমে জমায়েত হলেন সকলে। সেখানে ব্রীজ খেলার টেবিল পাতা। মিঃ শেটানের অনুরোধে চারজন তাস টেনে পার্টনার নির্বাচন করে ব্রীজ খেলতে বসলেন। এদের মধ্যে তাস খেলার সব থেকে দক্ষ মিসেস লরিমার–তার উৎসাহও বেশি। একদিকে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। টেবিলের অন্য দিকে মিসেস লরিমার এবং সুন্দরী মিস মেরিডিথ।
অন্য চারজনকে নিয়ে শেটান এলেন পাশের ঘরে। এ ঘরেও ব্রীজ খেলার বন্দোবস্ত হয়েছে। মিঃ শেটানের একান্ত অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলতে বসলেন সকলে। শোন নিজে খেলবেন না।
একটু বাদেই পাশের ঘরে পা বাড়ালেন তিনি। খেলা পুরোমাত্রায় জমে উঠেছে। ওয়ান হার্ট, পাস, থ্রি ক্লাবস, স্পেডস, ফোর ডায়মন্ডস, ডবল। ফোর হার্টস বিভিন্ন ডাকগুলো ভেসে এল শেটানের কানে। টেবিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, চারজনকে দেখছিলেন শেটান। ডাক্তার, মিসেস লরিমার, সুন্দরী মেরিডিথ, মেজর গভীর মনোযোগে খেলে চলেছেন। টেবিলের ঠিক ওপরে একটা শেড দেওয়া আলো জ্বলছে। ঘরের সবটা আলোকিত হয়নি। ছায়া ছায়া আলো আঁধারীর কারুকাজ। ফায়ার প্লেসের কাছাকাছি একটা ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন শেটান। মুখে মৃদু হাসি। আজ অফুরন্ত হাসির খোরাক পেয়েছেন তিনি।
মাত্র বারোটা দশ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস অলিভার। এ ঘরের ব্রীজ খেলা শেষ। তাস খেলতে আর কেউ-ই উৎসাহী নন। সবথেকে বেশি হেরেছেন মিসেস অলিভার।
চলুন মিঃ শেটানকে বলে আমরা বিদায় নিই। মিসেস অলিভার বললেন। পাশের ঘরে পা বাড়ালেন সবাই।
শেটানকে দেখা গেল ফায়ার প্লেসের পাশে চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন। এ ঘরের চারজন কিন্তু দারুণ উৎসাহে খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন তখনও। মিসেস অলিভার আর সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল খেলার টেবিলের দিকে পা বাড়ালেন। ফায়ার প্লেসের দিকে এগোলেন কর্নেল রেস।
আমরা এবার বিদায় নেব মিঃ শেটান। কোন জবাব এল না। কর্নেল রেস অবাক হলেন–শেটান যেন কেমন অদ্ভুত ভঙ্গীমায় ঘুমিয়ে আছেন–মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে সামনে। পোয়ারোর দিকে তাকালেন কর্নেল রেস। একটু এগিয়ে শেটানের কাছাকাছি হতে-ই একটা অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেল কর্নেলের মুখে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পোয়ারো চমকে উঠলেন শেটানের কোটের ফাঁকে একটা শক্ত জিনিস চকচক করছে।
শেটানের একটা হাত তুলে নিলেন পোয়ারো। আপন মনে মাথা নাড়লেন। ধীরে ধীরে শেটানের হাতটা নামিয়ে দিলেন তিনি।
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল একবার এদিকে আসুন।
কি ব্যাপার মঁসিয়ে পোয়ারো? ব্যাটেল ফায়ার প্লেসের কাছাকাছি এগিয়ে এলেন।
শেটানকে ইশারায় দেখালেন কর্নেল রেস। চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়লেন ব্যাটেল। একটু পরেই ব্যাটেল গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, দয়া করে সকলে এদিকে মনোযোগ দিন।
ব্রীজ টেবিলের সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালেন।
খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি, গৃহস্বামী মিঃ শেটান মারা গেছেন।
ঘরের মধ্যে প্রবল গুঞ্জন। হুড়মুড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন মিসেস লরিমার এবং ডাঃ রবার্টস। মেজর ডেসপার্ডের চোখে জিজ্ঞাসা। ফ্যাকাশে মুখে অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠলেন অ্যানা মেরিডিথ।
আপনি নিশ্চিত, মিঃ শেটান মারা গেছেন? প্রশ্ন করে এগোতে যাচ্ছিলেন রবার্টস, বাধা দিলেন ব্যাটেল, দাঁড়ান। আমার প্রশ্নের জবাব দিন–খেলার সময় এ ঘর ছেড়ে বাইরে কে কে গেছিলেন। আর ভেতরে কে এসেছিলেন?
মানে? রবার্টস ঘাবড়ে গেলেন, বাইরে যাওয়া, ভেতরে আসা–এরকম কিছুই হয়নি।
মিসেস বলছেন রবার্টস। মিসেস লরিমার সায় দিলেন। এমনকি খেলার আগেই খানসামা পানীয়ের ট্রে রেখে চলে গেছেন। আর আসেনি।
মেজর এবং মিস মেরিডথ ও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
বেশ। তবে ডিভিশানাল সার্জন না আসা অবধি শেটানের দেহ কেউ ছোঁবেন না। ডাক্তার রবার্টসের দিকে তাকিয়ে ব্যাটেল বললেন, ডাঃ রবার্টস আপনিও না। কারণ শেটান খুন হয়েছেন।
আতঙ্কে যেন শিউরে উঠলেন ঘরের সবাই। ব্যাটেল এ ঘরে উপস্থিত চারজন ব্রীজ খেলোয়াড়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিলেন। তাঁকে খুন করা হয়েছে–বুকে ছুরি বসিয়ে! একটু থেমে প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল, খেলার সময় টেবিল ছেড়ে আপনাদের ভেতর কে কে উঠেছিলেন? কয়েকমুহূর্ত সবাই চুপ করে রইলেন। একটু পরে খানিক ইতস্তত করে মেজর ডেসপার্ড বলেন, দেখুন আমার মনে হয় ঘরের প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় টেবিল ছেড়ে উঠেছেন। আমি নিজেই দু-বার উঠেছি। শেষবার আগুনটা উস্কে দেবার জন্য যখন ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি গেলাম মনে হল শেটান যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হতে পারে– ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, হয়তো ততক্ষণে মিঃ শেটান মারা গেছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। তবে এখন আপাতত আপনারা পাশের ঘরে যান। কর্নেল রেস সহ বাকি চারজন পাশের ঘরে চলে গেলেন। ব্যাটেল স্থানীয় পুলিশকে ফোন করলেন।
একটু পরেই ফোন নামিয়ে রাখলেন ব্যাটেল, ডিভিশনাল সার্জন, স্থানীয় পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। পোয়ারোর দিকে তাকলেন ব্যাটেল, খুনী কি সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে ভাবুন মঁসিয়ে পোয়ারো। শোন তো চেঁচিয়ে উঠতে পারতেন? আরো আশ্চর্য ঘরের এতগুলো লোক টের পেল না একটা খুন হচ্ছে?
খুব মরীয়া না হলে এতটা ঝুঁকি নিয়ে খুন করা সম্ভব হত না। পোয়ারো বিড়বিড় করলেন, আজকের পার্টির উদ্দেশ্য ………ঠিক তক্ষুনি বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। সম্ভবতঃ লোক্যাল পুলিশ এসেছে। এক মিনিট মঁসিয়ে পোয়ারো–ব্যাটেল দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
ডাইনিং টেবিলের চারদিকে চারজন বসে রয়েছেন। পোয়ারো মিসেস অলিভার, কর্নেল রেস এবং সুপারিনটেন্টে ব্যাটেল। এর মধ্যে এক ঘণ্টা কেটে গেছে। বিভিন্ন ছবি নেওয়া হয়েছে মৃতদেহের, ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞও এসে তার কাজ করে চলে গেছেন। ব্যাটেল তাকালেন পোয়ারোর দিকে, ওঘরের চারজনকে ডেকে জেরা করব। তার আগে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা আছে। আজকের ডিনার পার্টির সম্বন্ধে কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ। পার্টির আসল উদ্দেশ্যটা– শান্তকণ্ঠে বললেন পোয়ারো আমাকে মিঃ শেটান যা বলেছিলেন, পার্টিটা নাকি জীবন্ত অপরাধ প্রদর্শনী!
তার মানে! ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেন নি তো!
না। যতদূর মনে পড়ছে মিঃ শোন বলেছিলেন তার শখ খুন এবং খুন! তার মতে খুন হল একটা আর্ট–যে কাজে সফল হতে পারলে খুনীকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। ভদ্রলোকের সখ ছিল সফল খুনীরা অর্থাৎ যারা খুন করেও সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে পার পেয়ে গেছে এরকম খুনীদের সঙ্গে পরিচয় করা–
তাহলে তাদের নিয়েই এই জীবন্ত অপরাধ প্রদর্শনী? এদের দেখাতেই পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি? ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন।
সম্ভবত তাই। ভদ্রলোক চিরকাল সকলকে ভয় পাইয়ে মজা পেতেন। ফলটা কি হল–তিনি নিজে মারা পড়লেন।
তাহলে দাঁড়াচ্ছে নিমন্ত্রিত আটজন। তার মধ্যে চারজন দর্শক, বাকি চারজন হত্যাকারী। অন্ততঃ মিঃ শেটান এই ভাবতেন। প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল।
না, না, এরা সকলেই ভদ্রলোক। এর মধ্যে কেউই খুন করতে পারেন না। মিসেস অলিভার প্রতিবাদ করে ওঠেন।
তাই যদি হয়, তবে আমার সন্দেহ হয় ডাঃ রবার্টসকে! ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হবার সময়ই, মনে হয়েছিল কি একটা গলদ আছে। আমার অনুভূতি কখনো মিথ্যা হয় না। মিসেস অলিভারের কথায় বিশেষ মনোযোগ দিলেন না ব্যাটেল। পুরনো কথার খেই ধরেই আলোচনা চলতে লাগল।
হয়তো শোন আজকের পার্টিতে কয়েকজন খুনীকে নিমন্ত্রণ করে এনেছিলেন। মানে আমরা চারজন ছাড়া বাকি চারজনকে শেটান অন্ততঃ খুনী বলেই জানতেন। হয়তো সবক্ষেত্রে তাঁর অনুমান ঠিক নয়। কিন্তু শেটানের মৃত্যুই প্রমাণ করেছে অন্ততঃ একটা ক্ষেত্রে তার আন্দাজ সঠিক কি বলেন মিঃ পোয়ারো।
সেরকমই মনে হচ্ছে। খুনীর ভয় ছিল শেটানের হাতেই হয়তো তার অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ জমা আছে। সে ভেবেছিল তাকে নিয়ে খানিক মজা করে পুলিশের হাতে তুলে দেবে শেটান। আসলে যে কি ঘটেছিল আমরা তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না। মাথা দোলালেন পোয়ারো।
এবার তাহলে শুরু করি– সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল উঠে পড়লেন।
তাহলে আমরা বাইরে অপেক্ষা করি। কর্নেল রেস উঠে দাঁড়াতেই একটু ইতস্তত করে ব্যাটেল বাধা দিলেন, না, দরকার নেই। আপনারা সকলেই এ ঘরে থাকতে পারেন। কিন্তু কাজের মাঝখানে কেউ বাধা দেবেন না। আর এতক্ষণ যে বিষয়ে আলোচনা করলাম সে সম্বন্ধেও কোন কথা বলবেন না কেউ–ঠিক আছে?
মিসেস অলিভার মাথা নাড়লেন। পাশের ঘর থেকে ডাঃ রবার্টসকে ডেকে পাঠালেন ব্যাটেল।
একটু পরেই ডাঃ রবার্টস ঘরে এসে ঢুকলেন।
সত্যি কি সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি তো ভাবতেই পারছি না–মাত্র কয়েক হাত দূরে বসে তিন জন তাস খেলছে। এর মধ্যে খুন করে আসা–বাপরে, আমার অতো সাহস নেই বলুন সুপারিনটেন্ডেন্ট কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করব। ডাক্তার রবার্টস ক্ষীণ হাসলেন।
মোটিভ। মোটিভই হল আসল কথা–
তবে তো কোন কথাই নেই। মিঃ শেটানকে আমি ভাল করে চিনি না পর্যন্ত। একটু আধটু পরিচয় আছে। আমি তাকে খুন করতে যাব কেন? অবশ্য আপনারা তদন্ত করবেন নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ, আইনমাফিক কাজ তো করতেই হবে। আচ্ছা,.ডাঃ রবার্টস! ও ঘরের বাকি তিনজন সম্বন্ধে আপনার মতামত কি?
দুঃখিত। কিছুই বলতে পারব না। আজই তো আলাপ হল এদের সঙ্গে। একমাত্র মিসেস লরিমারকে আগে থাকতে চিনতাম। অবশ্য মেজর ডেসপার্ডের লেখা ভ্রমণ কাহিনী আগে পড়েছি।
আপনি জানতেন ডেসপার্ড-এর সঙ্গে শেটানের আলাপ আছে?
না। আজই প্রথম মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে পরিচয় হল আমার।
মিসেস লরিমারকে তো চিনতেন আপনি। তাঁর সম্পর্কে কি কিছু জানেন?
তেমন কিছু না। যতটুকু জানি, তিনি একজন বিধবা ভদ্রমহিলা। টাকাকড়ি ভালই আছে। বুদ্ধিমতী এবং ব্রীজ খেলায় এক্সপার্ট। তার সঙ্গে ব্রীজ খেলা উপলক্ষেই এক বন্ধুর বাড়িতে আমার আলাপ।
মিঃ শেটানের কাছে কখনো মিসেস লরিমারের নাম শোনেন নি।
না।
আচ্ছা। খুব ভাল করে ভেবে বলুন ডাক্তার রবার্টস, কবার আপনি খেলার টেবিল ছেড়ে উঠেছিলেন? বাকি তিনজন কবার উঠেছিল?
ডাক্তার রবার্টস কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন।
আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। অন্যদের কথা সঠিক বলতে পারব না। আমারটা বলতে পারি –যতদূর মনে পড়ছে মোট তিনবার উঠেছিলাম। সেই তিনবারই ডামি ছিলাম আমি। প্রথমবার উঠে ফায়ার প্লেসের আগুন উস্কে দিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার একজন মহিলার জন্য জল আনতে। আর শেষবার আমার নিজের জন্য পানীয় আনতে উঠেছিলাম।
সময়ের একটা আন্দাজ দিন
মোটামুটি সময়টা বলতে পারি। প্রায় সাড়ে-নটার সময় আমরা খেলতে বসি। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি ফায়ার প্লেসের কাছে যাই। মিনিট দুই-তিন বাদে জল আনতে উঠি, শেষবার উঠি তখন রাত সাড়ে এগারোটা হবে। ঘড়ি তো দেখিনি, ভুলও হতে পারে।
পানীয়র ট্রে তো মিঃ শেটানের চেয়ারের পাশের টেবিলে ছিল।
হ্যাঁ। মোট তিনবারই আমি তার চেয়ারের পাশ দিয়ে গেছি।
প্রত্যেকবারই কি তাকে আপনার ঘুমন্ত মনে হয়েছিল?
প্রথমবার সেইরকমই মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়বার তাসের কথা ভাবছিলাম ততটা খেয়াল করিনি। শেষবার তার পাশ দিয়ে যাবার সময় ভাবলাম ভদ্রলোক এত ঘুমুতেও পারেন। কোনবারই খুব একটা লক্ষ্য করিনি।
অন্যান্যরা কবার উঠেছিলেন? একটু চিন্তা করুন
বেশ কঠিন প্রশ্ন- খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন ডাক্তার রবার্টস।মেজর ডেসপার্ডকে দুবার উঠতে দেখেছিলাম, মনে পড়ছে। একবার বোধহয় অ্যাসট্রে আনতে আর দ্বিতীয়বার পানীয় জল আনতে গিয়েছিলেন।
আর মহিলারা? ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন।
মিসেস লরিমার একবার ফায়ারপ্লেসের কাছে বোধহয় আগুনটা উস্কাতে গিয়েছিলেন, কি যেন কথাও বললেন শেটানের সঙ্গে। আর মিস মেরিডিথ যখন আমার পার্টনার ছিলেন তখন একবার উঠেছিলেন তাস দেখতে। প্রথমটায় আমার তাস উঁকি মেরে দেখলেন। তারপর অন্যদের তাস দেখবার পর বোধহয় পায়চারী করছিলেন ঘরের মধ্যে। আসলে তখন তাস নিয়ে এত ব্যস্ত ওদিকে মাথা ঘামাতে পারিনি।
ব্যাটেল একটু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাস খেলার সময় আপনাদের কেউ কি ফায়ারপ্লেসের দিকে মুখ করে বসেছিলেন?
না, সবার চেয়ারই একটু কোনাকুনিভাবে ঘোরানো ছিল। তাছাড়া মাঝখানে একটা মেহগনী কাঠের আলমারী থাকায় আড়াল পড়ে যায়। খুন একটা কঠিন হয় নি। কারণ খেলাটা যখন ব্রীজ তখন সকলের মনোযোগ ওইদিকেই থাকতে বাধ্য, একমাত্র ডামিই খুনটা করতে পারে–
ডামিই খুন করেছে কোন সন্দেহ নেই। যেই খুন করুক, মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে। অন্যদের দিকে একঝলক তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল, ডাঃ রবার্টস, এই তিনজনের মধ্যে আপনার কাকে খুনী বলে সন্দেহ হয়?
আমার মতামত চাইছেন? একটু থতমত খেয়ে যান ডাঃ রবার্টস, দেখুন আমার তো মনে হয় খুনী মেজর ডেসপার্ড। আজীবন বিপজ্জনক পরিবেশে কাটানোয় ভদ্রলোকের নার্ভ বেশ স্ট্রং, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতেও পারেন। এরকম ঝুঁকি নেওয়া তার পক্ষেই সম্ভব। মেয়েদের এরকম খুন করার দৈহিক বা মানসিক শক্তি কোনটাই নেই।
নাঃ, এ ব্যাপারে বিশেষ গায়ের জোর লাগেনি, দেখুন না এটা একটা পাতলা লম্বা ছোরা বের করে ধরলেন ব্যাটেল। যেটার হাতলে চুনিপান্না বসানো। ফলাটা আলোয় ঝকঝক করে উঠল।
আলগাভাবে ছোরার ডগায় একবার হাত ঠেকালেন ডাঃ রবার্টস, কি সাংঘাতিক! একটু ঠেকালেই একেবারে মাখনের মত ঢুকে যাবে বুকে। খুনী এটা তাহলে সঙ্গে করেই। নিয়ে এসেছিল, কি বলেন?
না। এটা মিঃ শেটানের, দরজার পাশেই টেবিলের ওপর অনেক পুরানো জিনিসপত্রের সঙ্গে ছিল।
খুনীই তাহলে খুঁজে বার করেছে এটা—
এমন তো হতে পারে খুনী এটা দেখার পরই মতলব এঁটেছে?
অসম্ভব নয়, হতে পারে।
যাকগে, আপনাকে আর আটকাব না। যাবার আগে ঠিকানাটা বলে যান। দু-চার দিনের মধ্যে হয়তো যেতে হবে
নিশ্চয়ই যাবেন, তবে দেখবেন এ নিয়ে যেন কাগজে বেশি লেখালেখি না হয়। বুঝতেই পারছেন, রুগীরা নার্ভাস হয়ে পড়বে
ব্যাটেল ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি কোন প্রশ্ন করবেন?
হ্যাঁ, পোয়ারো মাথা দুলালেন, আমি খেলাটা সম্বন্ধেই কিছু জিজ্ঞাসা করব। আপনারা কটা রাবার খেলেছিলেন ডাঃ রবার্টস?
তিনটে। চতুর্থটা শেষ হবার আগেই আপনারা এসেছিলেন।
খেলাটার বিবরণ দিতে পারেন?
হ্যাঁ, প্রথম রবারে আমি আর মেজর ডেসপার্ড জুটি ছিলাম। মেয়েদের কাছে হারলাম আমরা। দ্বিতীয়বার মিস মেরিডিথ আর আমি খেলেছিলাম, মিসেস লরিমার আর মেজর ডেসপার্ডের বিপক্ষে। তৃতীয়বার আমার পার্টনার ছিলেন মিসেস লরিমার, চতুর্থবার মিস মেরিডিথ। প্রত্যেকবারেই তাস টেনে পার্টনার বেছে নেওয়া হয়েছে।
হার-জিৎ?
প্রত্যেকবারই মিসেস লরিমার জিতেছেন। মিস মেরিডিথ জিতেছেন কেবল প্রথমবার। সবমিলিয়ে আমার কিছু জিত হয়েছে। মিস মেরিডিথ আর ডেসপার্ডই বেশি হেরেছেন।
ডাঃ রবার্টস, আপনাকে একটা অন্য প্রশ্ন করছি। পোয়ারো মৃদু হাসলেন, আপনি ছাড়া বাকি তিনজন কেমন ব্রীজ খেলেন?
মিসেস লরিমার ব্রীজ খেলায় এক্সপার্ট। ব্রীজ খেলে ভালই পয়সা রোজগার করেন মনে হয়। ডেসপার্ড খুব একটা ঝুঁকি নেন না, তবে খেলেন ভালই। মিস মেরিডিথ খুবই সাদামাটা খেলেন, তবে ভুল করেন কম।
আর আপনি?
হাসলেন ডাঃ রবার্টস। অনেকেই ভাবে আমি হাতের তাসের তুলনায় বেশি বেশি ডাক দিই, হয়তো তাই। কিন্তু তাতে আমার খুব একটা ক্ষতি হয় না বরং লাভই হয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রবার্টস, আর কিছু জিজ্ঞাসার নেই তো?
মাথা নাড়লেন পোয়ারো। শুভরাত্রি জানিয়ে ডাঃ রবার্টস বিদায় নিলেন।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। এর মধ্যে বাকি সকলের জেরা শেষ। মিসেস লারিমার, মিস মেরিডিথ ও মেজর ডেসপার্ড বিদায় নিয়েছেন। সকলকেই মোটামুটি একই ধরনের প্রশ্ন করছিলনে ব্যাটেল। উত্তরে যা জানা গেল?
মিসেস লরিমার : ব্রীজ খেলতে ভালবাসেন। মিঃ শেটানের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয় মিশরের এক হোটেলে। শেটানের সম্পর্কে তার ধারণা খুব উঁচু ধরনের নয়, ভালভাবে তাকে চেনেনও না। শেটানের মৃত্যুতে তার কোন লাভ বা ক্ষতি নেই, যদিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে তিনি খুব একটা উৎসাহী নন। মেজর ডেসপার্ড ও মিস মেরিডিথের সঙ্গে আজকের পার্টিতেই তার প্রথম আলাপ। ডাঃ রবার্টসকে তিনি একজন নামকরা ডাক্তার হিসাবে চেনেন, কিন্তু রবার্টসের পেশেন্ট নন। ব্রীজ খেলা চলাকালীন তিনি একবার উঠে ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়েছিলেন, শেটানের সঙ্গে তাঁর কিছু কথাও হয়েছিল। ব্রীজ টেবিলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের গতিবিধি সম্পর্কে তিনি নতুন কিছু বলতে পারলেন না। যে ছোরা দিয়ে খুন করা হয়েছে সেটা তিনি আগে কখনও দেখেন নি। কাউকে খুনী হিসাবে মতামত দিতে নারাজ। এসময় তিনি একটু রেগে গিয়েছিলেন। অবশ্য ব্রীজ খেলোয়াড় হিসাবে অন্যান্যরা কেমন এ প্রশ্নে তিনি কোন আপত্তি করেন নি। তাঁর মতে, ডেসপার্ড বেশ হিসেব করে খেলেন, ডাক্তার রবার্টস একটু বেশি বেশি ডাক দেন। মিস মেরিডিথ খুব সাবধানী।
মিস মেরিডিথ : সুন্দরী, অল্পবয়সী তরুণী মিস মেরিডিথ থাকেন ওয়ালিংফোর্ডে। এমনিতেই অতিরিক্ত নার্ভাস, মিঃ শেটানের মৃত্যুতে খুব ভয় পেয়েছেন। শেটানের সঙ্গে তার আলাপ সুইজারল্যান্ডে। মাঝে মধ্যে শেটানের পার্টিতে এসেছেন। ভদ্রলোককে দেখে তাঁর সবসময়ই ভয় করত যদিও সেরকম কোন কারণ নেই। আজকের পার্টির কাউকেই তিনি চিনতেন না, আজই আলাপ হয়েছে সবার সাথে। ব্রীজ টেবিল ছেড়ে তিনি কবার উঠেছিলেন, কি করেছিলেন কিছুই সঠিকভাবে বলতে পারলেন না। মিসেস লরিমারকে তার খুনের ব্যাপারে সন্দেহ হয়। ছোরাটা দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা বকতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত এটুকুই বলতে পারলেন যে শেটানের মৃত্যুতে তার কোন স্বার্থ নেই। অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে পড়বার জন্য তাকে বিশেষ প্রশ্ন না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
মেজর ডেসপার্ড : বনে জঙ্গলে বহুদিন কাটিয়েছেন। পার্টির জাঁকজমক, সামাজিকতা ভালবাসেন না বরঞ্চ বনে জঙ্গলের উন্মুক্ত পরিবেশ তাকে বেশি মুগ্ধ করে। শেটানের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ এক বন্ধুর পার্টিতে। মেজর ডেসপার্ড খুব অপছন্দ করতেন শেটানকে। ভদ্রলোকের আচার, আচরণ, পোষাক সবই তার অসহ্য বলে মনে হত। খুন করা হয়েছে যে ছোরা দিয়ে সেটা আগে কখনো দেখেন নি। ব্রীজ টেবিল ছেড়ে তিনি দুবার উঠেছিলেন, প্রথমবার একটা অ্যাশট্রের জন্য, দ্বিতীয়বার পানীয় আনতে। ডাক্তার রবার্টসকে তিনি খুনী বলে সন্দেহ করেন। ব্রীজ খেলোয়াড় হিসাবে অন্যান্য সকলের সম্পর্কে তার মত–মিস মেরিডিথ ভাল খেলেন, ডাক্তার রবার্টস অতিরিক্ত ডাক দেন, মিসেস লরিমার সব থেকে দক্ষ। মেজর ডেসপার্ড প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরই সাবলীলভাবে দিয়েছেন।
প্রত্যেকেই তাদের ঠিকানা দিয়ে বিদায় নেন।
আচ্ছা মিঃ পোয়ারো, আপনি তখন থেকে ওই স্কোরশীটগুলোতে কি দেখছেন? ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে তাকালেন। তখন দেখলাম মিসেস লরিমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন স্কোরটা কার লেখা?
দেখছিলাম এদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যগুলো। প্রথমটা দেখুন, স্কোর লেখেন মিস মেরিডিথ। প্রথম রাবারে মিসেস লরিমারের পার্টনার ছিলেন মেরিডিথ। ভালো তাস তুলেছিলেন মিসেস লরিমার, তাই জিত তাদেরই হয়েছে। কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে খেলা। ক্ষুদে ক্ষুদে অথচ স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, যোগবিয়োগগুলো খুব সতর্কভাবে করা হয়েছে।
দ্বিতীয়টা কার?
মেজর ডেসপার্ডের লেখা,–খেলা অবশ্য ঠিক কিরকম হয়েছিল বোঝা যাচ্ছে না তবুও এ থেকে মেজর ডেসপার্ডের চরিত্রের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে ভদ্রলোক একনজরে নিজের চারপাশ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে চান, ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরগুলোও একটা বৈশিষ্ট্য আছে।
আর তৃতীয়টা বোধহয় মিসেস লরিমারের!
হ্যাঁ, তিনি তখন ডাক্তার রবার্টসের পার্টনার। খেলাটা বেশ জমেছিল। বোঝা যাচ্ছে, দুদিকের লম্বা যোগবিয়োগের সারি। মিসেস লরিমারের হাতের লেখারও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সুন্দর দৃঢ়।
এই অসমাপ্ত স্কোরশীটটা?
এটা ডাক্তার রবার্টসের লেখা। পার্টনার ছিলেন মিসেস মেরিডিথ একটু ভীতু স্বভাবের, কম কম ডাক দেন। খেলাটাও খুব একটা জমেনি। রবার্টসের হাতের লেখা সুন্দর না হলেও পড়া যায়। সমস্ত স্কোরটায় কেমন একঘেয়ে একটা ভাব রয়েছে।
কিছু বুঝতে পারলেন এর থেকে?
একটা ধোঁয়াটে ছায়া, বিশেষ কিছু না।
সম্ভাবনার দিক থেকে দেখতে গেলে, আমার যা মনে হয়, প্রথম সন্দেহ হবে ডাঃ রবার্টসের ওপর। ভদ্রলোক ডাক্তার, বুকের ঠিক কোথায় ছোরা বসালে সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত মৃত্যু, খুব ভালভাবেই তা জানেন। অবশ্য এছাড়া আর কোন কারণ দেখা যাচ্ছে না। তারপর, আসছেন মেজর ডেসপার্ড। বিপজ্জনক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ। নার্ভ খুব শক্ত, চটপট সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একেও সন্দেহ হয়। অবশ্য মেয়েদের সন্দেহ না করার কোন কারণ নেই।
মিসেস লরিমারকেই ধরুন না, বেশ শক্ত নার্ভের মহিলা, তার হাবভাব। দেখলে বোঝা যায় কোন মানসিক অশান্তি আছে, গোপন রহস্যও থাকতে পারে। আবার অন্যদিক থেকে ভাবতে গেলে তিনি খুন করতেই পারেন না। একজন আদর্শবাদী হেডমিস্ট্রেসের মতই মনে হয় তাকে। সুতরাং কারো বুকে ছোরা বসাচ্ছেন ভাবাও যায় না। বাকি থাকল মিস মেরিডিথ, সুন্দরী তরুনী, একটু লাজুক লাজুক ভাব, ভীতু। তার সম্বন্ধে কিছুই আমরা জানি না–
কিন্তু মি. শেটানের বিশ্বাস ছিল মেয়েটি কাউকে খুন করেছে। পোয়ারো শান্ত কণ্ঠস্বরে বললেন।
আমার বিশ্বাস ঐ মেয়েটাই খুনী। ভাগ্যিস এটা কোন গল্প নয়। পাঠকেরা আবার সুন্দরী মেয়েদের খুনী বানালে অসন্তুষ্ট হয়। এক্ষেত্রে আমার স্থির বিশ্বাস হয় ঐ ডাক্তার নয় ঐ মিস মেরিডিথ। কোন সন্দেহ নেই। মিসেস অলিভার মতামত দেন।
এদের চারজনের একজন তো খুনী নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা কে? ব্যাটেল চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
এতক্ষণ ধরে যে কথাগুলো বললাম তার তো কোন মূল্যই দিচ্ছেন না আপনারা। মি. পোয়ারো আপনি কি বলেন? মিসেস অলিভার তাকালেন পোয়ারোর দিকে।
আমি? আমি এইমাত্র একটা নতুন সূত্র আবিষ্কার করলাম।
নিশ্চয়ই আপনার ঐ স্কোরশিটটা থেকে, কি যে অত দেখছেন–
ঠিকই ধরেছেন, মিস মেরিডিথের স্কোরশিট থেকে। স্কোরশিটের পেছনে হারজিতের হিসেব করেছেন মিস মেরিডিথ।
এর থেকে কি প্রমাণ হয়?
প্রমাণ কিছুই নয়, একটা বৈশিষ্ট্য বোঝা যাচ্ছে, মিস মেরিডিথ গরিব ঘরের মেয়ে অথবা বেশ হিসেবী।
সাজপোষাকের ঘটা দেখলে তো মনে হয় না সেকথা। মিসেস অলিভার বললেন।
আমরা কিন্তু মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি। কর্নেল রেস একটু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। এর চাইতে সন্দেহজনকদের অতীত সম্বন্ধে খোঁজখবর করলে লাভ হত।
ব্যাটেল মৃদু হাসলেন, নিশ্চয়ই, সে বিষয়ে তো খোঁজখবর করা হবে–আমরাই করব, তবে আপনারও সাহায্য চাই–ডেসপার্ডের ব্যাপারে খবর দরকার।
আমার মাথায় একটা দারুণ মতলব এসেছে। মিসেস অলিভার খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলেন এখানে আমরা চারজন উপস্থিত আছি। সবাই গোয়েন্দা বিভাগের কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত। আর ওঁরাও সংখ্যায় চারজন। আমরা প্রত্যেকেই যদি এক একজনের ওপর নজর রাখি কেমন হয়? ধরুন কর্নেল রেস, খবরাখবর নিলেন মেজর ডেসপার্ডের। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল নেবেন ডাক্তার রবার্টসের। মিসেস লরিমারের খোঁজখবর নিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি না হয় মেরিডিথকে দেখবো। আমরা আমাদের নিজেদের পদ্ধতিতেই কাজ চালাব।
ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, না, তা হয় না। এসব হল সরকারি ব্যাপার, আইনের প্রশ্ন থেকে যায়। আমার ওপর এখন দায়িত্ব দেওয়া আছে তদন্ত চালাতে হবে আমাকেই। তাছাড়া কর্নেল রেস হয়ত ডেসপার্ডকে খুনী মনে করেন না। পোয়ারো হয়ত মনে করেন মিসেস লরিমার নির্দোষ। এ নিয়ে একটা মিথ্যে গোলমালের সৃষ্টি করার দরকার কি?
হয় না, তাই না, কিন্তু প্ল্যানটা অলিভার হতাশ হয়ে পড়লেন, আচ্ছা আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে কোন অনুসন্ধান চালাই আপনার আপত্তি আছে?
না। আপনি পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন, আপনার কৌতূহল মেটাতে যেভাবে খুশি অনুসন্ধান চালাতে পারেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার আপত্তির কি আছে? তবে এইসব খুনের মামলায় মাথা না ঘামানোই ভাল।
আপনাকে এমন একজনের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে, যে এরমধ্যেই দুটো খুন করেছে। প্রয়োজন হলে তৃতীয় খুন করতেও তার হাত কাঁপবে না। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
আমাকে সাবধান করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এ রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ছি না। আমরা যে সমস্ত খবর জোগাড় করব সবই সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলকে জানিয়ে দেব। অবশ্য সমস্ত ঘটনা থেকে আমার সিদ্ধান্ত কাউকে জানাব না।
কর্নেল রেস উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক আছে। ফের ডেসপার্ড-এর খবর দু চারদিনের মধ্যে এনে দেব।
আমি ঠিক কি ধরনের খবর চাইছি বুঝতে পারছেন তো?
বুঝতে পেরেছি। কোন শিকার দুর্ঘটনা বা ওই জাতীয় কিছুর সঙ্গে ভদ্রলোক জড়িত ছিলেন কিনা, এই তো?
মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। কর্নেল রেস সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
মিসেস অলিভার জিজ্ঞাসা করলেন, ভদ্রলোক কে বলুন তো?
সেনা বিভাগের একজন বড় অফিসার। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ঘুরে এসেছেন।
তাহলে ঠিকই ভেবেছিলাম। ভদ্রলোক সিক্রেট সার্ভিসের অফিসার। মিসেস অলিভার মৃদু হাসলেন তাই তো, তা না হলে মিঃ শেটানই বা কেন ওকে ডিনারে ডাকবেন। চারজন খুনি, চারজন গোয়েন্দা। একজন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের, একজন সিক্রেট সার্ভিসের, একজন বেসরকারী আর বাকি রইলাম আমি–কাল্পনিক রহস্য উপন্যাসের–বাঃ! প্ল্যানটা ভালই করেছিলেন শেটান।
ব্যাটেল হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনার কি মনে হয় মিঃ পোয়ারো, কোন পথে এগোলে রহস্যের হদিশ মিলবে?
মনস্তত্বই হচ্ছে আসল। আজ রাতের ডিনার পার্টির অতিথিদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা কিছু কিছু জানি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, লক্ষ্য করেছি এদের প্রত্যেকের ব্রীজ খেলার ধরন, হাতের লেখা, স্কোর রাখার ধরন–এ সমস্ত থেকেই এদের মনস্তত্ব কিছুটা আন্দাজ করা যায়। তবে এই খুনের একটা ব্যাপার আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, খুনির মনের জোর অসাধারণ। অহঙ্কার খুব বেশি।
আপনি তো এদের চারজনের ব্রীজ খেলার ধরন নিয়ে খুব ভাবনা চিন্তা করছিলেন।
হ্যাঁ, কিন্তু সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। সুতরাং ওদিকে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা আছে–অতীত। অতীতের গোপন আবরণ খসে গেলেই পাব সত্যের সন্ধান। মিঃ শেটানের বিশ্বাস ছিল এরা প্রত্যেকেই খুনি। তিনি কি কোন প্রমাণ পেয়েছিলেন, না সবটাই তার কল্পনা? আজ এসব কিছুই জানা যাবে না।
চারজনই খুনি আর তার প্রমাণ শেটানের হাত মজুত ছিল, এ আমার বিশ্বাস হয় না। ব্যাটেল মাথা নাড়লেন।
হতে পারে। হয়ত কাউকে তিনি খুনি বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু প্রমাণ ছিল না। তখন গল্প করতে করতে অতিথিদের কাছে বিশেষ ধরণের সেই খুনের পদ্ধতির কথা বললেন। কেউ হয়ত গম্ভীর হয়ে উঠল, কারোর চোখের পলক পড়ল না বা কেউ কথা ঘোরাতে চেষ্টা করল–সবই তিনি লক্ষ্য করলেন। এ ভাবে উদ্দেশ্য বিহীনভাবে ছুঁড়ে দেওয়া কথাতে আসল অপরাধী মনে মনে অস্থির হয়ে পড়বে। একটা বা দুটো ক্ষেত্রে শেটানকে এরকম চালাকি করতে হয়েছিল। অন্য ক্ষেত্রে হয়ত তার হাতে প্রমাণ ছিল। তবে পুলিসে ধরিয়ে দেবার মত অত জোরালো প্রমাণ হয়তো ছিল না।
খুবই গোলমেলে ব্যাপার। একটাই মাত্র পথ–এদের চারজনের অতীত জীবনের খোঁজখবর চালান। অতীত হাতড়ে বার করা-এদের কেউ কোন অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত কিনা। ডিনার টেবিলে মিঃ শেটান বলেছিলেন মনে আছে মিঃ পোয়ারো।
হ্যাঁ। বলেছিলেন ডাক্তারদের পক্ষে খুন করার সুযোগ সুবিধা বেশি, আবার শিকার করতে গিয়ে ভুল করেও কেউ খুন করতে পারে–দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই কেউ ভাবত না। কিন্তু এসব বলে নিজের বিপদকেই ডেকে এনেছিলেন শেটান।
তবে কেবলমাত্র এসব কথার ওপর ভিত্তি করে চারজনের অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা–
একজন হয়তো নির্দোষ হতে পারে। শেটানের ভুলও হতে পারে।
একজন নির্দোষ? চিন্তিত হয়ে পড়লেন ব্যাটেল। ব্যাপার দেখছি আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে। ধরুন, জানালাম কেউ ছোটবেলায় ঠাকুমাকে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে খুন করেছে–তাতে কি লাভ হবে আমাদের?
কিছু যে লাভ নেই একথা আপনি বলতে পারবেন না। এক্ষেত্রে খুনি হয়ত তার পুরোন পদ্ধতিকেই কাজে লাগিয়েছে। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
তা অবশ্য ঠিক। হয়ত একইভাবে দ্বিতীয় খুনটা করেনি, কিন্তু কোথাও একটা যোগাযোগ দুটো খুনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
ধরুন মি. শেটানকে কেউই খুন করেনি। তিনি প্ল্যান করে ঐ চারজনকে ডেকে এনে মজা দেখবার জন্য আত্মহত্যা করলেন। হতেও তো পারে।
মিসেস অলিভার বলে উঠলেন–আপনার কল্পনা শক্তি আছে। কিন্তু মি. শেটান আত্মহত্যা করার লোক ছিলেন না। মৃদু হাসলেন পেয়ারো, মিঃ শোন মোটেই ভাল লোক ছিলেন না, এটা মানতেই হবে। মিসেস অলিভার মাথা নাড়লেন।
ঠিক কথা। কিন্তু এ রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ছি না। এর জন্যে বাঘের খাঁচার মধ্যে যেতেও আমি রাজি। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমি যাবোই।
ব্যাপারটা নিয়ে কাগজে যে বেশি লেখালেখি হয়নি, এটাই বাঁচোয়া, ডাঃ রবার্টস বললেন।
হ্যাঁ, মিঃ শেটান হঠাৎ মারা গেছেন। এটুকুই লেখা হয়েছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। একটু আগেই ব্যাটেল এসেছেন ডাঃ রবার্টসের চেম্বারে। ডাঃ রবার্টসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার।
ভদ্রলোকের সলিসিটরের সঙ্গে তাঁর উইল নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। দানপত্রে এক ভদ্রলোকের নাম আছে–সিরিয়ায় থাকেন। মনে হয় শেটানের আত্মীয়। এছাড়া শেটানের ব্যক্তিগত কাগজপত্রও ঘাঁটাঘাঁটি করেছি।
চকিতে ডাক্তার রবার্টসের মুখের ওপর একটা কালো ছায়া পড়ল। ব্যাটেলের নজর এড়ায়নি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ব্যাটেল। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
ডাক্তার রবার্টস সহজ হয়ে উঠলেন আমার কাগজপত্রও নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবেন? সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন?
না।
তবুও বাধা দেব না। আপনি সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমাকে এক্ষুনি কলে বেরোতে হবে। আলমারি, ড্রয়ারের সব চাবি রেখে যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আমার সেক্রেটারিও আপনাকে সাহায্য করবে।
যাবার আগে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করব আপনাকে। আপনার জন্ম, বিবাহ এইসব।
রবার্টস সোজা হয়ে বসলেন। ছোটবেলায় মোভিউ হোটেলে থেকে পড়াশোনা করতাম। বাবা ছিলেন একটা ছোট মফস্বল শহরের ডাক্তার। আমার যখন পনের বছর বয়স, প্রথমে বাবা মারা যান, তার দু বছর বাদে মা গেলেন। বাবার দেখাদেখি মেডিক্যাল লাইনই বেছে নিলাম।
অন্যান্য ভাইবোন?
কেউ নেই। আমিই একমাত্র সন্তান। এখনও অবিবাহিত। পাশ করার পর এখানে ডাক্তার এমারির সঙ্গে পার্টনারশিপে চেম্বারে রুগী দেখতাম। বছর পনের আগে এমারি অবসর নিয়ে আয়ার্ল্যান্ডে চলে যান। ডায়রীতে তার ঠিকানা পাবেন। চাকরবাকরেরা আমার কোয়ার্টারেই থাকে–একজন বেয়ারা একজন বাবুর্চি আর এক বুড়ি ঝি। চেম্বারে আমার সেক্রেটারী মিস বার্জেস আমাকে সাহায্য করেন, সকাল আটটার মধ্যে চলে আসেন। ডাক্তারীতে আমার আয় বেশ ভালোই। রুগীরা বেশ অবস্থাপন্ন। খুব একটা গোলমেলে রোগ না হলে তারা কেউই সাধারণতঃ মারা যায় না। এই হলো আমার ইতিহাস।
ঠিক আছে। আপনাকে চেনেন এমন চারজন ভদ্রলোকের ঠিকানা দিন, এ শহরের বাসিন্দা হলেই ভাল হয়।
ডাক্তার রবার্টস প্যাডের উপর চারজনের নাম ঠিকানা লিখে দিলেন, প্রত্যেকেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের।
তাহলে আমি চলি। আমার চাবির গোছা রইল। সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি মিস বার্জেসকে বলে যাচ্ছি তিনি যেন আপনাকে সাহায্য করেন। পাশের ঘরেই আছেন–প্রয়োজন হলে ডেকে নেবেন মিস বার্জেসকে।
ডাক্তার রবার্টস পাশের ঘরে সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ব্যাটেল কাজে লেগে পড়লেন। এখানে তেমন কিছু খুঁজে পাবেন বলে মনে হয় না। রবার্টস তাকে সব কিছু পরীক্ষা করবার অনুমতি দিয়ে গেলেন। তিনি নিশ্চয়ই বোকা নন। আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন পুলিশ আসবে, তাই যা ব্যবস্থা করার করে রেখেছেন। তবু ব্যাটেলের মনে হল কিছু পেলেও পেতে পারেন।
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল প্রথমে ড্রয়ারগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, ব্যাঙ্কের পাশবইটাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, রুগীর নাম ধাম লেখা খাতাটা পরীক্ষা করলেন। বিষের আলমারীটা পরীক্ষা করেও নিরাশ হলেন। চিঠিপত্রের ফাইলেও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না। যা খুঁজছিলেন তা পেলেন না ব্যাটেল। একটু হতাশা হয়ে পড়লেন। বেল টিপে ডাকলেন মিস বার্জেসকে।
মিস বার্জেস এসে দাঁড়াতে ব্যাটেল একটা চেয়ারে বসতে বললেন। স্পষ্টই বোঝ যাচ্ছে মিস বার্জেস একটু রেগে গেছেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল, সমস্ত শুনেছেন নিশ্চয়ই। কি সাংঘাতিক নোংরা ব্যাপার দেখুন দেখি। আমাদের সন্দেহ চারজনের ওপর, এর মধ্যে কেউ একজন খুনটা করেছে। মিঃ শেটানকে আপনি চিনতেন? কাগজে তো প্রায় তার সম্পর্কে কত মজার মজার কথা লেখা হত–সেগুলো নিশ্চয়ই পড়েছেন?
মিঃ শেটানকে আমি চিনতাম না, আর বাজে খবর পড়ে নষ্ট করার মত আমার সময় নেই।
তা ঠিক। ব্যাটেল মাথা দোলালেন, একটা কথা কি জানেন, এই চারজনই বলছে মি. শেটানকে তারা খুব ঘনিষ্টভাবে চেনে না। তা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই কেউ মিথ্যে বলছে, আর সেটাই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।
মিস বার্জের্স নির্বিকারভাবে বসে রইলেন। ব্যাটেল বুঝতে পারলেন কোনভাবেই মিস বার্জেসের কাছ থেকে কিছু কথা আদায় করা যাবে না। তবুও হাল ছাড়লেন না ব্যাটেল।
আমাদের কত দিকে কত ঝামেলায় মাথা ঘামাতে হয় কি বলব। ধরুন, কোন মেয়ের কাছ থেকে কোন স্ক্যান্ডাল শোনা গেল। কারো সম্পর্কে গুজবে কান দেওয়া উচিত নয়, তবু আমরা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারি না, নজর রাখতে হয়–অবশ্য মেয়েরাই গুজব ছড়াতে ওস্তাদ।
আপনি কি বলতে চান, কেউ ডাক্তার রবার্টসের নামে কুৎসা রটাচ্ছে।
না, ঠিক তা নয়, ব্যাটেল সতর্কভাবে এগোলেন, ধরুন কোন রুগী হঠাৎ মারা গেলেন, সাধারণলোকের কাছে মৃত্যুটা সন্দেহজনক। পাঁচজন বলতে লাগল। অবশ্য এসব ব্যাপারে ডাক্তারকে সন্দেহ করা খুবই অনুচিত।
কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে মিসেস গ্রেওসের কথা বলেছে। ঐ সব বুড়িদের ধারণা সবাই বুঝি তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চায়। এমনকি নিজের ডাক্তারকে তার অবিশ্বাস। ডাক্তার রবার্টসের আগে আর তিনজন ডাক্তারের রুগী ছিলেন মিসেস গ্রেস। রবার্টসকেও তাঁর সন্দেহ হত। এরপর তিন চারজন ডাক্তারের কাছে ঘোরার পর শেষ অবধি ডা. ফার্মারের কাছে গেলেন। তার চিকিৎসাধীনে থাকার সময়ই মারা যান। সবাইকেই তার সন্দেহ।
ব্যাটেল আবার কথা শুরু করলেন, কত তুচ্ছ জিনিস থেকে গুজবের জন্ম। ধরুন, কোন রুগী মৃত্যুর আগে ডাক্তারকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেল কৃতজ্ঞতাবশতঃ। সেটা যদি বেশিই হয় ক্ষতি কি? তাও দেখবেন কত কথা উঠবে–
ডাঃ রবার্টস রুগীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তেমন কোনদিন পাননি–একজন পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়েছিলেন, আর একজন একটা সোনার রিস্টওয়াচ।
এই ধরনের পেশায় কত যে বিপদ ধীরে ধীরে বলে চলেন ব্যাটেল হয়তো নির্দোষ ঘটনা, অথচ কেউ ব্ল্যাকমেল করতে চায়। কতরকমের স্ক্যান্ডেল রটে, একজন ডাক্তারের পক্ষে কত মারাত্মক
আর বলবেন না, বিশেষ করে ঝামেলা বাধায় হিস্টিরিয়ার মহিলা রোগী।
ভদ্রমহিলার কথা শোনার পর আমারও তাই মনে হয়েছিল।
কার কথা বলছেন–মিসেস ক্যাডাক? খুবই সাংঘাতিক মহিলা!
মিসেস ক্র্যাডাক? ব্যাটেল এমন ভাব করলেন যেন ঠিক মনে পড়ছে না। বোধহয় বছর তিনেক আগেকার ঘটনা, ঠিক মনে নেই।
না, বছর পাঁচেক আগের ব্যাপার। ভদ্রমহিলা বোধহয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। স্বামীর কাছে ডাক্তার রবার্টসের নামে বানিয়ে বানিয়ে কত কি বলছিলেন। স্বামী বেচারাও তাই সত্যি ভেবে অশান্তিতে বাকি জীবনটা কাটালেন। সকালে দাড়ি কামাবার সময় তার গলাটা কেটে গেছিল, নীচুমানের সেভিং ব্রাশ দূষিত ছিল বোধহয়, জীবানু রক্তে সংক্রামিত হয়ে তিনি মারা যান। ভদ্রমহিলা তারপর লণ্ডন ছেড়ে চলে যান। মারা যান বিদেশে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা, মিথ্যে কথা বলে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠলেন ব্যাটেল, কোথায় যেন মারা গেছিলেন ভদ্রমহিলা?
খুব সম্ভবত মিশরে।
ডাক্তারদের আর একটা সমস্যা হল, ধরুন কোন রুগীর আত্মীয় রুগীকে স্লো পয়জন করছে, ডাক্তারকে কোন কারণে চুপচাপ থাকতে হচ্ছে, কিন্তু রুগী মারা গেলে আত্মীয়রা হয়ত ডাক্তারের ঘাড়েই দোষ চাপাল–কি ঝামেলা ভাবুন।
ডাক্তার রবার্টসের এ ধরনের কোন বিপদ হয়নি।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর বিদায় নিলেন ব্যাটেল। মোটামুটি সব খবরই জানা হয়ে গেছে তার। মিস বার্জেস সাত বছর ডাক্তার রবার্টসের চেম্বারে আছেন। এ পর্যন্ত রবার্টসের হাতে জনা-তিরিশ রুগী মারা গেছে। রবার্টসের পশার খুব ভালো। শেটানের ছবি মিস বার্জেসকে দেখিয়েছিলেন ব্যাটেল। কিন্তু মিস বার্জেস চেনেন না শোনকে। নোটবইয়ে কয়েকটা কথা নোট করে নিলেন ব্যাটেল। মিসেস গ্রেওস? খুব সম্ভব নয়।
মিসেস ক্রাডাক? কোন উত্তরাধিকারী নেই।
বিয়ে করেননি।
রুগীদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তদন্ত চালাতে হবে।
নোটবই বন্ধ করে ওয়েসেক্স ব্যাঙ্কের দিকে পা বাড়ালেন ব্যাটেল। রবার্টসের ব্যাঙ্ক একাউন্ট সেখানেই।
.
সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল বিষণ্ণ মুখে বসে ছিলেন। পোয়ারোর সঙ্গে একই টেবিলে লাঞ্চ করেছেন তিনি একটু আগে। পোয়ারো ফিরে তাকালেন ব্যাটেলের দিকে, আপনার পরিশ্রমটা তাহলে মাঠে মারা গেল?
গোলমেলে ব্যাপার। ব্যাঙ্কের পাসবই-এ এ-পর্যন্ত সেরকম সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না।
ডাঃ রবার্টসকে কি রকম মনে হল?
আমার মনে হয় না রবার্টস খুন করেছেন শেটানকে। তাকে খুন করা যে কত বড় ঝুঁকি–রবার্টস সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। শেটান ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠতে পারতেন।
পাসবই পরীক্ষা করে কি বুঝলেন?
রবার্টস কোন পেশেন্টের সম্পত্তি পাননি। তাই সম্পত্তি লাভের জন্য যে কাউকে খুন করেছেন এ কথাও বলা যাচ্ছে না। তার নিজের অবস্থা খুবই ভালো, অবিবাহিত। এক যদি স্ত্রীকে খুন করে থাকেন, তবে মিসেস ক্র্যাডক নামে এক পেশেন্টকে নিয়ে কিছু একটা গোলমাল বেধেছিল শোনা যায়। এ ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ভাবছি গোয়েন্দা দপ্তরের কোন চালু ছোকরাকে এ ব্যাপারটার ভার দেব।
ভদ্রমহিলার স্বামীর কি খবর?
সে ভদ্রলোক অ্যানথ্রাক্স রোগে মারা যান। সে সময় বাজারে এক ধরনের কম দামী সেভিং ব্রাশ বেরিয়েছিল, সে গুলোর কয়েকটাতে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ছিল। এ নিয়ে কোম্পানির নামে বোধহয় কি একটা মামলাও হয়েছিল কোর্টে।
খুনীর পক্ষে এটাও কিন্তু মস্ত বড় সুযোগ। গম্ভীরভাবে বললেন পোয়ারো।
আমিও এ-ব্যাপারে ভেবেছি। যদি মিসেস ক্র্যাডাকের স্বামীর সঙ্গে রবার্টসের কোন কারণে গণ্ডগোল বেধে থাকে–তবে এইসব হল অনুমাণ, কোন ভিত্তি নেই। সে থাক, আপনি কি ভাবে এগোবেন ভাবছেন? অবশ্য আমাকে বলতে যদি কোন আপত্তি না থাকে
না, না। আপত্তির কিছুই নেই। আমিও ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে দেখা করব।
একই দিনে দুজন। ভদ্রলোক তো ঘাবড়ে যাবেন খুবই।
আমি আপনার মত অতীত সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করব না। ভদ্রলোক যাতে সন্দেহ করতে না পারেন সেইভাবেই এগোব। আমার প্রশ্ন হবে ব্রীজ নিয়ে।
আবারও ব্রীজ? যাক আপনি যেভাবে খুশি আপনার কাজ করবেন। মনে হয় কর্নেল রেস কয়েকদিনের মধ্যেই ডেসপার্ডের খবরাখবর এনে দিতে পারবেন। আর মিসেস অলিভারের পক্ষেও অনেক খবর আনার সুবিধা আছে। মেয়েরাই মেয়েদের খবর যোগাড় করতে ওস্তাদ।
একটু পরেই ব্যাটেল পা বাড়ালেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দিকে। আর ডাঃ রবার্টসের চেম্বারের দিকে এগোলেন পোয়ারো।
পোয়ারোকে দেখে রবার্টসের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। ঠাট্টার সুরে বলে উঠলেন, একদিনে দুই টিকটিকি! হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে সন্ধ্যের মধ্যেই ওয়ারেন্ট বেরিয়ে যাবে আমার নামে।
পোয়ারো মৃদু হাসলেন, না না, চিন্তার কোন কারণ নেই, এখন অবধি আমার নজর সমানভাবে আপনাদের চারজনের ওপরে।
বলছেন। তবু ভাল। বলুন কিভাবে আপনার সেবায় লাগতে পারি। রবার্টস বললেন।
তক্ষুনি কোন উত্তর দিলেন না পোয়ারো, কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। তারপর রবার্টসকে প্রশ্ন করলেন পোয়ারো, আমি যে কাজের জন্য এসেছি, আমার মনে হয় সে ব্যাপারে একমাত্র আপনিই সাহায্য করতে পারেন। আপনি নিশ্চয়ই মানুষের চরিত্র স্টাডি করেন ডাঃ রবার্টস? অন্তত আপনার পেশেন্টদের খুঁটিনাটি তো একজন ডাক্তার হিসাবে লক্ষ্য রাখতেই হয়।
হ্যাঁ, সেটা যে কোন ডাক্তারকেই রাখতে হয়। কিন্তু আপনি কোন বিষয়টার ওপর জোর দিচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
পোয়ারো কোটের পকেট থেকে ভাঁজ করা তিনটে ব্রীজ খেলার স্কোরশিট বার করে রাখলেন টেবিলের ওপরে। এগুলো হল যেদিন সন্ধ্যার প্রথম তিনটে রাবারের ফলাফল। প্রথমটা মিস মেরিডিথের লেখা। এটা দেখে আপনার সেদিনের তাস সম্পর্কে কিছু মনে পড়ছে কি? ধরুন, খেলাটা কিভাবে এগিয়েছিল, ডাকগুলো কি হয়েছিল।
আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন মঁসিয়ে পোয়ারো! অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ রবার্টস এতদিন বাদে এসব আমি মনে করব কিভাবে?
একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়। ভাল করে ভেবে দেখুন, প্রথম হাতটা নিশ্চয়ই হার্ট বা স্পেডে ডাকা হয়েছিল। তবে খেলা হয়নি। একটা শর্ট গিয়েছিল।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। মনে পড়েছে এবার। স্পেডের খেলা ছিল। একটা শর্ট দিলেন ওঁরা।
পরেরটা?
যতদূর মনে পড়ছে আমি বা আমার পার্টনার দুটো ডায়মন্ডে খেলেছিলাম। তবে এবারও খেলা হয়নি। পঞ্চাশ ডাউন দিলাম। কিন্তু এতদিন পরে সবকিছু ঠিকঠাক মনে করা কি করে সম্ভব! তবে একটা গ্ল্যান্ডস্লামের কথা মনে পড়েছে। সেটা ছিল আমারই খেলা। আর একবার তিনটে নোট্রাম্প ডেকে অনেকগুলো সর্ট দিলাম–বিশ্রী ব্যাপার। প্রতিটি রঙের ডিস্ট্রিবিউশন এত খারাপ ছিল কি বলব। কোন পিটই আমরা পাইনি। তবে এটা শেষ দিকের তাস। আমার পার্টনার মিসেস লরিমার বোধহয় আমার ওভার কলিংটা ঠিক পছন্দ করছিলেন না।
অন্য কোন ডিল? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন।
আচ্ছা মিঃ পোয়ারো, আপনি কি করে ভাবছেন যে সেদিনের সমস্ত কিছুই আমার মনে থাকবে? মিঃ শেটানের নৃশংস মৃত্যুই তো সব কিছু ভুলিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তাছাড়া এ পর্যন্ত আরও সাত-আটটা রাবার খেলেছি। সেদিনের খেলার কথা আমার বিশেষ কিছুই মনে পড়ছে না।
মানলাম আপনার কথা। কিন্তু চেষ্টা করলে দু একটা ডিলের কথা মনে পড়বে না, এই কথাটা ভাবা যায় না। বিশেষ করে ডিলগুলো যখন অন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
অন্য ঘটনা বলতে?
ধরুন আপনার পার্টনার একটা সহজ খেলা ভুল করে বসল। কিংবা অন্যপক্ষের কেউ অন্ধের মত ডিফেন্স করে বসল যাতে হারা খেলা আপনারা জিতে নিলেন–
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকেছে। আপনি বলতে চাইছেন যে মিঃ শেটানকে সদ্য সদ্য খুন করে এসেছে তার হাবভাব খেলার ধরণ কিছুটা অন্যরকম হবে, তার অপরাধবোধ তাকে উত্তেজিত করে তুলবে।
ঠিক এ-কথাটাই আমি বলতে চাই। মাথা নাড়লেন পোয়ারো একটু ভাল করে ভেবে দেখুন ডাঃ রবার্টস। কারো খেলার মধ্যে এরকম চোখে পড়ার মত কোন ঘটনা ঘটেছে কি?
ডাক্তার রবার্টস মিনিট দুই মনে মনে ভাবলেন, তারপর মাথা নাড়লেন, না। নতুন কিছু তো মনে পড়ছে না। মিসেস লরিমার আর মেজর ডেসপার্ড ঠিকঠাকই খেলছিলেন। তবে মিস মেরিডিথ প্রায়ই ভুল করছিলেন, অন্যমনস্কতার জন্য হতে পারে। তাছাড়া মনে হয় অভিজ্ঞতাও কম। খেলতে খেলতে হাত কাঁপছিল।
ঠিক কখন থেকে মিস মেরিডিথের হাত কাঁপছিল?
অতসব আমার মনে নেই।
আর একটা ব্যাপার জিজ্ঞেসা করব। সেদিন যে ঘরে আপনারা ব্রীজ খেলছিলেন সে ঘরের জিনিসপত্রগুলোর একটা বিবরণ দিতে পারবেন?
বিবরণ? সে তো অনেক কিছু ছিল–যেমন দামী দামী ফার্নিচার–
না, না, ওভাবে নয়, পোয়ারো বাধা দিলেন, প্রত্যেকটা জিনিসের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করবেন।
বেশ। হাতির দাঁতের কাজ করা একটা বড় সেট। চার-পাঁচটা বড় বড় চেয়ার, আটটা কি নটা পার্সিয়ান কম্বল। বারোটা ছোট ছোট চেয়ারের একটা সুন্দর সেট। খুব সুন্দর একটা তিন-
চাইনিজ আলমারী। বড় পিয়ানো একটা। আরো অনেক ফার্নিচার ছিল কিন্তু অত লক্ষ্য করিনি, ছটা ভালো জাপানি ছবি। আয়নার দুপাশের ছবি দুটো চাইনিজ। পাঁচ-ছটা নস্যির কৌটো, বেশ দেখতে। টেবিলের ওপর হাতির দাঁতের কাজ করা কয়েকটা ছোট ছোট মূর্তি। প্রথম চালর্সের শীলমোহর করা কিছু মুদ্রা–
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে বলে যান। উৎসাহ দিলেন পোয়ারো।
প্রাচ্যদেশীয় কিছু জিনিসপত্র ছিল। সুক্ষ্ম রূপোর কাজ করা কয়েকটা শিল্পসামগ্রী, কিছু গয়নাগাটি। একটা সুন্দর কাঁচের বাক্সে ছোট ছোট কয়েকটা সৌখিন জিনিস সাজানো ছিল। আর তো মনে পড়ছে না।
আপনার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে হয়, সত্যি চমৎকার।
আপনি যে জিনিসটার কথা জানতে চান, যা বর্ণনা দিলাম এর মধ্যে পেলেন সেটা?
না, আমি জানতাম আপনি সেটার উল্লেখ করবেন না কারণ জিনিসটা হয়ত আদৌ তখনো সেখানে ছিল না।
তার মানে আপনার কথা কেমন হেঁয়ালীর মত মনে হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না।
সেটাই তো আমি চাই। কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। তবে আজ আপনি যা বললেন তা আমার খুব কাজে লাগবে।
ডাক্তার রবার্টসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পোয়ারো একটা ট্যাক্সি ধরলেন। এবার তিনি দেখা করবেন মিস লরিমারের সঙ্গে।
আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ পোয়ারো। সেদিনের ঘরের ফার্নিচারের বিবরণ–সে আবার আপনার কি কাজে লাগবে? মিসেস লরিমার বেশ অবাক হলেন।
ম্যাডাম, ব্যাপারটা হয়ত বোঝাতে পারব না। ধরুন আপনাকে ব্রীজ টেবিলে যদি কেউ বলে আপনি টেক্কাটা অত তাড়াতাড়ি খেলে বসলেন কেন, অথবা সাহেব না মেরে গোলাম মারলেন কেন? আপনার তখন বিরক্ত লাগবে কোন আনাড়িকে বোঝাতে, সেখানে বললেও বুঝবে কিনা সন্দেহ।
মিসেস লরিমার হাসলেন, ও, তার মানে আপনি বলতে চান গোয়েন্দাগিরিতে আপনি। যেমন দক্ষ, ঠিক ততখানি আনাড়ি হলাম আমি। ঠিক আছে, বলছি–সেদিনের যে যে জিনিসগুলোর কথা আমার মনে আছে। মনে মনে একটু চিন্তা করে নিলেন মিসেস লরিমার, ঘরটা বেশ বড়, প্রচুর জিনিসপত্র ছিল–
কি কি জিনিস ছিল?
গোটাকতক কাঁচের আধুনিক ডিজাইনের ফুলদানী, সুন্দর দেখতে। যতদূর মনে পড়ে চিনা বা জাপানি ঢঙের কতকগুলো ছবিও দেওয়ালে টাঙানো ছিল। একগোছা ছোট ছোট রক্তিম টিউলিপ। টিউলিপের সময় কিন্তু এখন নয় কিন্তু ভদ্রলোক যে কোথা থেকে। জোগাড় করলেন–
আর কিছু? ফার্নিচারগুলোর রঙ কিরকম ছিল মনে পড়ছে?
হ্যাঁ। ধূসর সিল্ক রঙের কয়েকটা ফার্নিচার ছিল।
ছোটখাট কোন জিনিস নজরে পড়েনি আপনার?
নাঃ, একদম মনে পড়ছে না। মাপ করবেন, হয়ত কোন কাজে লাগলাম না–
আর একটা প্রশ্ন বাকী আছে। পোয়ারো পকেট থেকে স্কোরশিটগুলো বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। এগুলো সেদিনের প্রথম রাবার তিনটের হিসেব। দেখুন তো, এগুলো দেখে সেদিনের ডিলগুলোর কথা আপনার মনে পড়ে কিনা।
পোয়ারোর হাত থেকে স্কোরশিটগুলো নিয়ে মিসেস লরিমার ঝুঁকে পড়লেন তার উপর। হ্যাঁ, বেশ মনে আছে। এটা প্রথম রাবার। তখন আমার পার্টনার ছিলেন মিস মেরিডিথ। অন্যদিকে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। প্রথম ডিলে আমরা চারটে স্পেড ডেকেছিলাম। পাঁচের খেলা হয়। পরের তাস দুটো ক্লাব ডাক হয়েছিল। ডাঃ রবার্টস খেলতে পারেননি। একটা ডাউন দেন। তৃতীয় ডিলে খুব বেশি ডাকাডাকি চলে। আমার স্পষ্ট মনে আছে। মিস মেরিডিথ পাস দিলে একটা হার্ট দিয়ে মেজর ডেসপার্ড ডাক শুরু করেন। আমি পাস দিলাম। ডাক্তার রবার্টস লাফিয়ে বীড দেন, তিনটে ক্লাব। মিস মেরিডিথ ডাকেন তিনটে স্পেড। মেজর ডেসপার্ড বলেন চারটে ডায়মণ্ড। আমি ডবল দিই। ডাক্তার রবার্টস গোড়ায় হার্ট রঙে ফিরে চান। কিন্তু চারটে হার্টসে একটা ডাউন দেন।
২. মেজর ডেসপার্ডের ডিল ছিল
পরের বার মেজর ডেসপার্ডের ডিল ছিল, তিনি পাস দেন। আমি একটা নো-ট্রাম্প দিয়ে ডাক শুরু করলাম। রবার্টস আবার লাফিয়ে বললেন, তিনটে হার্ট। আমার পার্টনার পাস দিলেন। মেজর ডেসপার্ড ডাকলেন চারটে হার্ট। আমি ডবল দিলাম। দুটো শর্ট দিলেন ওরা। পরের তাসে আমরা চারটে স্পেড ডাকলাম কিন্তু একটা ডাউন হয়ে গেলো।
মিসেস লরিমার পরের স্কোরশিটটা তুলে নিলেন।
পোয়ারো বললেন, মেজর ডেসপার্ড কেমন কেটে কেটে লিখেছেন, স্কোর দেখে তাসগুলো মনে করা শক্ত হবে।
যতদূর মনে পড়ছে, প্রথম দুটো ডিলে দুপক্ষই পঞ্চাশ করে শর্ট দিয়েছিলাম। তারপর ডাক্তার রবার্টস পাঁচটা ডায়মণ্ড ডাকলেন। আমরা ডবল দিয়ে তিনটে শর্ট নিলাম। পরের তাসটা আমরা খেলোম তিনটে ক্লাবে। এরপরে ওরা স্পেডে গেম খেলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটা ক্লাবে গেম করলাম আমরা। পরের তাসটায় শর্ট দিলাম একশো। ওরা আবার একটা হার্ট খেলে গেলেন। কিন্তু পরপর দুটো তাস যথাক্রমে দুটো নো-ট্রাম্প এবং চারটে ক্লাবের খেলা করায় গেম হয়ে গেল। রাবারও পেলাম।
তৃতীয় স্কোরশিটটা তুলে নিলেন মিসেস লরিমার। এই রাবারটা দারুণ উত্তেজনায় হয়েছিল। খুব শান্তভাবে। মেজর ডেসপার্ড আর মিস মেরিডিথ প্রথমে একটা হার্টের খেলা করলেন। তারপর আমরা হার্ট ও স্পেডে গেম ডেকে একটা করে শর্ট দিলাম। ওরা স্পেডে গেম করলেন। রাবার বাঁচাবার আশা খুব কম। এরপর তিনটে তাস একটা দুটো করে শর্ট দিলাম আমরা। অবশ্য ওরা কেউ ডবল দেননি। শেষে আমরা নো-ট্রাম্পে গেম খেলোম। তখন থেকেই যুদ্ধ শুরু হলো। কেউ কাউকে সহজে ছেড়ে দিতে চায় না। ফলে প্রত্যেকেই ডাউন দিতে লাগলাম। ডাক্তার রবার্টসের বীটের তোড়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন মেরিডিথ। তাস ভালো থাকলেও বেশি বীট দিতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। এরপ পরেই ডাক্তার রবার্টস গেম ফোর্সিং দুটো স্পেড দিয়ে ডাক শুরু করলেন। আমি বললাম তিনটে ডায়মন্ড। তিনি ডাকলেন চারটে নো-ট্রাম্প। আমি পাঁচটা স্পেড, হঠাৎ ডায়মন্ডে গ্র্যান্ডস্ল্যাম ডেকে বসলেন রবার্টস। ডেসপার্ডও মুখিয়েছিলেন, বললেন ডবল। হার্ট লিডে তাসটায় তিনটে শর্ট ছিল। ভাগ্য ভাল লিড হল ক্লাবের সাহেব। ফলে খেলা হয়ে গেল। দারুণ উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে শেষ হল রাবারটা।
হায় ভগবান! ভালনারেবল গ্র্যান্ডস্ল্যামের খেলা, তার ওপর ডবল! আমি হলে ছয় সাতের ডাকে না গিয়ে গেমেই সন্তুষ্ট থাকতাম।
তা কেন? হাতে ভালো তাস থাকলে নিশ্চয়ই ছয়-সাতের ডাকে যাবেন।
আপনি তাহলে ঝুঁকি নেবার পক্ষে?
ডাক নির্ভুল হলে ঝুঁকির কোন প্রশ্নই আসে না। এ তো সোজা হিসেব। তবে খুব কম লোকই নির্ভুল বিট দিতে পারে। প্রথমটা হয়ত ঠিকঠাকই শুরু করে কিন্তু শেষরক্ষা করে উঠতে পারে না। সে যাই হোক–এবার চতুর্থ স্কোরশিটটা হাতে নিলেন মিসেস লরিমার, এটাতে ঠিকমত খেলা হচ্ছিল না, কেমন যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছিল। বোধহয় আগের খেলাটা অত উত্তেজনা পূর্ণ হওয়াতে পরেরটা ভাল হচ্ছিল না।
পোয়ারো স্কোরগুলো ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন, সত্যি ম্যাডাম, আপনার স্মৃতিশক্তির তুলনা নেই। প্রত্যেকটা তাস বোধহয় আপনার ছবির মত মনে আছে?
তাই তো মনে হয়!
স্মৃতিশক্তি সত্যি একটা অসামান্য উপহার, আমার মনে হয় অতীত বোধহয় আপনার কাছে নতুন, প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা মনে হয় সবেমাত্র গতকালের তাই না?
মিসেস লরিমার চকিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, বড় বড় চোখে হঠাৎ অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন, মিসেস লরিমার। কিছুই পোয়ালোর নজর এড়ালো না। নিঃসন্দেহে তার তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।
কিছু মনে করবেন না। উঠে দাঁড়ালেন মিসেস লরিমার আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারছি না, এক্ষুনি বেরোতে হবে। আপনার কাজেও কোন সাহায্য করতে পারলাম না–
তা কেন? আমি যা জানতে চাইছিলাম আপনার কথা থেকেই আমি পেয়ে গেছি পোয়ারো তাকালেন মিসেস লরিমারের দিকে।
মিসেস লরিমার কিন্তু কোন কথা বললেন না। তিনি কি বলেছেন পোয়ারোই বা কি জানতে চেয়েছিলেন এ সম্পর্কে তার কোন কৌতূহলই নেই।
আমি আজ বিদায় নিচ্ছি মিসেস লরিমার। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। একটা কথা–আপনি ডেকে না পাঠালে আমি কোনদিনই আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে আসব না।
কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আমিই বা কেন আপনাকে ডেকে পাঠাব? মিসেস লরিমার জিজ্ঞাসা করলেন।
হয়ত পাঠাবেন, কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার। যদি ডেকে পাঠান নিশ্চয়ই আমি আসব।
পোয়ারো বিদায় নিয়ে রাস্তায় পা বাড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল মিসেস লরিমার প্রথমে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি পরে উত্তর দিলেন। আমার অনুমান ভুল নয় বিড় বিড় করলেন পোয়ারো–ওরকমটাই হবে।
মিসেস অলিভার খুব কষ্টে টু-সিটার গাড়ি থেকে রাস্তায় নামলেন। বেশ কিছুটা সামনে এগোবার পর ওয়েভন কুটীর-এর দেখা মিলল। দু-কামরার বাঙলো প্যাটার্নের একটা বাড়ি। দরজার বেল টিপলেন। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এল না। আরও দু চারবার বেল টিপেও কোন কাজ হল না। মনে হয় ভেতরে কেউ নেই।
অগত্যা মিসেস অলিভার বাইরের বাগানের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। বাগানের পাশেই ফাঁকা মাঠ। একটু পরেই সেদিক থেকে দুজন তরুণীকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি হতেই মিসেস অলিভার এগিয়ে গেলেন ভালো আছেন মিস মেরিডিথ? আমাকে চিনতে পারছেন নিশ্চয়ই?
নিশ্চয়ই! অ্যানা মেরিডিথ করমর্দন করলেন সুপ্রভাত! কিন্তু মেরিডিথের চোখের তারায় আতঙ্ক ফুটে উঠল, নিজেকে সামলাতে সময় লাগল তার।
এই হচ্ছে আমার বন্ধু রোড, রোডা দোবাস। আমরা এক সঙ্গেই থাকি। মিস মেরিডিথ আলাপ করিয়ে দিলেন।
মিস দোবাস সুন্দরী মেরিডিথের চেয়ে কিছুটা লম্বা। রোড উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আপনিই বিখ্যাত লেখিকা মিসেস অলিভার?
মাথা নাড়লেন মিসেস অলিভার, তারপর ফিরে তাকালেন মিস মেরিডিথের দিকে। অনেক কথা আছে আমার, কোথাও বসতে পারলে ভাল হত।
মেরিডিথ তাকে পথ দেখিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলেন।
চেয়ারে বসতে বসতে মিসেস অলিভার বললেন, আমি গতদিনের খুনের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি। আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে কিছু করা উচিত আমাদের।
করা উচিত? তার মানে? মিস মেরিডিথ অবাক হলেন।
আলবাত। দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন মিসেস অলিভার এটা কার কীর্তি আমি নিঃসন্দেহে জানি। ঐ যে ডাক্তার, কি যেন নামটা–রবার্টস। হ্যাঁ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ হল আসল অপরাধী। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ওয়েলসের অধিবাসী। ওদের আমি জীবনেও বিশ্বাস করি না। আমার অসুখের সময় একজন নার্স রেখেছিলাম, সেও জাতে ওয়েলস। মেয়েটি একদিন কি করল জানেন! তিন রকমের তিনটে মিক্সচার একঘন্টা অন্তর অন্তর পর পর তিনবার খাওয়ার কথা। কিন্তু সে ভুল করে একই মিক্সচার পর পর তিনবার খাইয়ে দিল। কোন দায়িত্বজ্ঞান আছে? আমি নিশ্চিত, ঐ রবার্টর্স ছাড়া আর কারো কাজ নয়। এখন শুধু প্রমাণের অপেক্ষা-
আচমকা খিল খিল করে হেসে উঠল রোডা। মাপ করবেন–নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আসলে আমি আপনাকে মনে মনে যেরকম কল্পনা করেছিলাম তার সঙ্গে কিন্তু আপনার কোন মিল নেই।
সবাই এরকমটাই বলে। সে যাকগে। এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হল রবার্টসের অপরাধের প্রমাণ খোঁজা–তাও করতে হবে নিজেদের বাঁচতে। আপনাকে কেউ খুনি বলে সন্দেহ করুক নিশ্চয়ই আপনি তা চান না মিস মেরিডিথ?
মিস মেরিডিথ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল, কেন? আমাকে সন্দেহই বা করবে কেন?
সাধারণ লোক তাই ভাবে। খুনের সঙ্গে জড়িত অন্য তিনজনকেও তারা সমান সন্দেহ করে।
অ্যানা মেরিডিথের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, আপনি আমার কাছে কি জন্য এসেছেন মিসেস অলিভার?
কার কাছে যাব? মিসেস লরিমার সারাদিন ক্লাবে বসে ব্রীজ খেলেন, তার দেখা পাওয়া ভার। তাছাড়া নিজেকে বাঁচানোর মত যথেষ্ট বুদ্ধি আর সাহস তার আছে। মিসেস লরিমারের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কে কি ভাবল না ভাবল তাতে তার কিছু আসে যায় না। আর মেজর ডেসপার্ড হলেন পুরুষ। পুরুষদের নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। এরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিতে পারবে। কিন্তু আপনি? আপনি একজন সুন্দরী তরুণী–সমস্ত ভবিষ্যৎ যার সামনে পড়ে আছে। আমার তো আপনাকে নিয়েই বেশি চিন্তা।
ঠিক এ-কথাটাই আমিও বলি। তাছাড়া চুপচাপ বসে থেকে কিছু একটা করা তো ভাল। রোডা মন্তব্য করল।
আমরা এখন তিনজন–তিনজনই নারী। দেখা যাক আমাদের সকলের চেষ্টায় কিছু হয় কি না?
আচ্ছা ডাঃ রবার্টসই যে খুনি একথা ভাবছেন কেন? মিস মেরিডিথ শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
এ-ধরনের কাজের পক্ষে একমাত্র উপযুক্ত লোক তিনি। মিসেস অলিভারের নির্বিকার কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
সে ক্ষেত্রে ডাক্তার হিসাবে বিষটাকেই বেছে নেওয়ার কথা–
না না, মোটেই তা নয়। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হলে ডাক্তারের উপরেই তো সকলের সন্দেহ হবে। ডাক্তার কি অত কাঁচা? আটঘাট বেঁধেই কাজ করেছেন। মাথা দোলালেন মিসেস অলিভার।
তা ঠিক। মেরিডিথ সম্মতি জানালেন, তবে রবার্টস কেনইবা শেটানকে খুন করতে যাবেন?
কত কারণ হতে পারে। হয়ত শেটান অনেক টাকা ধার দিয়েছেন ডাক্তার রবার্টসকে। সেটা শোধ করতে বলায় রবার্টস খুন করলেন তাকে। আবার হয়ত শেটানের কোন নিকট আত্মীয়াকে বিয়ে করেছেন রবার্টস। শেটানের মৃত্যুতে সেই আত্মীয়াটি সব টাকাপয়সা পেয়ে যাবেন–রবার্টস তো বটেই। আর-আর এরকমও হতে পারে শেটান এমন কোন কথা, মানে ডাঃ রবার্টসের কোন গোপন ঘটনা জেনে ফেলেছিলেন। শেটান সেদিন সন্ধ্যায় এরকম একটা কথাও বলেছিলেন, মনে পড়ছে?
মুহূর্তে অ্যানার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। না তো, কিছুই মনে পড়ছে না আমার
আরে–ভুল করে রুগীকে বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে দেওয়া না কি যেন একটা বললেন মনে পড়ছে না আপনার?
বাঁ হাত দিয়ে শক্তভাবে চেয়ারের হাতলটা চেপে ধরল অ্যানা, হ্যাঁ। ঐরকমই কি একটা–অ্যানার ঠিক মনে নেই।
অ্যানা। রোডা বন্ধুর দিকে তাকালেন, এটা গরমকাল নয়। একটা কোট অন্তত গায়ে দিয়ে আসা উচিত ছিল তোর।
মিস মেরিডিথ একটু বিরক্ত হয়ে তাকাল রোডার দিকে।
তাহলে আমার থিওরিটা বুঝতে পারছেন তো? মিসেস অলিভার বলে চললেন লোকে জানল যে ডাঃ রবার্টসের রুগী নিজে ভুলে ওষুধের বদলে বিষ খেয়ে মারা গেছে। আসলে তো সবটাই সাজানো-রবার্টসের কীর্তি। কে জানে এভাবে আরও কত পেশেন্টকে খুন করবেন তিনি!
অবাস্তব–পুরো থিওরিটাই অবাস্তব। এভাবে খুন করে চললে তার নিজেরই তো ক্ষতি–পশার কমে যাবে। মিস মেরিডিথ শক্ত গলায় বলে ওঠেন।
নিশ্চয়ই, গভীর কোন কারণ আছে এর পেছনে।
আপনি ঠিকই বলেছেন মিসেস অলিভার, বলে ওঠে রোড, আপনার আইডিয়াটা দারুণ। ঠিক, একজন ডাক্তারই তো এভাবে খুনটা করতে পারে।
কথার মাঝখানে অ্যানা চেঁচিয়ে উঠল, হা, হা, আমার মনে পড়েছে। মিঃ শোন সেদিনের পার্টিতে ডাক্তারদের সম্বন্ধেই কি যেন একটা বলছিলেন, কি একরম বিষ আছে যা ল্যাবরেটরীর পরীক্ষতে ধরা পড়ে না
ভুল করছেন, শেটান নয়, একথা বলেছিলেন মেজর ডেসপার্ড। আরে, নাম করতে না করতেই ভদ্রলোক একেবারে হাজির। মিসেস অলিভার বেশ অবাক হলেন। বাগানের পথ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল মেজর ডেসপার্ডকে।
মিসেস অলিভার বেরিয়ে এলেন ওয়েভেন কুটীর থেকে। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে মৃদু হাসলেন তিনি। বেশিক্ষণ মিস মেরিডিথের ওখানে থাকা উচিৎ হয়নি তার। মেজর ডেসপার্ড রীতিমত অস্বস্তি বোধ করছিলেন মিসেস অলিভারকে দেখে। তাই দুই বন্ধু এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।
মিস মেরিডিথ মজর ডেসপার্ডের কাছে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতেই ডেসপার্ড বলে উঠলেন মিস মেরিডিথ, অযথা সময় নষ্টের দরকার নেই। আমার আসার কারণটা বলি। আপনার ঠিকানা আমি সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের কাছ থেকে পেয়েছি। ব্যাটেলও এখানেই আসছেন। আমি তাকে প্যাডিংটন স্টেশানে অপেক্ষা করতে দেখেছি। তাড়াতাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এলাম। জানতাম ট্রেনের আগে এসে পৌঁছব।
কিন্তু এত তাড়াহুড়োর কি প্রয়োজন ছিল?
নিশ্চয়ই। আপনি একলা, আপনাকে সাহায্য করা দরকার।
কেন? আমিই তো আছি। রোডা ফোঁস করে উঠল। মেজর ডেসপার্ড তাকালেন রোডার দিকে। সত্যিই রোডা হল অ্যানা মেরিডিথের প্রকৃত বন্ধু।
আমি জানি, মিস দোবাস, আপনার মত বন্ধু পৃথিবীতে দুর্লভ। আপনাদের দুজনের বয়স অল্প। ঐ খুনের সঙ্গে জড়িত চারজনের মধ্যে মিস মেরিডিথ একজন। সুতরাং অন্যান্য সকলের সঙ্গে তিনিও সন্দেহের আওতায়। এরকম অবস্থায় আপনাদের একজন অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য প্রয়োজন। আমার মতে মিস মেরিডিথ, আপনার উচিত কোন অভিজ্ঞ সলিসিটারের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কোন চেনা-শোনা সলিসিটার আছে?
মিঃ বারী নামে একজন সলিসিটার আছেন, তবে প্রায় একশোর কাছাকাছি বয়স, তেমন বলতে চলতে পারেন না- রোডা বলে ওঠে।
আপত্তি না থাকলে আমার সলিসিটার মিঃ মেহর্নের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। ফার্মের নাম জ্যাকব অ্যান্ড জ্যাকব। এদের ফী-ও খুব বেশি নয়।
এসবের কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া টাকা-।
না, না, টাকার জন্য তোর কোন চিন্তার কারণ নেই অ্যানা। বাধা দিয়ে বলে ওঠে রোড, সে সব হয়ে যাবে। সত্যিই মেজর ডেসপার্ড আপনি সঠিক উপদেশই দিয়েছেন।
ঠিক আছে। তাহলে যা বলছেন তাই করব। অ্যানা শান্ত গলায় জানায়।
এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা। রোড মন্তব্য করে, তারপর আচমকা প্রশ্ন করে, মেজর ডেসপার্ড, আপনার কাকে খুনি বলে মনে হয়–মিসেস লরিমার না ডাঃ রবার্টস?
কেন? আমিও তো খুনটা করে থাকতে পারি। মেজর ডেসপার্ড ম্লানভাবে হাসলেন।
আপনি? কক্ষনো না। আমরা বিশ্বাস করি না। রোডা মাথা বাঁকিয়ে বলে।
প্রমাণ না পেয়ে সবকিছুকেই সত্যি বলে ভেবে নেবেন না মিস দোবাস। যাক এবার আমি বিদায় নেব। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মেজর ডেসপার্ড।
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল কি এদিকেই আসবেন? অ্যানা একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞাসা করে। রোডাও হঠাৎ প্রশ্ন করে, ব্যাটেল কিরকম লোক বলুন তো?
খুবই বিচক্ষণ, দক্ষ পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট।
কিন্তু অ্যানা যে বলল, বোকা বোকা গোঁয়ার গোবিন্দ টাইপ।
দেখে ওরকম মনে হয়, কিন্তু ওটা ওর মুখোস। আসলে খুবই চালাক চতুর লোক। যাইহোক মিস মেরিডিথ, যাবার আগে আপনাকে একটা কথা বলে যাই। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বলতে চাই, হয়ত মিঃ শেটানের সঙ্গে আপনার কোন যোগাযোগ থাকতেও পারে। কিন্তু আপনি হয়ত চান না তা সকলের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ুক-
সেই জানোয়ারটার সাথে আমার কোন সম্পর্কই ছিল না। তাকে আমি চিনতামই না। মিস মেরিডিথ চেঁচিয়ে ওঠে।
মাপ করবেন। আমি আপনাকে আঘাত করতে চাই না। আমার কথা হল যদি সেরকম কোন ব্যাপার থাকে আপনি আপনার সলিসিটারের উপস্থিতি ছাড়া সুপারিনটেন্ডেন্টের কোন কথার উত্তর দিতে বাধ্য নন, এটা আপনার আইন সঙ্গত অধিকার।
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের সমস্ত প্রশ্নের উত্তরই আমি দেবো। গোপন করার মত কিছুই নেই–কিছুই নেই– মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে অ্যানা মেরিডিথ।
মেজর ডেসপার্ড বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল যখন ওয়েভেন কুটীরে এসে পৌঁছলেন তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। এখানে আসবার পথে তিনি মিস মেরিডিথের সম্পর্কে বিভিন্ন লোকের কাছে খোঁজখবর নেন। সব থেকে বেশি খবরাখবর দেন, ওয়েভেন কুটীরের ঠিকে ঝি, মিসেস অস্টওয়েল। ব্যাটেল অবশ্য কাউকেই প্রকৃত পরিচয় দেননি। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম পরিচয় দিয়েছেন–কোথাও কনস্ট্রাকসনের লোক, কাউকে ভ্রমণকারী হিসাবে, নিজের পরিচয় দিয়েছেন। খবর যা জোগাড় করেছেন বলতে গেলে বেশ ভালই।
ওয়েভেন কুটীরে দুই বন্ধু বাস করে–মিস মেরিডিথ ও মিস দোবাস। বছর দুয়েক হল ওরা ঐ কুটীরের বাসিন্দা। মিঃ পিকারগিলের কাছ থেকে ওরা ওয়েভেন কুটীর কিনে নেন। প্রতিবেশীরা সকলেই বেশ পছন্দ করেন ওদের। তবে পুরোনো আমলের কয়েকজন বৃদ্ধ এভাবে দুই অবিবাহিত তরুণীর একা একা থাকাটা বিশেষ পছন্দ করেন না, অবশ্য মেয়ে দুটি খুবই ভদ্র এবং সভ্য। প্রতিবেশীদের মতে মিস দোবাস ও মিস মেরিডিথ লণ্ডনের মেয়ে। কিন্তু মিসেস অস্টওয়েলের মতে এরা দুজনে ডেভনশায়ারের অধিবাসী ছিল। মিস দোবাসের বেশ ভাল টাকাকড়ি আছে, ওয়েভেন কুটীরের মালিক সে-ই, এছাড়া অধিকাংশ খরচ-পত্তর মিস দোবাসই চালায়।
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ডায়েরীতে লিখে রাখলেন। কিছুক্ষণ বাদে ওয়েভেন কুটীরে ডোরবেল টিপলেন তিনি। দরজা খুলল এক দীর্ঘাকৃতি সুন্দরী, বলাইবাহুল্য ইনি হলেন মিস রোডা দোবাস। ব্যাটেল নিজের পরিচয় দিতে বসবার ঘরে তাকে নিয়ে এল রোডা। অ্যানা একটা বেতের চেয়ারে বসে ছিল। হাতে তার উষ্ণ কফির কাপ। ব্যাটেল ঢুকতেই অ্যানা এগিয়ে এসে করমর্দন করল।
একটু অসময় এসে পড়লাম মিস মেরিডিথ, ব্যাটেল মৃদু হাসলেন, ইচ্ছে করেই দেরি করলাম, আগে এলে হয়ত আপনাকে পেতাম না।
রোড, সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আয়। অ্যানা তাকাল রোডার দিকে।
ব্যাটেল চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, আপনার আথিতেয়তার জন্য, ধন্যবাদ মিস মেরিডিথ।
রোডা এক কাপ কফি নিয়ে এসে ব্যাটেলের সামনে রাখল। অ্যানা বেশ সহজভাবেই বসে আছে! রোডা চেয়ারে বসে ব্যাটেলের দিকে তাকিয়ে আছেন–দু চোখে অপার কৌতূহল।
অ্যানা প্রশ্ন করল, আপনাকে আমরা আরো আগেই দেখা পাবার আশা করেছিলাম, সে যাক, তদন্ত কতদূর এগোল, কিছু পেয়েছেন?
সেরকম কিছু না, কাজ চলছে। ডাঃ রবার্টসের চেম্বারে গিয়ে তার কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। কথাবার্তা হয়েছে মিসেস লরিমার-এর সঙ্গে। এখন শুধু বাকি মেজর ডেসপার্ড আর আপনি। অ্যানার ঠোঁটে মৃদু হাসি। বেশ তো প্রশ্ন করুন আমাকে।
কয়েকটা কথা জানবার আছে, মানে–সহজ ভাষায় আপনার আত্মপরিচয়।
নিজেকে তো ভদ্র সভ্য বলেই জানি। আমার জন্ম হয়েছিল-গরিব কিন্তু ভদ্র পরিবারে। ঠাট্টার সুরে বলে উঠল রোডা।
আঃ রোড, এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। অ্যানা রেগে উঠল।
মিস দোবাস, আপনার বন্ধুকেই বলতে দিন। বলুন মিস মেরিডিথ কি বলছিলেন।
আমার জন্ম হয়েছিল ভারতবর্ষের এক শহরে কোয়েট্টায়। আমার বাবা মেজর জন মেরিডিথ মিলিটারীতে চাকরী করতেন। আমার এগারো বছর বয়সে আমার মা মারা যান। বাবা এর কয়েক বছরের মধ্যে অবসর নিয়ে কেন্টেনহ্যামে চলে এলেন। বাবা মারা গেলেন আমার আঠারো বছর বয়সে। বাবার মৃত্যুর পর চোখে অন্ধকার দেখলাম, একেবারে ভিখারী, নিঃস্ব অবস্থা। লেখাপড়াও বেশি করিনি, শর্টহ্যান্ড-টাইপ কিছু জানা নেই। এরকম অবস্থায় কি-ই বা চাকরী পাব। বাধ্য হয়ে একজনের বাড়িতে চাকরী নিলাম–দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দেখা শোনা করার আর সংসারে ছোটখাট কাজে সাহায্য করা।
সেখানকার ঠিকানা?
কর্ত্রীর নাম মিসেস এলডন। লার্চ শহরের ভেক্টর অঞ্চলে বাড়ি। দু বছর ছিলাম সেখানে। মিসেস এল্ডন এরপর স্বামীর সঙ্গে বিদেশে চলে যান। কাজেই অন্য চাকরী খুঁজতে হল। এরপর রোডা ওর কাকীমা মিসেস ডিঘারিংয়ের বাড়িতে একটা কাজ ঠিক করে দেয়। খুব ভাল ছিলাম সেখানে, মাঝে মাঝে রোডা আসত। দুচারদিন থাকত। খুব মজায় কাটত সে দিনগুলো।
কি করতেন সেখানে?
অ্যানার হয়ে রোডাই উত্তর দিল বাগানের কাজকর্ম দেখাশোনা। যদিও অ্যানার কাজ ছিল কাকির সেবাশুশ্রূষা করা। কিন্তু আমার কাকির আবার বাগানের সখ, অ্যানারও সেই কাজে তাকে সাহায্য করতেই সময় কেটে যেত।
সে চাকরী ছেড়ে দিলেন কেন?
মিসেস ডিঘারিংয়ের স্বাস্থ্য ক্রমশ এত খারাপ হয়ে পড়ল যে একজন পাস করা নার্সের দরকার দেখা দিল।
তার ক্যান্সার হয়েছে। রোডা বলল, শেষ বয়সটা খুব যন্ত্রণায় ভুগছেন। আজকাল কষ্ট বেশি হলে মরফিয়া নেন।
আমার সঙ্গে মিসেস ডিঘারিং বরাবরই ভাল ব্যবহার করেছেন। এত কষ্ট পাচ্ছেন, আমার খুবই খারাপ লাগছে। অ্যানার কথায় বেদনার সুর।
আমার সঙ্গে অ্যানার স্কুলজীবন থেকে বন্ধুত্ব। বোড়া জানায়, অ্যানা যখন অন্য কাজ খুঁজতে লাগল, তখন আমিও গ্রামাঞ্চলে একটা বাড়ির খোঁজ করছিলাম। ইচ্ছে ছিল কাউকে সঙ্গী হিসাবে নেব। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা আবার বিয়ে করলেন। আমার ভাল লাগল না, চলে এলাম। অ্যানাকে আমার সঙ্গে থাকতে বলাতে রাজি হল। তারপর থেকে এখানেই আছি।
আচ্ছা। মিস মেরিডিথ, মিসেস এন্ডনের কাছে দু বছর ছিলেন বললেন, তার বর্তমান ঠিকানা?
ভদ্রমহিলা এখন প্যালেস্টাইনে, তার স্বামী সরকারি কাজে ওখানে গেছেন। কি কারণে অতশত বলতে পারব না।
সে সব আমরা জেনে নেব-মিসেস ডিঘারিংয়ের ওখানে কবছর ছিলেন?
ঠিক তিন বছর। চটপট জবাব দেয় অ্যানা, তার ঠিকানা, মার্শভেন হেস্বারী ডেভবে।
হু। তাহলে এখন আপনার বয়স পঁচিশ। আর একটা প্রশ্ন, কেল্টেনহ্যাম শহরের দুজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের নাম লিখে দিন, যাঁরা আপনাকে এবং আপনার বাবাকে ভালভাবে চিনতেন।
অ্যানা দুজনের নাম ঠিকানা লিখে দিল।
মিঃ শেটানের সঙ্গে আপনার কোথায় পরিচয় হল?
রোডা আর আমি সুইজারল্যান্ডের একটা হোটেলে উঠেছিলাম। সেখানেই তার সাথে আলাপ। হোটেলের অন্যান্য বোর্ডাররা একটা ফ্যান্সি ড্রেসের আয়োজন করেছিল। শোন পেয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার, শয়তান সেজে।
হোটেলে আর টুরিস্ট ছিল যারা, তাদের নাম ঠিকানা মনে আছে?
আপনি তো খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্থ লোক! রোডা বলে ওঠে, এতক্ষণ ধরে কি আমরা আগাগোড়া মিথ্যে বলছি?
ব্যাটেল চোখ মিট মিট করলেন।বুঝতেই পারছেন, কত বড় সাংঘাতিক একটা খুনের তদন্ত চালাচ্ছি, সবদিক দেখেশুনে তো এগোতে হবে।
তবুও আপনি একটা সন্দেহপ্রবণ লোক! মৃত্যু হেসে রোডা কাগজে কতগুলো নাম ঠিকানা লিখে দিল।
ব্যাটেল উঠে দাঁড়ালেন, অসংখ্য ধন্যবাদ মিস মেরিডিথ। আপনার বন্ধুও যখন বলছেন আপনি নির্দোষ জীবন কাটাচ্ছেন তখন ভয় কিসের? কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। শেটানের অদ্ভুত ব্যবহারের কারণটা কি? আপনাকে কোনদিন কোন বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
না না। অ্যানার সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয়নি। বরাবর খুব ভদ্র ব্যবহার করতেন। অ্যানা চটপট জবাব দিল।
আচ্ছা। এবার আমি বিদায় নেব। শুভ রাত্রি। মিস মেরিডিথ কফির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ব্যাটেল চলে যাবার পর গেট বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে ফিরে এলো রোডা।দেখলি তো অ্যানা, তুই খালি ভয় পাচ্ছিলি। ভদ্রলোক তো বেশ ভালই, মোটেই সাংঘাতিক কিছু নয়।
হ্যাঁ, সেরকমই তো দেখলাম। আমি ভেবেছিলাম হয়ত জেরায় জেরায় নাজেহাল করে দেবে।
রোডা অল্প ইতস্তত করে বলল, অ্যানা, তুই যে ক্রফটওয়েতে থাকার কথা কিছু বললি না? ভুলে গিয়েছিলি?।
না। অ্যানার শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, মাত্র কদিন সেখানে ছিলাম, আমার মনে হয় কথাটা খুব একটা জরুরী নয়। সেখানকার কোন লোকও আমায় চেনে না। তবে তোর যদি দরকারি মনে হয় আমি ব্যাটেলকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিতে পারি। যদিও মনে হয় না খুব একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হবে, ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন কি?।
না দরকার আর কি? মনে হলো তাই বললাম। রোডা উঠে দাঁড়াল।
আরে মঁসিয়ে পোয়ারো! পোয়ারোকে দেখে অবাক হলেন মেজর ডেসপার্ড, আপনি এই বাসে? কি আশ্চর্য্য!
পোয়ারো মনে মনে হাসলেন। এইভাবে দেখা হয়ে যাওয়াটায় যে আশ্চর্যের কিছুই নেই তা তিনি ছাড়া আর কে জানে? ডেসপার্ড কখন হোটেল থেকে বেরোবেন তিনি সময়টা আন্দাজ করেছিলেন। সেই অনুযায়ী অপেক্ষাও করেছিলেন রাস্তাতে। দূর থেকে ভদ্রলোককে এগিয়ে আসতে দেখে পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে পরের বাসস্টপেজে দাঁড়ান। ডেসপার্ডের মত ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বাসে ওঠেননি তিনি। বাস থামলে ধীরে সুস্থে উঠেছেন।
মিঃ শেটানের ব্যাপারটায় আপনারা কিছু করে উঠতে পারলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমি শুধু চিন্তা করি। এই বয়সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে তদন্ত করা আমার সহ্য হয় না।
আরে সেটাই তো সবচেয়ে ভাল ব্যাপার। লোকে অনর্থক দৌড়োদৌড়ি করে। কোন কাজে এগোবার আগে যদি শান্ত হয়ে ব্যাপারটা ভাল ভাবে চিন্তা করে নেয় তবে পণ্ডশ্রম-এর ঝামেলা যাবে না।
জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি তাই মেজর ডেসপার্ড?
প্রায় ক্ষেত্রেই তাই। সহজ মনে উত্তর দিলেন ডেসপার্ড। আমিও আগে জিনিসটা তলিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি, কি ভাবে এগোব সেটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নিই-তারপর সেইভাবে কাজ।
পোয়ারোর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এরপর কি আপনার সিদ্ধান্তের নড়চড় হয় না? কোন বাধাই আপনার পথ আটকে দাঁড়ায় না।
না না, ব্যাপারটা সেরকম নয়। ভুল হলে আমি অবশ্যই শোধরাবার চেষ্টা করি।
আপনার ভুল বোধ হয় খুব কম হয়!
মানুষ মাত্রই তো ভুল করে মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনার কি কোনদিনই ভুল হয়নি?
শেষ ভুলটা হয়েছিল আঠাশ বছর আগে। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, তারপর দু একবার ভুলের সম্ভাবনা দেখা দিলেও কোন ভুল হয়নি।
দারুণ ব্যাপার তো। মেজর ডেসপার্ড উৎসাহের সুরে বলেন, মিঃ শেটানের খুনের তদন্ত কি আপনি করছেন? অবশ্য যা শুনেছি আপনাকে বোধহয় সরকারিভাবে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
না, সরকারিভাবে আমাকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়নি। তবুও এ-ব্যাপারে কেসটা আমি নিজে থেকেই নিয়েছি। আমারই নাকের ডগায় বসে খুন করে যাবে এতটা স্পর্ধা সহ্য করা যায় না। খুনি শুধু আমাকেই নয় স্কটল্যান্ডে ইয়ার্ডকেও ব্যঙ্গ করেছে। আসলে সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলকে যতটা বোকা মনে হয় তা তিনি নন, খুবই চালাক চতুর। ব্যাপারটা নিয়ে তিনিও উঠে পড়ে লেগেছেন–
হ্যাঁ আমিও জানি। পেছনের সীটে ঐ কাঠখোট্টা চেহারার লোকটাকে দেখুন।
পোয়ারো পেছন ফিরে তাকালেন, কই কেউ নেই তো!
তাহলে নিশ্চয়ই বাসের মধ্যে কোথাও না কোথাও আছে। আমার পেছনে সবসময় লেগে আছে, ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ। তবে আমার কাছে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়। কালো নিগ্রো হলেও, আমি একবার যে মুখ দেখি ভুলি না সহজে।
বাঃ ঠিক আপনার মত লোককেই দরকার আমার। পোয়ারো খুশি হয়ে বলেন, যার নজর তীক্ষ্ণ এবং স্মৃতিশক্তিও প্রখর। আপনি হয়ত আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। ডাঃ রবার্টস, মিসেস লরিমার কেউই আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারলেন না
আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। মেজর ডেসপার্ড অবাক হলেন।
সে সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের খুন হবার আগে যে ঘরে বসে আপনারা তাস খেলছিলেন, সেই ঘরের জিনিসপত্রের একটা সঠিক বিবরণ দিন আমাকে। মানে কোন কোন জিনিস আপনার নজরে পড়েছিল–
আমি বোধহয় সেরকম কিছুই বলতে পারব না। যতদূর মনে পড়ছে ঘরটা জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল–অনেকগুলো আলনা, সিল্কের জামাকাপড়, আরো কত কি–
ঠিক কি কি জিনিস ছিল?
ডেসপার্ড হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, বিশেষ লক্ষ্য করিনি। কয়েকটা ভাল জাতের কম্বল–পারস্য বা ঐ সমস্ত দেশ থেকে আনা নানা রকম কতগুলো মূর্তি, কয়েকটা ছবি দেওয়ালে টাঙানো ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকার একটা বড় সাইজের কৃষ্ণসার হরিণের মাথা-ওঃ ওটা বোধহয় পাশের ঘরে টাঙানো দেখেছিলাম।
মিঃ শেটানের শিকারের নেশা ছিল বলে মনে হয় না।
কক্ষনো না। ঘরে বসে তাস দাবা খেলা ছাড়া আর তার কোন কাজ ছিল না। তবে ঘরে আর কি কি ছিল মনে পড়ছে না, টেবিলের ওপর পালিশ করা একটা কাঠের মূর্তি দেখেছিলাম এটা বেশ মনে আছে। আর তো মনে নেই।
পোয়ারো একটু গম্ভীর হলেন, যাকগে, মনে না পড়লে আর কি করা যাবে। মিসেস লরিমারের কিন্তু আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, সেদিনের খেলার প্রত্যেকটা তাসের ডাক কখন কি, রকম হয়েছিল একেবারে নিখুঁতভাবে বলেছিলেন–আপনার বোধহয় তাসের কথা কিছুই মনে নেই মেজর ডেসপার্ড?
না। স্বীকার করলেন ডেসপার্ড। দেখুন, বয়স্কা মহিলারা যাদের খালি ক্লাবে বা পার্টিতে তাস খেলে বেড়ানো অভ্যেস তাদের তো তাসের সমস্ত কথা মনে থাকবারই কথা। তাসই যাদের ধ্যান জ্ঞান। সেদিনের খেলায় দু একটা তাসের কথা আমার মনে পড়ছে। একবার রবার্টসের ভাওতায় ঘাবড়ে গিয়ে পাঁচটা ডায়মন্ডের গেমটা ডাকতে পারিনি। ভদ্রলোক অবশ্য গোটা দু-তিন শট দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা ডবল দিইনি বলে লোকসানই হল। আর একটা নো-ট্রাম্প গেমে আমি খেলতে পারলাম না। দুটো শর্ট দিলাম।
আপনি বোধহয় ব্রীজের থেকে স্পেকার খেলতেই বেশি পছন্দ করেন? পোয়ারো তাকালেন মেজর ডেসপার্ডের দিকে।
ঠিকই ধরেছেন, মেজর ডেসপার্ড মৃদু হাসলেন। পোয়ারোর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, মিঃ শেটানের তাসে খুব একটা উৎসাহ ছিল বলে মনে হয় না।
কিন্তু অন্যকে ভয় দেখানোর খেলায় তার বেশ উৎসাহ ছিল–বিশেষতঃ মেয়েদের ভয় দেখিয়ে খুব আনন্দ পেতেন।
একথা কি আপনি আগেই জানতেন, না এখন মনে হলো। মেজর ডেসপার্ড একটু বিব্রত হয়ে পড়লেও খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। আমার কথাটার অর্থ বিশদভাবে জানতে চাইছেন তো? এ হল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা–খুব গোপন সূত্র থেকে জানতে পেরেছি।
ভদ্রলোককে কি ব্ল্যাকমেলার বলে মনে হয় আপনার?
ডেসপার্ড মাথা নাড়লেন, ব্যাপারটা আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। একভাবে ব্ল্যাকমেলার তো বলা যায়ই–তবে এর পিছনে টাকার চাহিদা ছিল না। শেটান অন্যের গোপন খবর জোগাড় করে মানুষকে ভয় দেখাতে ভালবাসতেন। বলা যেতে পারে নিছক নোংরা আনন্দেই এসব করে বেড়াতেন তিনি। আর মেয়েদের কাছ থেকে গোপন খবর বের করা বেশ সোজা। একবার যদি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারেন যে আপনি ব্যাপারটা জানেন-ব্যাস, বাকিটা তারা নিজেরাই জানিয়ে দেবে আপনাকে।
মিস মেরিডিথকেও কি তিনি এরকম ভয় দেখিয়েছিলেন? শান্ত কণ্ঠে পোয়ারো প্রশ্ন। করলেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেজর ডেসপার্ডের দিকে।
মিস মেরিডিথ! অবাক হলেন ডেসপার্ড–তার কথা তো আমি ভাবছি না। আর শেটানকেই বা তিনি ভয় পেতে যাবেন কেন?
তবে কি মিসেস লরিমার?
আরে না না। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে আমি বলছি না, শেটানের চরিত্র কেমন ছিল–এটাই আমার বক্তব্য। আর মিসেস লরিমারকে ভয় দেখানো অত সোজা নয়।
মেয়েদের মনের কথা, বিশেষ করে গোপন কথা বের করতে মিঃ শেটান খুবই পটু ছিলেন, এটা ঠিকই। পোয়ারো শান্তভাবে বললেন।
লোকটা তো একেবারে নির্বোধ ছিল–সেরকম বিপজ্জনকও নয়–অথচ মেয়েরা কেন যে ভয় পেতকথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন মেজর ডেসপার্ড। আরে, কথা বলতে বলতে আমার স্টপেজ ছাড়িয়ে চলে এসেছি। আচ্ছা, মঁসিয়ে পোয়ারো, কবে আবার দেখা হবে। জানালা দিয়ে একটু লক্ষ্য করুন, আমার অনুসরণকারীকেও দেখতে পাবেন, আমার সাথে সাথে বাস থেকে নামবে নিশ্চয়ই।
লম্বা পায়ে চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লেন মেজর ডেসপার্ড। পোয়ারো অবশ্য তার অনুসরণকারীকে খোঁজার কোন চেষ্টা করলেন না। কেউ হবে হয়ত। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা, বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়– বিড় বিড় করে বললেন পোয়ারো, সত্যি ভারী আশ্চর্য্যের তো!
মিসেস লরিমার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সিঁড়ির মাথায়। তার মুখে বিভিন্ন অভিব্যক্তির ছাপ একের পর এক খেলে চলেছে–কখনো দ্বিধা, কক্ষনো সংশয়, বিস্ময়, নিশ্চিন্ত। তার দীর্ঘ জ্বজোড়া কুঁচকে উঠল, কি যেন চিন্তা করছেন তারপর নিচে নেমে এলেন ধীরে ধীরে। তখনি রাস্তায় তার চোখ পড়ল অ্যানা মেরিডিথের দিকে, একটা আকাশ ছোঁয়া বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানা। মিসেস লরিমার একটু ইতস্তত করে রাস্তা পেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলেন।
কেমন আছেন মিস মেরিডিথ?
চমকে ফিরে তাকাল অ্যানা, ওঃ আপনি? অনেকদিন বাদে আবার দেখা হল।
লন্ডনেই আছেন এখনো?
না না, একটা বিশেষ কাজে লন্ডনে এলাম আজ। অ্যানা ঘন ঘন ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে।
ওদিকে অত তাকাচ্ছেন কেন মিস মেরিডিথ? কোন দরকার আছে?
কই না কিছুই নয়।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কোন ব্যাপার আছে। মৃদু হাসলেন মিসেস লরিমার।
হ্যাঁ–মানে ইয়ে, অ্যানা আমতা আমতা করে, আসলে আমার এক বন্ধুকে যেন বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখলাম। সত্যি সত্যি রোডাই তো? এই বাড়িতে মিসেস অলিভার থাকেন। আমাদের ওখানে বেড়াতে গিয়ে এ বাড়িটারই ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি।
আপনি কি দেখা করবেন মিসেস অলিভারের সঙ্গে?
না, আজ আর যাব না।
তবে চলুন, এক কাপ চা খাওয়া যাক। মিসেস লরিমার একটা নিরিবিলি রেস্তোরাঁতে অ্যানাকে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অ্যানাই প্রথম মুখ খুললেন, মিসেস অলিভার আপনার কাছে যাননি?
মঁসিয়ে পোয়ারো ছাড়া আর কেউই আমার কাছে যায়নি।
আমি ঠিক তা জিজ্ঞসা করিনি।
করেননি? কিন্তু আমার যেন মনে হলো আপনি এটাই জিজ্ঞাসা করছেন। অবাক হলেন মিসেস লরিমার।
অ্যানার চোখে ভয়ের ছায়া দেখা দিল। কিন্তু মিসেস লরিমার আগের মতই নির্বিকার। অ্যানা চট করে সামলে নিল নিজেকে।
মঁসিয়ে পোয়ারো আমার কাছে যাননি। আচ্ছা সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। মিসেস লরিমারের জবাব।
অ্যানা একটু ইতস্তত করে বলে, কি প্রশ্ন করলেন?
যেমন নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে যাকে সে রকমই। তবে ব্যাটেলের ব্যবহার খুব ভাল।
ভদ্রলোক মনে হয় সকলের সঙ্গেই দেখা করেছেন।
মিসেস লরিমার, আপনার কি মনে হয়, অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবে পুলিশ?
মিসেস লরিমারের চোখে অদ্ভুত একটা ছায়া খেলে গেল, আপনার বয়স কত মিস মেরিডিথ?
আমার বয়স? আমার অ্যানা তোতলাতে লাগল, পঁচিশ।
আমার তেষট্টি, মিসেস লরিমারের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আপনার সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে–
কেন? আমি তো আজই অ্যাক্সিডেন্টে মারাও যেতে পারি? অ্যানা ভয় পাওয়া গলায় বলে ওঠে।
হতে পারে। আবার হয়ত সারা জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না।
মিসেস লরিমারের কথায় অদ্ভুত ভঙ্গীমায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অ্যানা।
জীবন কত জটিল, আপনমনে বলতে থাকেন মিসেস লরিমার, বেঁচে থাকতে গেলে চাই প্রচণ্ড সাহস আর সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা। অথচ জীবনের শেষ সময় দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যিই কি এর কোন দরকার ছিল?
ওভাবে বলবেন না, অ্যানা ভয় পাওয়া গলায় বলে। মিসেস লরিমার মৃদু হাসেন, জীবন নিয়ে কথাবার্তা হয়ত খুব সস্তা দরের নাটকীয়তা হয়ে যাচ্ছে। বড্ড সস্তা। বেয়ারার বিল মিটিয়ে রাস্তায় চলে এলেন দুজনে। একটা ট্যাক্সি পেয়ে অ্যানাকে লিফট দিতে চাইলেন মিসেস লরিমার। অ্যানা ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিল, কেননা একটু দূরেই রোডাকে দেখতে পেয়েছে সে। রোডার কাছাকাছি হতেই অ্যানা তীক্ষ্ম গলায় প্রশ্ন করে, রোডা, তুই মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি?
হ্যাঁ, কেন তাতে কি হয়েছে?
তা হলে ঠিকই ধরেছি।
এতে আবার ধরাধরির কি আছে। আমি কি চুরির দায়ে ধরা পড়েছি না কি? তুইও তো এতক্ষণ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলি।
হঠাৎ মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি কেন?
বাঃ! তিনি তো আমাদের যেতে বলেছিলেন।
সে তো কথার কথা। সকলেই ওরকম বলে। আমি তো তাই নিয়েছি।
না রে তুই ভুল বুঝছিস। ভদ্রমহিলার মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। এই যুগের ব্যবহার, দেখ না আমাকে নিজে থেকেই একটা বই উপহার দিলেন।
অ্যানা তবুও নিঃসন্দেহ হতে পারে না। কি ব্যাপারে কথা হল? আমার ব্যাপারে নিশ্চয়ই নয়?
বোকা মেয়ে, কিসব উদ্ভট ধারণা করে বসে আছিস?
সত্যিই কি কিছু বলিসনি? এই খুনের ব্যাপারে কথা হল না?
না না। বরং তার উপন্যাসের খুন-খারাপি নিয়ে, গল্পের প্লট এসব নিয়ে কথা হল। কেমনভাবে প্লট তৈরি করেন বললেন। জানিস অ্যানা আমাকে ব্ল্যাক কফি আর টোস্ট খাওয়ালেন মিসেস অলিভার। গর্বের সুরে বলে রোলা, তারপর অল্প থেমে কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করে, তুই চা খেয়েছিস?
হ্যাঁ। মিসেস লরিমার-এর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল তিনি-ই খাওয়ালেন।
মিসেস লরিমার? ও! বোধহয় সেই খুনের ঘটনার দিন উপস্থিত ছিলেন তিনি, তাই না? ভদ্রমহিলা কেমন রে?
আগের বার যেরকম দেখেছিলাম, একটু যেন পরিবর্তন হয়েছে। কেমন যেন ব্যাপার মনে হল।
তোর কি মনে হয় খুনটা ভদ্রমহিলাই করেছেন? অ্যানা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, রোডা, বহুবার বলেছি এসব আলোচনা আমি পছন্দ করি না।
আচ্ছা, আচ্ছা, বেশ। তোর সেই সলিসিটার কেমন লোক? খুব কাঠখোট্টা? আইনের অন্ধিসন্ধি মুখস্থ?
না, ভদ্রলোক বেশ ভালোই। চল, চল। বাড়ি ফিরব, ঐ দেখ প্যাডিংটন যাবার বাস ছাড়ছে।
আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, মিসেস অলিভারও এসে পড়েছেন দেখছি। আসুন আসুন। সকলের সঙ্গে করমর্দন করেন ব্যাটেল। তিনিই মঁসিয়ে পোয়ারো আর মিসেস অলিভারকে ডেকে পাঠিয়েছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।
আমার মনে হয় এখন আমাদের মধ্যে একটা আলোচনা হওয়া দরকার। কে কতদূর এগোলাম, কি কি তথ্য জানা গেল? এ জন্যই আজ আপনাদের ডেকেছি। কর্নেল রেসও এসে পড়বেন এক্ষুনি। ব্যাটেলের কথা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই কর্নেল রেস ঘরে ঢুকলেন।
আমার বোধহয় দেরি হয়ে গেল। মিসেস অলিভার কেমন আছেন? মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার জন্য সকলেই বোধহয় অপেক্ষা করছেন। খুবই দুঃখিত। আসলে আমাকে কয়েকটা দরকারি কাজ সেরে নিতে হল, কালকেই একটা পাটির সঙ্গে বেলুচিস্তান রওনা হব।
আমাদের এ ব্যাপারটায় কোন খোঁজ খবর আনতে পারলেন? প্রশ্ন করেন ব্যাটেল।
হ্যাঁ মেজর ডেসপার্ডের বিষয়ে কিছু খবরাখবর জোগাড় করেছি। কতগুলো টাইপ করা কাগজ ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন কর্নেল রেস। কখন, কোথায়, কোন দেশে গিয়েছিলেন সবকিছু, তারিখ, নাম, খুঁটিনাটি লেখা আছে। মনেহয় দরকার নেই এগুলোর। মেজর ডেসপার্ডের নামে কোথাও কোন অভিযোগ, নিল শাইনি। শক্ত পোক্ত বলিস্ট পুরুষ। সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে চলেছেন। যখন যেখানে গেছেন প্রিয় হয়ে উঠেছেন, কেউই নিন্দা করেনি মেজর ডেসপার্ডের। কথা বলেন কম, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক। তার হাতের টিপ নিখুঁত। বিপদে বুদ্ধি হারান না। দূরদৃষ্টি আছে এবং নির্ভরযোগ্য পাকা ভদ্রলোক।
কোথাও কোন অ্যাক্সিডেন্ট বা আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল? ব্যাটেলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
সে ব্যাপারেও খোঁজ নিয়েছি। একবার তার একজন অনুচরকে সিংহের থাবা থেকে বাঁচিয়েছিলেন নিজের জীবন বিপন্ন করে!
মৃদু হাসলেন কর্নেল রেস। তবে হ্যাঁ, আপনার পছন্দমত একটা খবর আমার সংগ্রহে আছে। একবার বিখ্যাত বটানিস্ট ল্যাক্সমোর আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বনে শিখার করতে গেছিলেন ভদ্রলোক। অধ্যাপক এক ধরনের কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমাজন নদীর তীরে, সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যেই তাকে কবর দেওয়া হয়।
কালাজ্বর?
হ্যাঁ, তবে এটা গুজবও শুনেছি। ঐ অভিযানে দুএকজন আদিবাসীও কাজের লোক হিসাবে গেছিল। তাদের একজনকে চুরির অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়। পরে সে-ই ব্যাপারটা রটিয়ে দেয়। তার বক্তব্য–অধ্যাপক কালাজ্বরে মারা যাননি, তাকে গুলি করে মারা হয়েছিল। অবশ্য মেজর ডেসপার্ড পরিচিত ব্যক্তি, সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাই ঐ গুজবে কেউ কান দেয়নি।
কতদিন আগেকার ব্যাপার?
কর্নেল রেস মাথা নাড়লেন। আমি কিন্তু মেজর ডেসপার্ডকে খুনি মনে করিনি। এসব খুন-টুন তার দ্বারা সম্ভব নয়।
কিন্তু ভদ্রলোক যদি একবারও ভাবেন, কারো বেঁচে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়, মৃত্যুই তার উপযুক্ত পাওনা তাহলে তাকে সেই যোগ্য শাস্তি দিতে দ্বিধাবোধ করবেন না মেজর ডেসপার্ড।
হতে পারে। তবে ঐ ধরনের কিছু ঘটলে তার সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই যুক্তির অভাব হবে না।
ব্যাটেল অধৈর্যভাবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু তা বলে সভ্য সমাজে কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।
তবুও এ-রকমটাই ঘটে চলেছে। চলবেও। সে যাক, আমি বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারব না। বেশ কয়েকটা কাজ বাকি আছে। তবে এই খুনের ব্যাপারটায় শেষ অবধি কি হয় এটা জানতে আমি খুবই আগ্রহী। কোন নিষ্পত্তি না হলেও অবাক হব না। কারণ খুনি কে জানতে পারলেও কোর্টে প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে। আমি আমার কর্তব্য করেছি। যদিও আমার মনে হয় ডেসপার্ড খুনি নন। মিঃ শেটান হয়ত কোন ভাবে ল্যাক্সমোরের মারা যাবার ব্যাপারে গুজবটা শোনেন। ডেসপার্ড কিছুতেই খুনি নন। আর মানুষ চিনতে আমার খুব একটা ভুল হয় না।
ব্যাটেল প্রশ্ন করেন, মিসেস ল্যাক্সমোর কিরকম মহিলা?
তিনি এখন লন্ডনেই থাকেন। আপনারা নিজেরাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এই কাগজে তার ঠিকানাও দেওয়া আছে। তবুও আবার বলছি মেজর ডেসপার্ড আপনাদের লক্ষ্যবস্তু নন।
কর্নেল রেস সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
হয়ত ঠিকই বলে গেলেন ভদ্রলোক, বিড় বিড় করলেন ব্যাটেল। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে ওঁর গভীর জ্ঞান আছে। কিন্তু তবু প্রমাণ ছাড়া কাউকে নির্দোষ ভাবা যায় না। কর্নেল রেসের রেখে যাওয়া কাগজপত্র দেখতে দেখতে ব্যাটেল নিজেও কিছু কিছু নোট করে নিতে লাগলেন।
তাহলে সুপারিনটেন্ডেন্ট, মিসেস অলিভার তাকালেন ব্যাটেলের দিকে, কিভাবে এগোচ্ছেন কিছুই বললেন না?
ব্যাটেল মৃদু হাসলেন, এখনো সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। সবই খাপছাড়া।
ওঃ! আপনি আসলে বলতে চাইছেন না, বুঝেছি। মিসেস অলিভার বলে ওঠেন।
না, না। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল, আমি সব কিছুই বলতে চাই
তাহলে বলুন! মিসেস আলভার খুব উৎসাহ দেখান।
প্রথমেই যে কথাটা বলব, তা হল মিঃ শেটানকে কে খুন করেছে এ সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গও আমি জানতে পারিনি–মানে কোন সূত্রই পাওয়া যায়নি। চারজনের প্রতিই আমার সমান সন্দেহ রয়েছে। নজর রাখা হয়েছে সকলের ওপরই। যদিও আমার মনে হয় না এতে কোন ফল পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় মঁসিয়ে পোয়ারো যা বলেছিলেন সেই একটা পথই আছে-অতীত। এদের চারজনেরই অতীত ঘেঁটে বার করতে হবে কে কি অপরাধ করেছিল। তার থেকেই আমরা হয়ত এই খুনটার হদিশ পেতে পারি। তবে এর মধ্যেও একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে, সত্যিই কি কোন অপরাধ করেছিল এরা? মিঃ শেটান হয়ত নিছক ঠাট্টা করেছিলেন মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে।
এদের অতীত সম্বন্ধে কোন খবরা খবর করেছেন?
হ্যাঁ, এদের মধ্যে ডাক্তার রবার্টসের ওপরেই আমার কিছুটা সন্দেহ হয়।
কি রকম? মিসেস অলিভার বলে ওঠেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো জানেন আমি সব রকমের থিওরিই হাতে-কলমে প্রয়োগ করে দেখেছি। খবর নিয়ে জেনেছি রবার্টসের কোন নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কেউই হঠাৎ মারা যাননি। তবে তার অতীত ঘেঁটে একটামাত্র ঘটনার সন্ধান পেয়েছি যা এই খুনের মামলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয়। অবশ্য নাও হতে পারে। যাই হোক, আমাদের এখানকার একজন সার্জেন্ট মিসেস ক্যাডক নামে এক মহিলার বাড়ির কাজের লোকের কাছ থেকে ডাঃ রবার্টসের সম্বন্ধে এই তথ্য জোগাড় করেছে।
৩. একটা গোলমেলে ব্যাপার
ডাক্তার রবার্টস এক সময় তার এই মহিলা পেশেন্ট মিসেস ক্র্যাডকের সঙ্গে একটা গোলমেলে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। ডাঃ রবার্টসের ওপর প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন মিঃ ক্র্যাডক। তার বাড়িতেই মিসেস ক্র্যাডককে দেখতে এসেছিলেন ডাঃ রবার্টস। হঠাৎ ভদ্রমহিলার স্বামী রেগে গিয়ে ডাঃ রবার্টসকে শাসিয়ে দেন তার নামে মেডিক্যাল কাউন্সিলে রিপোর্ট করবেন বলে। ডাঃ রবার্টস তখন ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে শান্ত করে বলেন যে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুল। মিঃ ক্র্যাডক অযথাই ডাঃ রবার্টসকে সন্দেহ করছেন। তিনি আর কখনই মিঃ ক্র্যাডকের বাড়িতে আসবেন না। এরপর শান্ত হন এবং ডাঃ রবার্টস বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে বিদায় নিয়ে চলে যান। অফিসে চলে যান মিঃ ক্র্যাডক।
তারপর? মিসেস অলিভার-এর কৌতূহলী প্রশ্ন ভেসে এল।
মিঃ ক্র্যাডক এর কিছুদিনের মধ্যেই অ্যানথ্রাক্স রোগে মারা যান।
অ্যানথ্রাক্স? সে তত গবাদি পশুদেরই হয়ে থাকে?
হ্যাঁ। আপনার হয়ত মনে আছে সস্তা দামের এক ধরণের সেভিং ব্রাশ নিয়ে একসময়ে বাজারে খুব গণ্ডোগোল শুরু হয়েছিল–অধিকাংশই নাকি দূষিত ছিল। মিঃ ক্র্যাডকের সেভিং-ব্রাশটাও দূষিত ছিল বলে পরে প্রমাণিত হয়।
ডাঃ রবার্টস কি তার চিকিৎসা করেছিলেন?
না না। তিনি খুবই ধুরন্ধর। অবশ্য হয়ত মিঃ ক্র্যাডকও চাইতেন না। একটাই মাত্র সন্দেহজনক সূত্র আমার নজরে এসেছে–খোঁজ নিয়ে জেনেছি ডাঃ রবার্টসের একজন পেশেন্ট সে সময় অ্যানথ্রাক্স রোগে ভুগছিলেন।
আপনি কি মনে করেন ডাঃ রবার্টস ভদ্রলোকের সেভিং-ব্রাশটা দূষিত করে রাখেন?
হ্যাঁ। আমার তাই মনে হয়। যদিও সবটাই অনুমান তবুও একেবারে অসম্ভব নয়।
মিসেস ক্র্যাডকের কি হল?
তিনিও কিছুদিন বাদে হঠাৎ পাততাড়ি গুটিয়ে শীতকালে মিশরে চলে গেলেন, এক ধরনের সাংঘাতিক সংক্রামক রোগে তিনি ওখানেই মরা যান–তার শরীরে সমস্ত রক্ত দূষিত হয়ে গিয়েছিল। এই অসুখটার কি একটা লম্বা চওড়া নাম আছে। মিশরেই নাকি এই অসুখ হয় বেশি।
এর মধ্যে ডাক্তারের কোন হাত নেই বলতে চান?
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, এ বিষয়ে আমার এক জীবাণু বিশেষজ্ঞ বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছে। সে আবার কোন স্পষ্ট কথা বলতেই রাজি নয়–ভাসা ভাসা মতামত দেয়। তবে একটা কথা জানতে পেরেছি এবং সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার সেই বন্ধুর মতে–ডাক্তার রবার্টসের পক্ষে মিসেস ক্র্যাডকের ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তার শরীরে জীবাণু ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব। কারণ জীবাণু শরীরে ঢোকার বেশ কিছুদিন বাদে এই অসুখের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।
মিসেস ক্র্যাডক কি মিশরে যাবার আগে টাইফয়েডের প্রতিষেধক কোন ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
ঠিক তাই মঁসিয়ে পোয়ারো। মিশরে যাবার আগে মিসেস ক্র্যাডক ডাঃ রবার্টসের কাছে দুটো ইঞ্জেকশন নিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা ঘুরে ফিরে সেই একই সত্যে ফিরে আসছি। প্রমাণ কোথায়? ইঞ্জেকশন দুটো রোগের প্রতিষেধকও হতে পারে অথবা অন্যকিছুও। আমরা নিশ্চিত হতে পারছি কোথায়? সবটাই অনুমান।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। মিঃ শেটানের একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি সেই খুনিদের কথাই বলেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে কোর্টে কোন প্রমাণ দাখিল করা যাবে না।
কিন্তু মিঃ শেটান এত খবর জোগাড় করলেন কি করে? মিসেস অলিভারের প্রশ্নে তার দিকে তাকালেন পোয়ারো, এ সম্বন্ধে কিছুটা অনুমান করে নেওয়া যায়। শেটান একসময় মিশরে গেছিলেন, সেখানেই মিসেস লরিমারের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি হয়ত মিসেস ক্র্যাডকের রোগের লক্ষণ সম্পর্কে কোন ডাক্তারের সন্দেহজনক মন্তব্য শুনেছিলেন। ক্র্যাডক পরিবারের গণ্ডগোলে ডাক্তার রবার্টসের জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা আগে থেকে নিশ্চয়ই জানতেন মিঃ শেটান। তার ফলেই কিছু একটা ভেবে নিয়েছিলেন। ডাঃ রবার্টসও হয়ত অসর্তক কোন মুহূর্তে কোন কথা বলেছিলেন শেটানকে। মিঃ শেটানও লোকের গোপন কথা বের করতে ভালই পারতেন। এখন কথা হল শেটানের সন্দেহ ঠিক কিনা?
আমার মনে হয় তিনি নির্ভুল। ব্যাটেল বললেন, ডাঃ রবার্টস যে একজন খুনি কোন সন্দেহ নেই। মিঃ ক্র্যাডককে তিনিই খুন করেছেন। মিসেস ক্র্যাডককে খুন করাও তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু মিঃ শেটানকে কি তিনি খুন করেছেন? এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়। মিঃ ক্র্যাডককে খুন করার ব্যাপারে তিনি তার চিকিৎসা বিষয়কেই কাজে লাগিয়েছেন। যার ফলে সকলের কাছে মৃত্যুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। আমার মতে যদি তিনি শেটানকে খুন করার কথা ভাবতেন তবে ছুরির বদলে অন্য কোন পদ্ধতির কথা ভাবতেন।
জানাকথাই তো-র ওপর সন্দেহ হয় প্রথমে, সে কখনই খুনি হতে পারে না। ডাক্তার রবার্টস খুনি নন। মিসেস অলিভার মন্তব্য করেন।
তাহলে সন্দেহের লিস্ট থেকে ডাক্তার রবার্টস বাদ পড়লেন, রইল বাকি–তিন! পোয়ারো মৃদু হাসলেন।
ব্যাটেল বলতে শুরু করলেন অন্যদের বিশেষ কিছু খবর নেই। ডেসপার্ডেরটা আগেই শুনলেন। বছর কুড়ি হল বিধবা হয়ে লন্ডনে বাস করছেন মিসেস লরিমার। শীতকালে মাঝে-মধ্যে রিভারিয়া, মিশর এ-সমস্ত দেশে বেড়াতে যান। কোন সন্দেহজনক মৃত্যুর সঙ্গে তার কোন সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার মতো ভদ্রমহিলার যেভাবে জীবনযাপন করা উচিত, সেরকম সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সম্মানীয় জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করে। তার সম্বন্ধে লোকের ধারণাও খুব উঁচু। তার একটাই দোষ, যদি এটাকে দোষ বলা যায়–তবে বোকামি একদম সহ্য করতে পারেন না। আমি সবদিক দিয়ে খোঁজখবর করে দেখেছি কোন দোষ খুঁজে পাইনি। একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে, অন্ততঃ মিঃ শোন তো তাই ভাবতেন।
ব্যাটেল হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, তারপর সংক্ষেপে মিস মেরিডিথের সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্য সকলকে জানিয়ে বললেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি সব খবরগুলোই ঠিক। মেয়েটি মিথ্যে বলছে না।
তারপর সুইজারল্যান্ড, উইলিং ফোর্ড এখানেও তার সম্বন্ধে কোন সন্দেহজনক খবর পায়নি।
তাহলে মেরিডিথও বাদ যাচ্ছে লিস্ট থেকে? জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো।
ঠিক এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারব না। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। কোথাও একটা গোলমাল আছে। মিস মেরিডিথের চোখমুখে প্রায়ই একটা ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে যেটাকে শুধু মাত্র শেটানের জন্য একথা বলতে রাজি নই। চারিদিকেই তাই ভয়-চকিত নজর, সব সময়ই কোন একটা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই কোন সাংঘাতিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তবে ঐ যে বললাম মিস মেরিডিথ নির্দোষ জীবনযাপন করে।
মিসেস অলিভারের চোখের তারা চক চক করে উঠল। কিন্তু তবুও অ্যানা একসময় এমন একটা বাড়িতে এক ভদ্রমহিলা ওষুধের বদলে ভুল করে এক ধরণের বিষাক্ত মালিশ খেয়ে মারা যান।
তার কথা শেষ হতে না হতে উত্তেজনায় ব্যাটেল চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এ খবর আপনি কোথা থেকে পেলেন?
এ হল আমার একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরির ফল। মিসেস অলিভারের খুবই গর্বিত জবাব- ওদের ওয়েলডন কুটিরে গিয়ে এক আষাঢ়ে গল্প ফাঁদলাম, ডাঃ রবার্টসকেই আমার সন্দেহ। যোডা মেয়েটা ভাল, কি ভাল ব্যবহার করল আমার সঙ্গে। কিন্তু অ্যানা মোটেই পছন্দ করল না আমাকে এবং সে কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েও দিল, খুবই সন্দেহপ্রবণ মেয়ে, যদি গোপন কিছু না-ই থাকবে তবে অত সন্দেহ কিসের? আমি ওদের দুজনকেই লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম–রোডাই এসেছিল। ওর মুখ থেকেই সব ঘটনা শুনলাম।
কখন, কোথায় এটা ঘটেছিল জানতে পেরেছেন?
ডেভনশায়ারে তিন বছর আগে
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল ঝড়ের বেগে প্যাডের ওপর পেন্সিল দিয়ে নোট করতে লাগলেন।
চেয়ারে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলেন মিসেস অলিভার–নিজের কেরামতিতে তিনি খুবই গর্বিত।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিসেস অলিভার। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল অভিনন্দন জানালেন। খুব দামী খবর যোগাড় করে আমাদের সকলের ওপর টেক্কা দিয়েছেন আপনি। মিসেস এল্ডনের বোন অবশ্য–
হঠাৎ পোয়ারো প্রশ্ন করলেন মিসেস এল্ডন, অর্থাৎ মিস মেরিডিথ প্রথমে যে বাড়িতে কাজ করত সে বাড়ির কর্ত্রী, তিনি কি খুব অগোছালো টাইপের মহিলা?
ব্যাটেল খুব অবাক হলেন। হ্যাঁ। তার বোনের সঙ্গে কথায় কথায় মিসেস এন্ডনের অগোছালো স্বভাবের কথা উঠেছিল বটে। কিন্তু আপনি কি করে এ খবর পেলেন?
এমনিই, হঠাৎ আমার মনে হল তাই। যাক আপনি যে কথা বলছিলেন বলুন।
বলছিলাম মেরিডিথের কথা। ব্যাটেল আবার শুরু করলেন, মিসেস এন্ডনের বোন আমাকে বলেছিলেন, অ্যানা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডেভনশায়ারে চলে যায়। কোথায় গেছে, কার বাড়িতে, এত খবর দিতে পারেনি। তবে মনে হয় সেখানে বেশিদিন থাকেনি। মেয়েটা এত মিথ্যেবাদী, আমাকে ঠকিয়েছে। আর যদি ডেভনশায়ারের ব্যাপারটা দুর্ঘটনাই হবে তো তার এত ভয় কেন? সে যদি সম্পূর্ণ নির্দোষই হয়?
পোয়ারো আপন মনে বিড় বিড় করলেন, সত্যিই আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে–
পোয়ারো এখন ক্রম্পটন রোড ধরে হেঁটে চলেছেন। একটু আগেই মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেছিলেন পোয়ারো। গেছিলেন অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য জানতে। প্রথমে মিসেস ল্যাক্সমোর কিছুই বলতে রাজি হননি। কিন্তু পোয়ারো তার নিজের কায়দায় সমস্ত কথাই আদায় করে ছেড়েছেন। ঘটনাটা হল এই :
মিসেস ল্যাক্সমোর তার স্বামীর সঙ্গে আমাজন নদীর কাছাকাছি অঞ্চলে এক অভিযানে গেছিলেন। তার স্বামী অধ্যাপক ল্যাক্সমোর ছিলেন বোটানিস্ট। ঐ অঞ্চলের দুষ্প্রাপ্য লতাগুল্মের সন্ধানেই তিনি যান। মেজর ডেসপার্ডও ঐ অভিযানে অংশ নেন–তিনি ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন, এবং অভিযানের বহু প্রয়োজনীয় ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন বলেই তাকে সঙ্গে নেওয়া হয়। এক রাত্রে কোন কারণে মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের ঝগড়া বাধে। অধ্যাপক ডেসপার্ড আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুঁড়েছিলেন যা অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়। সংক্ষেপে এই হল অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যু রহস্য।
পোয়ারো মনে মনে বিড় বিড় করলেন সত্যিই অভূতপূর্ব মহিলা–হতভাগ্য ডেসপার্ড। বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে হঠাই আপনমনে হাসতে শুরু করলেন পোয়ারো।
বাড়ি পৌঁছানোর পর আধঘণ্টা হতে না হতে মেজর ডেসপার্ড পোয়ারোর বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। তার চোখে মুখে রাগের ছাপ। অতিকষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছেন তিনি।
কি জন্যে আপনি মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেছিলেন? পোয়ারো মৃদু হাসলেন আমার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই আপনি এতক্ষণে জেনে গেছেন। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুরহস্যের আসল তথ্যটা খুঁজে বের করাই আমার উদ্দেশ্য।
আসল তথ্য! ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠেন ডেসপার্ড আপনি কি মনে করেন মেয়েদের পক্ষে সমস্ত ঘটনা জানা সম্ভব?
তা অবশ্য ঠিক। সায় দিলেন পোয়ারো।
আপনি জেনেছেন কতগুলো মিথ্যে কথা, বানানো কথা।
না না। পোয়ারো প্রতিবাদ জানালেন, সেরকম কিছু নয়। ভদ্রমহিলা একটু রোমান্টিক ধাঁচের এই যা–
হ্যাঁ, মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে মেনে নেওয়াটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। সবটাই ধাপ্পাবাজী। তার ওপর আবার তিনি ভীতু। উঃ কি অশান্তিতেই যে ওদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম!
হ্যাঁ, আমারও একথাটা সত্যি বলে মনে হয়, পোয়ারো মাথা দোলালেন।
হঠাৎ একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ডেসপার্ড। তাহলে আসল ঘটনাটা আপনাকে খুলেই বলি মঁসিয়ে পোয়ারো। অল্প থেমে বলতে শুরু করলেন ডেসপার্ড, আমি জানি আমি যা-ই বলি তাতে কারোর এক বিন্দু সমবেদনা পাব না। বরঞ্চ সকলের চোখে সন্দেহের ভাগী হব আমি-ই। তবুও আমার কাছে একটাই পথ খোলা আছে–তা হল ঘটনাটা আপনার কাছে খুলে বলা। বিশ্বাস করুন বা না করুন এই হল আসল ঘটনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মেজর ডেসপার্ড বলতে শুরু করলেন, অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের অভিযানের যাবতীয় ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। ল্যাক্সমোর সত্যিই একজন ভদ্রলোক। সবসময় গাছ লতা নিয়ে মেতে থাকতেন। আর মিসেস ল্যাক্সমোরকে তো দেখেই এলেন–অতিরিক্ত ভাবুক। আমি বিশেষ পছন্দ করতাম না তাকে। যাই হোক, ওখানে পৌঁছানোর পর অল্পদিনের মধ্যেই আমরা তিনজনেই জ্বরে পড়লাম। আমি এবং মিসেস ল্যাক্সমোর অল্প ভুগেই সুস্থ হয়ে উঠলাম, কিন্তু অধ্যাপকের জ্বর উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। একদিন আমি তাঁবুর বাইরে সন্ধ্যেবেলা চেয়ারে বসে আছি হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক টলতে টলতে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নদীর দিকে এগোেচ্ছন। তিনি যে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে এরকম কাণ্ড করতে যাচ্ছেন এতে কোন সন্দেহ ছিল না। আর এক মিনিটের মধ্যে ভদ্রলোক নদীতে গিয়ে পড়বেন। একবার পড়লে বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না। আমি যে ছুটে গিয়ে তাকে থামাব সে সময়ও নেই। পাশেই গুলিভরা বন্দুকটা পড়ে ছিল। ভদ্রলোকের পায়ে গুলি মেরে তাকে থামাতে চাইলাম আমি। আমার টিপ অব্যর্থ ছিল। বন্দুকটা তুলে সেদিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে যাই এমন সময় হঠাৎ মিসেস ল্যাক্সমোর কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে বাধা দিলেন। তার ধারণা হয়েছিল যে আমি তার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলছি। ভদ্রমহিলার টানাটানিতে বন্দুকের নলটা ঘুরে গিয়ে গুলিটা সোজা অধ্যাপকের পিঠে গিয়ে বিধল। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন তিনি।
ভদ্রমহিলা এত বোকা, তিনিই যে ঘটনাটার জন্যে দায়ী এ-কথা কিছুতেই মানতে রাজী হলেন না। তার ধারনা আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের ঝগড়া ছিল যার ফলে রাগে আমি তাকে মেরে ফেলেছি। ভদ্রমহিলা যে কি করে বসেছেন তা নিজেই জানেন না। শেষে তিনি বললেন যে বাইরের লোকেদের কাছে জানানো হবে যে অধ্যাপক ল্যাক্সমোর কালাজ্বরে মারা গেছেন। আমিও শেষ পর্যন্ত তার কথাতেই রাজী হলাম কারণ প্রকৃত ঘটনা জানলে শুধু শুধুই লোকের মিথ্যে সন্দেহে জড়িয়ে বদনামের ভাগী হব। পরদিন সকালে কুলিদের জানিয়ে দিলাম অধ্যাপক ল্যাক্সমোর কালাজ্বরে মারা গেছেন। সকলে মিলে তাকে নদীর ধারে কবর দিলাম। কুলিরা যদিও সকলেই আসল ঘটনা জানত, কিন্তু সকলেই খুব বিশ্বাসী, আমাকে শ্রদ্ধাও করত। তারা আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করল বাইরে কোনদিন কেউ এই ঘটনা কাউকে জানাবে না। তারপর আমরা লন্ডনে ফিরে আসি।
মেজর ডেসপার্ড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে উঠলেন, এই হল আমার গল্প বা ব্যাখ্যা–যাই বলুন। আমার মনে হয় শেটান কোন ভাবে মিসেস ল্যাক্সমোরের কাছ থেকে এই খবর জানতে পেরেছিলেন এবং সেদিন আমাদের সামনে এই ঘটনারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
ব্যাপারটা কিন্তু আপনার পক্ষে বেশ বিপজ্জনক। মিঃ শেটান যখন জানতে পেরেছিলেন- পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
ওসব আমি পরোয়া করি না। যাই হোক, এই গল্পের কোন সাক্ষ্য প্রমাণ আমি হাজির করতে পারব না। আমার মুখের কথাকেই প্রমাণ বলে ধরে নিতে হবে। অবশ্য এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি মিঃ শেটানকে খুন করেছি এই ধারণা করে নেওয়াও অস্বাভাবিক নয়। সেজন্যই আপনাকে আসল ঘটনা খুলে বললাম, বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছা।
আপনার মুখের কথাই আমি বিশ্বাস করছি মেজর ডেসপার্ড। পোয়ারো হাত বাড়িয়ে দিলেন ডেসপার্ডের দিকে।
ডেসপার্ডের দু চোখ খুশীতে চকচক করে উঠল। পোয়ারোর দু হাত আঁকড়ে ধরলেন তিনি। অসংখ্য ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো।
তুই একটা ভীতু মেয়ে অ্যানা–বোকা মেয়ে। উটপাখির মতো বালির মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখলেই কি চলবে? যেখানে একটা খুন নিয়ে কথা সেখানে তোর না গেলে চলে। বিশেষতঃ যখন সন্দেহভাজনদের মধ্যে তুই একজন–অবশ্য সেভাবে দেখতে গেলে তোর ওপরেই সন্দেহটা কম হওয়া উচিত। রোডা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
সকালের ডাকেই পোয়ারোর আমন্ত্রণ পত্র তাদের কাছে এসে পৌচেছে। অথচ অ্যানা তার কাছে যেতে মোটেই রাজি নয়।
কিন্তু জানিসই তো রোডা, গোয়েন্দা-গল্পে যার ওপর কম সন্দেহ হয় পরে দেখা যায় সেই খুনি। অ্যানা ঠাট্টার সুরে বলে।
তার কথায় কান দেয় না রোডা। তা হলেও তোকে যেতেই হবে। মনে রাখিস, তোর ওপরও নজর করা হচ্ছে, তোকেও সন্দেহের আওতায় রাখা হচ্ছে। এখন আমি খুনের কথা সহ্য করতে পারি না। রক্তের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে যাই।…এসব ন্যাকামো চলে না।
বেশ তো পুলিশের কাছে আমি সব প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি আছি। অ্যানা বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কোথাকার কে এক….. পোয়ারো, তার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।
তাহলেও ভেবে দেখ, তুই যদি না যাস–ভদ্রলোক হয়ত ভেবে বসবেন তুই খুনি, তাই যেতে ভয় পাচ্ছিস।
কিন্তু আমি খুনি নই। অ্যানা ঠাণ্ডা ভাবে বলে।
আমি যেন তাই বলেছি। আরে বাবা, আমিও জানি তুই কোনদিন হাজার চেষ্টা করলেও কাউকে খুন করতে পারবি না। তবুও দেখ, ভদ্রলোক বাইরের লোক–তার তো এত জানার কথা নয়। তার চেয়ে বরং চল আমরা দেখা করে আসি। নয়ত ভদ্রলোক এখানেই এসে হাজির হবেন। বলা যায় না, হয়ত ততক্ষণে ঝি-চাকরদের কাছ থেকে আমাদের গোপন খবর বার করে নিয়েছে।
ভদ্রলোক কি কারণে যে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। অ্যানা বিরক্ত হয়ে পড়ে। তোর কি মনে হয় রোডা, ভদ্রলোক কি রকম?
মোটেই শার্লক হোমসের মত দেখতে নয়, তবে এককালে বেশ নামডাক ছিল। এখন বেশ বুড়ো হয়েছেন-ষাট-পয়ষট্টি বছর বয়স হবে। আমার কি মনে হয় জানিস, ভদ্রলোক স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ওপর টেক্কা দিতে চাইছেন–চল না দেখেই আসি-হয়ত নতুন কোন খবরও পাওয়া যাবে।
তাহলে চল। বিষণ্ণ হয়ে সায় দেয় অ্যানা। তোর যখন এতই ইচ্ছে।
হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে, ঝাঁঝালো গলায় বলে রোডা, কারণ আমি তোর ভাল চাই। তোর মত বোকা আমি খুব কম দেখেছি অ্যানা–ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় তুই নজর দিতে জানিস না।
অ্যানা আর রোডা যখন এ-সমস্ত কথা বলছিল ঠিক তখনই ডেভনশায়ার থেকে লন্ডনের ট্রেনে ফিরছিলেন সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল। ডেভনশায়ার থেকে অ্যানা মেরিডিথ সম্পর্কে আরও খবরাখবর জোগাড় করে ফিরছিলেন তিনি। সেখানকার স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি মিসেস বেনসনের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মোটামুটি ভাবে খোঁজ নিয়েছেন। যা জানা গেছে তা হল : মিসেস বেনসন ভুল করে কাশির সিরাপের বদলে টুপির পালিশ খেয়ে মারা যান। মিস মেরিডিথ যখন ঐ বাড়িতে কাজ নিয়েছিলেন তখন একদিন টুপির পুলিশের বোতলটা ভেঙ্গে যায়। মিসেস বেনসন ঐ পালিশটা সিরাপের পুরোনো খালি বোতলে ঢেলে রাখতে বলেন মিস মেরিডিথকে। কিন্তু অসাবধানতা বশতঃ ঐ বোতলের গায়ে টুপির পালিশ হিসাবে কোন লেবেল আটকানো হয়নি। পালিশটা একটা খালি সিরাপের বোতলে ভরে সবচেয়ে উঁচু তাকে তুলে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার দিন রাত্রে ভদ্রমহিলা একটা পাত্রে বেশ কিছু সিরাপ ঢেলে পান করেন, কিন্তু সেটা ছিল সেই টুপির পালিশ, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে খবর পাঠানো হয় কিন্তু ভদ্রলোক অন্য গ্রামে রুগী দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে আসবার আগেই ভদ্রমহিলা মারা যান। বাড়ির লোকেদের ধারণা মিস মেরিডিথ মানে তাদের পরিচারিকাটিই ঘরদোর পরিষ্কার করার সময় ভুল করে বোতল দুটো উল্টোপাল্টা করে রেখেছিল।
ব্যাটেল মনে মনে ভাবলেন, ব্যাপারটা কত সহজ। ওপরের তাকের বোতলটা নিচে রেখে, নিচেরটা ওপরে রাখা। ভুলটা কি করে হলো, কে করল–এসব কোনভাবেই ধরা পড়বে না, কেউ ঘুনাক্ষরেও সন্দেহও করবে না। অথচ কি সহজভাবে একটা খুন করা সম্ভব। কিন্তু খুন করার পেছনে মোটিভটা কি?
আরও দুচার জায়গায় ব্যাটেল খোঁজ-খবর করেছিলেন। মিসেস বেনসনের প্রতিবেশীদের কারোরই মিস মেরিডিথকে ভালো মনে নেই। তবে মিসেস বেনসন যে গৃহকর্ত্রী হিসেবে মোটেই ভাল ছিলেন না এটা সবারই মনে ছিল। ঝি-চাকরদের সঙ্গে সব সময়ই তিনি খারাপ ব্যবহার করতেন, এমনকি অল্পবয়সী মেয়েরাও টিকত না তার বারিতে, কারণ কি?
ব্যাটেল ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন। ট্রেন তখন লণ্ডনের দিকে ছুটে চলেছে।
ম্যাডাম আমি আপনার স্মৃতিশক্তির সাহায্য চাই পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
স্মৃতিশক্তি। বেশ অবাক হয় অ্যানা। একটু আগেই রোডার সাথে এরকুল পোয়ারোর বাড়িতে এসেছে সে।
হ্যাঁ। এর আগেই আমি ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেসপার্ড আর মিসেস লরিমারকে একই প্রহ্ন করছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে সঠিক উত্তর, মানে আমি যে উত্তরটা চাইছি, তা দিতে পারেন নি।
অ্যানা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
আপনি সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের ড্রয়িং রুমটা মনে করার চেষ্টা করুন। আমি জানি ঘটনাটা খুবই বীভৎস, মনে করতে কষ্ট হয়–বোধ হয় আপনি আগে কোনদিন এরকম ভয়ংকর খুনের মুখোমুখি হন নি, তাই না?
হঠাৎ রোডার চেয়ার একটু নড়েচড়ে উঠল।
অ্যানা বলল, ঠিক আছে। কি জানতে চান বলুন?
আপনি মিঃ শেটানের ড্রয়িংরুমের জিনিপত্রগুলোর একটা বর্ণনা দিন। যেমন ধরুন–চেয়ার, টেবিল, আগেকার দিনের অলংকার, দামী দামী পর্দা–এসবগুলোর একটা বর্ণনা চাইছি আমি।
ওঃ এই ব্যাপার। অ্যানা কুঁচকে চিন্তা করল। কিন্তু এতদিন পরে তো সবটা ঠিক মনে করতে পারব না। এমনকি দেয়ালগুলো কি রঙের ছিল তা ভুলে যাচ্ছি–যতদূর মনে পড়ছে দেওয়ালের মাঝে মাঝে কাজ করা ছিল। কতগুলো দামী কম্বল পাতা ছিল মেঝের ওপর। আর মস্তবড় পিয়ানো ছিল একটা। নাঃ, আর কিছু তো মনে পড়ছে না–
ম্যাডাম, একটু ভালো করে চেষ্টা করুন। কিছু কিছু জিনিসের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে কোন পুরানো যুগের অলংকার, কোন আসবাবপত্র, আকর্ষণীয় কিছু।
হ্যাঁ এখন মনে পড়ছে। অ্যানা আস্তে আস্তে বলে–জানালার পাশে একটা মিশরের গয়নার বাক্স ছিল।
হ্যাঁ, হা, ঘরের শেষ দিকে একটা জানালার ধারে তার উল্টোদিকের টেবিলেই ছুরিটা পড়ে ছিল।
কোন টেবিলে ছুরিটা ছিল–আমি তা জানি না। অ্যানা শান্তভাবে বলে।
তাই নাকি? মনে মনে বললেন পোয়ারো। তাহলে আর আমার নাম এরকুল পোয়ারোই নয়। কারো চরিত্র সম্পর্কে খুঁটিনাটি না জেনে আমি ফাঁদ পাতি না।
হ্যাঁ, নীল আর লাল রং দিয়ে তৈরি। কয়েকটি হীরের আংটি, কয়েকটা কঙ্কনও ছিল–তবে বিশেষ ভাল না। তাছাড়া ঘরটা তো জিনিসপত্রে বোঝাই
এমন কোন কিছু কথা মনে পড়ছে না, যা আপনার নজরে পড়েছিল।
একটা ফুলদানীতে কতগুলো গোলাপ ছিল মনে পড়ছে। বলতে বলতে অ্যানা মৃদু হাসল। তাতে জল পাল্টানো হয়নি।
পোয়ারো চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।
অ্যানা বলল, হয়ত আপনার পছন্দমত, সঠিক জিনিসটার ওপর নজর দিয়ে দেখিনি।
তাতে কিছু যায় আসে না। মৃদু হাসলেন পোয়ারো।
ভাল কথা, মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে খুব শিগগির কি আপনার দেখা সাক্ষাত হয়েছে?
ভদ্রলোক বলেছিলেন আমাদের সঙ্গে একদিন দেখা করতে যাবেন। অ্যানা বলে ওঠে।
হঠাৎ রোডা বলে ফেলে, আমরা কিন্তু নিশ্চিত, এ কাজ মেজর ডেসপার্ড করেন নি।
পোয়ারো মনে মনে হেসে ফেলে।
ম্যাডাম। অ্যানাকে লক্ষ্য করে পোয়ারো বললেন, আপনি যদি আমার একটা উপকার করেন-ব্যাপারটা অবশ্য সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত।
অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল অ্যানা।
ব্যাপারটা কিছুই নয়। বড়দিন উপলক্ষে আমি আমার নাতনীদের একটা করে উপহার দিতে চাই। কিন্তু আমার পক্ষে আজকালকার মেয়েদের পছন্দ কি, বোঝা মুশকিল।
আচ্ছা, সিল্কের মোজা উপহার দেওয়া চলে কি?
হ্যা, অ্যানা জবাব দেয়, আজকাল সিল্কের মোজা খুবই চলে।
চলে! যাক নিশ্চিন্ত হলাম। পাশের ঘরে টেবিলের ওপর পনের কি ষোল জোড়া মোজা আছে–বিভিন্ন রঙের। যদি আপনি একটু দেখেশুনে ছজোড়া আলাদা করে বেছে দেন।
ঠিক আছে, আমি বেছে দিচ্ছি। উঠে দাঁড়ায় অ্যানা।
পোয়ারো তাকে সঙ্গে নিয়ে পাশের ঘরের টেবিলের সামনে নিয়ে এলেন। টেবিলের ওপর মোজার বান্ডিল, কিছু খালি চকোলেটের বাক্স, গোটা চারেক পশমের দস্তানা ছড়িয়ে আছে।
এই হল মোজার বাণ্ডিল। এর থেকে ছটা বেছে দিন।
তাদের পেছন পেছন রোডাও সেখানে হাজির হয়েছে। পোয়ারো তার দিকে ফিরে তাকালেন। মিস রোডা, এই ফাঁকে আপনাকে আর একটা জিনিস দেখিয়ে আনি, চলুন। সেটা হয়ত আপনার বন্ধুর বিশেষ পছন্দ হবে না
জিনিসটা কি? রোডা কৌতূহলী হয়। পোয়ারো নীচু গলায় বলে ওঠেন, ছোরা।
যে ছোরা দিয়ে বারো জনকে খুন করা হয়েছিল। এক বিখ্যাত হোটেল মালিক আমাকে ছোরাটা উপহার দেন
বীভৎস! শিউরে ওঠে রোডা। ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।
চলুন তো দেখে আসি। রোডা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পোয়ারো তাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলেন। আলমারি খুলে ছোরাটা রোডাকে দেখাতে দেখাতে মিনিট তিনেক কেটে গেল। রোডাকে নিয়ে পোয়ারো যখন পাশের ঘরে আবার এসে ঢুকলেন তখন অ্যানার মোজা বাছা শেষ।
অ্যানা এগিয়ে এল। এই ছটাই আমার বেশ পছন্দ হল মঁসিয়ে পোয়ারো। গাঢ় রঙের গুলো সান্ধ্য পোশাকে ভালো মানাবে। আর হাল্কা রঙের গুলো গ্রীষ্মকালের জন্য।
ধন্যবাদ ম্যাডাম। অসংখ্য ধন্যবাদ।
অ্যানা আর রোডা শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেয়। দরজা পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিলেন পোয়ারো। তারপর টেবিলের কাছে ফিরে এলেন। ছটা প্যাকেট আলাদা সরিয়ে রেখে বাকিগুলো গুনে দেখলেন তিনি। মোট উনিশটা প্যাকেট ছিল, কিন্তু এখন পড়ে রয়েছে সতেরটা। পোয়ারো হাসতে হাসতে আপনমনে মাথা দোলালেন।
***
লণ্ডনে ফিরে ব্যাটেল প্রথমে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর ঘণ্টা খানেক আগেই অ্যানা আর রোডা বিদায় নিয়েছে।
ব্যাটেল ডেভনশায়ারের সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন পোয়ারোকে। সবশেষে মন্তব্য করলেন ডাক্তার পর্যন্ত ভেবেছে যে এটা অসাবধানতা বশতঃ হয়েছে। ডেভনশায়ারের কেউ এটাকে খুন বলে ভাবে না–এমনকি পুলিশের ধারণা মিস মেরিডিথ নির্দোষ। মিসেস বেনসনের মৃত্যু যে খুন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন হল মিস মেরিডিথ খুনটা করল কেন?
আমি হয়ত এর কারণ সম্পর্কে আপনাকে একটা আভাস দিতে পারবো। পোয়ারো শান্তভাবে বললেন।
কিভাবে মঁসিয়ে পোয়ারো?
আজ বিকেলে আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করেছি। মিস মেরিডিথ আর তার বন্ধুকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। অ্যানা মেরিডিথকে সেই একই প্রশ্ন করলাম, মিঃ শেটানের ড্রয়িংরুমে কি কি জিনিস দেখেছিল সে?
আপনি দেখছি ঘুরে ফিরে সেই একটা প্রশ্নতেই জোর দিচ্ছেন?
কারণ আছে। আমি ঐ একটা থেকেই অনেক কিছু জানতে পারি। মিস মেরিডিথ খুবই সন্দেহ প্রবণ। তাই একটা ফাঁদ পাতলাম। মিস মেরিডিথ গয়নার বাক্সটার কথা বলতেই আমি তাকে ছুরিটার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সেটা ঠিক উল্টোদিকের টেবিলেই পড়েছিল। কায়দা করে আমার ফঁদ এড়িয়ে গেল মিরিডিথ এবং এজন্য মনে মনে খুব গর্বও হল তার। স্বাভাবিকভাবেই তার আত্মরক্ষার শক্তি কিছুটা ঢিলে হয়ে গেল। তাহলে তাকে ডেকে আনার কারণ শুধু এই, ছুরিটা সে দেখেছে কি না এটা স্বীকার করিয়ে নেওয়া? তবে তো সে পোয়ারোকে বেশ কঁকিই দিতে পেরেছে, এই ভেবে অ্যানা খুব হাসিখুশী হয়ে উঠলো। সহজভাবে গয়নার বাক্স, ফুলদানীর গোলাপ ফুল–যার জল পাল্টানো হয় নি, এসব গল্প করল মেরিডিথ।
কিন্তু তাতে হলোটা কি? অবাক হন ব্যাটেল।
বুঝলেন না? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ধরুন আমারা মেয়েটির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানিনা। তার কথাবার্তার মধ্যেই তো তার চরিত্রের একটা আভাস পেতে পারি। ফুলের কথাই তার মনে আছে–তার মানে এই নয় যে সে ফুল ভালবাসে, তাহলে আগেই নজর পড়ত সুন্দর টিউলিপের ওপর, এটা হলো মাইনে করা কাজের লোকের কথা–ফুলদানীর জল পাল্টানো যার কাজ। এ হলো একটা পয়েন্ট। তার মধ্যে একটা নারীসত্তাও আছে, গয়না যার খুব প্রিয়–এবার বুঝতে পারছেন কিছু?
হু। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকেছে?
চমৎকার. আপনার মুখে মিস মেরিডিথের পুরোনো জীবনের কথা শুনলাম। আর মিসেস অলিভারের মুখে সেই অদ্ভুত কথাটা শোনার পর থেকেই আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম। খুনটা আর্থিক কোন কারণে মিস মেরিডিথ করেনি, কেননা আমরা দেখেছি এখনও তাকে চাকরী করে খেতে হয়। তাহলে আসল কারণটা কি? ওপর ওপর মিস মেরিডিথের স্বাভাব-চরিত্র সম্বন্ধে একটু একটু ভেবে দেখলাম। সাদামাটা শান্ত মেয়ে। গরীব, কিন্তু সৌখীন সাজপোশাকের ওপর ঝোঁক বেশি। ছোট খাট সুন্দর জিনিসের ওপর লোভ। মনের গড়নটা খুনীর সঙ্গে মানায় না, বরং চোরের সঙ্গে খাপ খায়। আপনার মনে আছে, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিসেস এল্ডন আগোছালো টাইপের মহিলা কি না। আপনি আমার কথায় সায় দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, তখন তো বেশ অবাক হয়েছিলাম।
আমি এখন ভেবেচিন্তে একটা ধারণা করলাম। ধরে নেওয়া যাক, মিস মেরিডিথ-এর একটা দুর্বলতা আছে। ঐ যে একধরনের মেয়েরা দোকান থেকে জিনিসপত্র চুরি করে–মেরিডিথ খানিকটা সেই ধরণের। হয়ত মিসেস এন্ডনের ঘর থেকে দুল কি ছোটখাট গয়না,অথবা দুএক শিলিং সরাত মিস মেরিডিথ। মিসেস এল্ডন অতসব খেয়াল করতেনও না কিংবা ভাবতেন নিজেই হারিয়ে ফেলেছেন কিন্তু বেনসনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। তার হাতেই ধরা পড়ল মিস মেরিডিথ। তিনি মেরিডিথকে চোর হিসাবে দায়ী করলেন, হয়ত ভয়ও দেখিয়েছিলেন। আগেই আপনাকে বলেছিলেম মেয়েটা একমাত্র ভয় পেয়েই খুন করতে পারে। সে জানত মিসেস বেনসন চোর বলে প্রমাণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বাঁচবার একটাই পথ আছে–মিসেস বেনসনের মৃত্যু। বোতল দুটো এই জন্যই উল্টোপাল্টা করে রাখল–যার ফলস্বরূপ মিসেস বেনসন মারা গেলেন। ভদ্রমহিলা পর্যন্ত মারা যাবার আগে বিশ্বাস করে গেলেন যে তার নিজের ভুলেই ব্যাপারটা ঘটেছে।
হু, তা হতে পারে। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। কিন্তু এ সবই তো অনুমানের ব্যাপার।
না, কেবল অনুমানই নয়। আমি প্রায় নিশ্চিত। আজ বিকেলে একটা পরীক্ষা করলাম। মিস মেরিডিথকে বললাম, উপহার দেবার উপযোগী কয়েকটা সিল্কের সৌখিন মোজা বেছে দিতে। কায়দা করে জানিয়ে দিলাম, টেবিলের ওপর কজোড়া মোজা আছে তা আমার সঠিক জানা নেই। সিল্কের সৌখিন মোজার লোভ এড়ান, মিস মেরিডিথের পক্ষে কঠিন হবে জানতাম। তাকে একলা থাকার সুযোগ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম ঘর ছেড়ে। কি হল জানেন? ঊনিশ জোড়ার মধ্যে এখন রয়েছে সতেরটা। বাকি দুজোড়া মিস মেরিডিথের ব্যাগের মধ্যেই অদৃশ্য হয়েছে।
সর্বনাশ! ব্যাটেল অবাক হলেন, সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে তো।
মনস্তত্বটা লক্ষ্য করুন। মেরিডিথের ধারণা আমি তাকে খুনের জন্য সন্দেহ করি। কিন্তু দুজোড়া সিল্কের মোজা চুরিতে কি আসে যায়? আমি তো আর কোন চোরের খোঁজ করছি না। তাছাড়া এরকম বিকারগ্রস্তদের আত্মবিশ্বাস খুব জোরালো। তারা ভাবে সব সময়ই নির্বিঘ্নে কাজ হাসিল করে সরে পড়তে পারবে।
হ্যাঁ। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। ঠিকই বলেছেন আপনি। তাহলে একটা পরিস্কার সিদ্ধান্তে এসে পড়ছি আমরা, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় অ্যানা মেরিডিথ বোতল দুটো বদলে রেখে দেয়। নিঃসন্দেহে এটা একটা খুন, কিন্তু কোর্টে প্রমাণ করা যাবে না। রবার্টসও সন্দেহমুক্ত থাকতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের এখানকার বিবেচ্য বিষয় হল মিঃ শেটানকে খুন করেছে কে? মিস মেরিডিথ কি?
কিছুক্ষণ চিন্তা করে হতাশাভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। না, ঠিক মিলছে না। ঝুঁকি নেবার মেয়ে সে নয়। বোতল দুটো বদলে রাখা সম্ভব–কেননা কেউ ব্যাপারটা ধরতে পারবে না। মিসেস বেনসন একবার ভালো করে দেখলেই ধরতে পারতেন–মিস মেরিডিথের প্ল্যান সফল নাও হতে পারত। একটা চান্স নেওয়া আর কি? হলে হল, না হলে আর কি করা যাবে। কিন্তু শেটানের ব্যাপারটা অন্য। কেউ প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে ঠান্ডা মাথায়, আত্মবিশ্বাসের ওপর খুনটা করেছে।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়–দুটো অপরাধের প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্য। পোয়ারো সায় দিলেন।
তাহলে দেখেছি, মিস মেরিডিথ তার প্রথম খুনটার বেলায় সফল হলেও মিঃ শেটানের খুনের ব্যাপারে তার কোন হাত নেই। লিস্ট থেকে তাহলে বাদ যাচ্ছে। ডাক্তার রবার্টস আর মিস মেরিডিথ। ভালো কথা, মিসেস ল্যাক্সমোরের কাছে গিয়েছিলেন আপনি?
পোয়ারো সব কথা খুলে বললেন তাকে। মেজর ডেসপার্ডের কথা আপনার বিশ্বাস হয় মঁসিয়ে পোয়ারো? মন্তব্য করলেন ব্যাটেল।
হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি।
আমারও তাই মনে হয়। ভদ্রলোক শুধু ঝগড়ার জন্য অধ্যাপক ল্যাক্সমোরকে খুন করতে পারেন না। সেরকম টাইপের লোক নন তিনি। মিঃ শোন তাহলে এক্ষেত্রে অত্যন্ত ভুল করেছিলেন–এটা আসলে খুন নয়।
পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন ব্যাটেল, তাহলে বাকি রইলেন-
মিসেস লরিমার। পোয়ারোর শান্ত স্বর ভেসে এল।
হঠাৎ শব্দ করে ঘরের এক কোণে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললেন। কিছুক্ষণ কথাও বললেন কার সঙ্গে। তারপর ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন। গম্ভীর থমথমে মুখ।
মিসেস লরিমার ফোন করেছিলেন। পোয়ারো বললেন, ভদ্রমহিলার ইচ্ছে আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করি।
মনে হচ্ছে আপনি এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন? ব্যাটেলের চোখে সন্দেহের ঝিলিক।
কি জানি! উদাস ভাবে বললেন পোয়ারো, হবে হয়ত। কিন্তু আমার অবাক লাগছে–
তাহলে আর দেরি করবেন না। পোয়ারোর কথা শেষ হবার আগে বলে উঠলেন ব্যাটেল, শেষ পর্যন্ত হয়ত কথাটা আপনিই আদায় করে নিয়ে আসবেন।
আসুন আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, আমি ভাবতেই পারিনি। মিসস লরিমার অভ্যর্থনা জানালেন পোয়ারোকে। প্রায় অন্ধকার বসবার ঘরের একটা সোফায় বসে আছেন মিসেস লরিমার। তাকে আরো শীর্ণ মনে হচ্ছে, একদিনে যেন অরো কয়েক বছর বয়স বেড়ে গেছে।
আপনার কাজে লাগতে পারলে খুশি হব ম্যাডাম, পোয়ারো বলে ওঠে।
দাঁড়ান, আগে চায়ের ব্যবস্থা করি। ঘন্টি টিপে চা আনতে বললেন মিসেস লরিমার।
আপনার মনে আছে মঁসিয়ে পোয়ারো, এর আগের দিন আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি ডেকে পাঠালেই আপনি আসবেন। আপনি হয়ত আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কি প্রয়োজনে আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব, তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো?
ইতিমধ্যে চা এসে পড়ায়, কাপে চা ঢালতে শুরু করলেন মিসেস লরিমার। বিভিন্ন প্রসঙ্গে পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মিসেস লরিমার আচমকা প্রশ্ন করলেন, সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল তো আমার সম্পর্কে বেশ খোঁজ-খবর করেছেন, কেমন এগোচ্ছে তাঁর কাজ?
ভদ্রলোক ধীরে সুস্থে এগোনই পছন্দ করেন, তবে শেষ অবধি লক্ষ্যে পৌঁছান ঠিকই।
তাই হবে হয়ত! মিসেস লরিমারের মুখে বিদ্রুপের হাসি। আমার ওপর তার বেশ তীক্ষ্ণ নজর আছে। আমার পুরোনো বন্ধুবান্ধব, ঝি-চাকরদের হাজারো প্রশ্ন করে ইতিহাস ঘেঁটে বেড়াচ্ছে–আমার বাচ্চা বয়স থেকে শুরু করে জীবনের ইতিহাস। কিন্তু ভদ্রলোক বোধহয় এখনও তার জ্ঞাতব্য বিষয়টি জেনে উঠতে পারেন নি। আমি তো তাকে মিথ্যে বলিনি, আমার কথাটা বিশ্বাস করলেই ভালো করতেন। মিঃ শেটানের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় ল্যাক্সামোরে, তারপর এখানে সেখানে দু-চারবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, কিন্তু আমাদের পরিচয় খুব কম। আচ্ছা আপনি আমার সম্বন্ধে কোন খোঁজ খবর করেননি মঁসিয়ে পোয়ারো?
তাতে কোন লাভ হয় না। মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
তার মানে?
ম্যাডাম, তাহলে স্পষ্টভাবে সব কথা খুলে বলি। সেদিন সন্ধ্যায় একটা কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঘরে যে কজন উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, যুক্তিপ্রবণ এবং স্থির মস্তিষ্ক হলেন আপনি। এখন যদি বাজী ধরে বলতে হয় এই চারজনের মধ্যে কোন প্রমাণ না রেখে কে খুন করতে পারে, তবে আমি আপনার ওপরই বাজী ধরব।
এটাকে কি আমি প্রশংসা বলে ধরে নেব?
তার কথায় কান দিলেন না পোয়ারো। একটা অপরাধকে সফল করে তুলতে গেলে সবচেয়ে প্রথমে তার অগ্রপশ্চাৎ, সবকিছু বিচার বিবেচনা করে দেখতে হয়। সম্ভাব্য প্রতিটি বিষয়ে চিন্তা করে নিতে হয়। কেননা সামান্য ভুলের জন্য গোটা প্ল্যানটাই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। ডাক্তার রবার্টস অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্য বেঁকের মাথায় কিছু একটা করে বসতে পারেন। মেজর ডেসপার্ড ফলাফল না ভেবে কোন কাজ করেন না, তিনি এ ধরনের কাজ করতে পারেন বলে মনে হয় না আমার। মিস মেরিডিথ হয়ত ভয় পেয়ে কোন কিছু করতে পারেন। কিন্তু সেরকম এক্সপার্ট না হওয়ায় হয়ত নার্ভাস হয়ে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যাবেন। কিন্তু আপনি এর কোনটাই করবেন না। আপনার বুদ্ধি স্বচ্ছ, মস্তিষ্ক স্থির, এবং আপনি দৃঢ়চেতা।
মিসেস লরিমার মিনিট কয়েক চুপ করে রইলেন। তার মুখে চোখে এক অদ্ভুত হাসি খেলা করছে।
তাহলে আপনার ধারণা অনুযায়ী আমিই হলাম সেই মহিলা যে কি না নিখুঁত প্ল্যান করে ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করতে পারে
অন্তত এই প্ল্যানকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন আপনি। সেই ক্ষমতা আপনার আছে।
বেশ মজার ব্যাপার। তাহলে, ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে একমাত্র আমিই শেটানকে খুন করতে পারি? পোয়ারোর শান্ত স্বর ভেসে আসে, এখানেই একটা অসুবিধা আছে, ম্যাডাম।
কি অসুবিধা মঁসিয়ে পোয়ারো?
একটু আগে আমি যে কথাটা বললাম নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। কোন অপরাধ সফল করতে হলে সচরাচর সমস্ত খুঁটিনাটি পরিকল্পনা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হয়। সচরাচর কথাটা মনে রাখবেন। কারণ আর এক ধরণের সফল অপরাধ করা সম্ভব। ধরুন, আপনি আচমকা কাউকে ঢিল ছুঁড়ে দূরের একটা গাছের গুঁড়িতে লাগাতে বললেন। যাকে বললেন সে হয়ত না ভেবেচিন্তেই ঢিলটা ছুঁড়ে বসল এবং সত্যি সত্যি লক্ষ্যভেদ করতে পারল। একবার সফল হয়েই সে যদি ঐ ঢিল ছুঁড়তে যায় দেখা যাবে ব্যাপারটা আর ততখানি সহজ হবে না। কারণ তখন সে চিন্তা করতে শুরু করেছে। ঢিলটা ছোঁড়ার আগে মনে হচ্ছে একটু ডানদিকে আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না না, একটু বাঁদিক ঘেঁষেই ছোঁড়া উচিত। প্রথমটা ছিল অবচেতন প্রক্রিয়া, যেখানে শারীর মনের হুকুম তামিল করেছিল। এই হল এক ধররের ক্রাইম–থেমে, ভেবে দেখবার কোন সময় নেই–এক মুহূর্তেই ঘটে যায়। বলতে বাধা নেই মিঃ শেটানের খুনের পিছনেও এ ধরনেরই একটা মনোভাব কাজ করেছিল।
হঠাৎ একটা প্রয়োজনে না ভেবে-চিন্তে, দ্রুত কাজটা ঘটে গেল। আপনার স্বভাবের সঙ্গে ঠিক এ ধরনের ক্রাইম খাপ খায় না। আপনি শেটানকে খুন করতে চাইলে, খুব ভাল ভাবে পরিকল্পনা নিয়ে খুনটা করবেন।
তাই বুঝি! মিসেস লরিমারের মুখে সেই অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো। আপনি বলতে চাইছেন যেহেতু এটা আগে থেকে পরিকল্পনা করা কোন খুন নয়–অতএব আমি শোনকে খুন করিনি।
ঠিক তাই, ম্যাডাম। পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।
কিন্তু তবুও– মিসেস লরিমার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে ওঠেন, সিয়ে পোয়ারো, আমিই শেটানকে খুন করেছি।
অনেকক্ষণ দু-জনেই চুপচাপ। একটা অস্বস্তিকর চাপা নীরবতা ঘরের বাতাস ভারী করে তুলেছে, বাইরের অন্ধকার আরো ঘনিয়ে এসেছে। পোয়ারো এবং মিসেস লরিমার দুজনেই ফায়ার প্লেসের দিকে তাকিয়ে আছেন, সময়ও যেন থমকে রয়েছে সেখানেই।
নীরবতা ভাঙলেন পোয়ারো। তাহলে এই হল আসল ঘটনা। কিন্তু ম্যাডাম, কেন আপনি শেটানকে খুন করলেন?
কারণটা আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো
শোন তাহলে আপনার অতীত জীবনের কোন গোপন ঘটনা জানতেন এবং সে ঘটনা সম্ভবত কোন মৃত্যু তাই না মিসেস লরিমার?
মিসেস লরিমার চুপ করে রইলেন। বোঝা গেল মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।
আজ কেন এ কথা বললেন আমাকে? ডেকেই বা পাঠালেন কেন?
একদিন আপনিই বলেছিলেন, কোন সময়ে হয়ত আমি আপনাকে ডেকে পাঠাতে পারি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক। আমি জানতাম আপনি যদি নিজে থেকে কোন কথা না বলেন তবে কোনদিনই আপনার মুখে থেকে কেউই কিছু আদায় করতে পারবে না। আমার মনে হয়েছিল, অথবা বলতে পারেন একটা সম্ভাবনা ছিল হয়ত কোনদিন নিজের সম্বন্ধে কথা বলবার ইচ্ছে আপনার মধ্যে জেগে উঠতে পারে।
বিমর্ষভাবে মাথা নাড়লেন মিসেস লরিমার। আপনি দূরদর্শী, তাই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন।
সেদিন ডিনার টেবিলে মিঃ শেটান যে কথা বলেছিলেন, সেটা কি আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল বলে আপনার ধারণা? শান্ত গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন পোয়ারো।
হ্যাঁ, মিঃ শোন বলেছিলেন বিষই হল মেয়েদের প্রধান অস্ত্র। কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। এর আগেও একদিন অনেকের সামনে এই ধরনের একটা মামলার কথা বলবার সময় তিনি আমাকে লক্ষ্য করেছিলেন। আমার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল মিঃ শেটান আমার গোপন ব্যাপারটা জানেন, সেদিনই সন্দেহটা দৃঢ় হল। নিশ্চিত হলাম যে, ব্যাপারটা আর অজানা নেই।
ভদ্রলোকের ভবিষ্যৎ ইচ্ছাটাও কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন?
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল আর আপনার উপস্থিতি যে দৈবাৎ হয়েছে এমন কথা বিশ্বাস করা শক্ত। আমি তা বুঝে নিলাম, এরপর মিঃ শোন বাহাদুরী দেখিয়ে বলবেন, যা কেউ কোনদিন পারেননি আজ তিনি তাই পরিষ্কার করতে পেরেছেন।
মিঃ শেটানকে খুন করবেন,কখন ঠিক করলেন?
অল্প ইতস্তত করেন মিসেস লরিমার, কখন যে ঠিক করলাম বলা শক্ত। তবে ডিনারে যাবার আগেই ছোরাটা আমার নজরে পড়েছিল। ডিনার শেষ করে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসার সময় সকলের চোখ এড়িয়ে ছোরাটা তুলে আমার আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিলাম কেউই দেখতে পায়নি ব্যাপারটা।
এ যে একেবারে নিপুণ শিল্পীর মত হাত সাফাই। মন্তব্য করলেন পোয়ারো।
তখনই আমি মনস্থির করে ফেললাম। কাজটা নিঃসন্দেহে খুব ঝুঁকির। কিন্তু আমার তো আর কোন উপায় ছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিসেস লরিমার পুরোনো কথার খেই ধরে বলতে লাগলেন-ব্রীজের আসর বসল। খেলা এগিয়ে চলেছে। একসময় সুযোগ এসে গেল। আমি তখন ডামি। পায়চারি করার ভান করে ফায়ার-প্লেসের কাছে হাজির হলাম। চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন মিঃ শেটান, অন্য তিনজনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রত্যেকেই তাসে মগ্ন। ব্যাস! সুযোগ হাতছাড়া করলাম না-ঝুঁকে পড়ে হৃৎপিণ্ড তাক করে ছুরি চালালাম-
মিসেস লরিমারের গলার স্বর অল্প কেঁপে উঠল। ঠিক তখনই একটা মতলব মাথায় এলো। অন্যের সন্দেহের হাত থেকেও তো বাঁচতে হবে-মিঃ শেটানের সঙ্গে কথা বলার ভান করলাম। পুরোনো দিনের ফায়ার-প্লেসের সম্পর্কে কয়েকটা মন্তব্য করলাম। চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ–লোকে জানুক অমি তার উত্তরের অপেক্ষা করছি। শেষে বললাম, হ্যাঁ, আমিও তার সঙ্গে একমত-ঘর গরম রাখতে আধুনিক রেডিয়েটারের চেয়ে পুরোনো আমলের চুল্লিই ভাল।
মিঃ শোন কোন চিৎকার করলেন না?
না। কেবল তার গলা দিয়ে একটা মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল। অন্য খেলোয়াড়রা মনে করতে পারে শেটান আমার কথার জবাব দিচ্ছেন। এরপর ব্রীজের টেবিলে গেলাম। তখন সেখানে শেষ তাসটা খেলা হচ্ছে।
আপনি সোজা গিয়ে খেলতে শুরু করলেন?
হ্যাঁ।
এবং এমন গভীর মনোযোগ দিয়ে খেলোম যে এই ঘটনার দুদিন পরেও আমার কাছে সমস্ত তাসের বিবরণ ছবির মতো বলে যেতে একটুও অসুবিধা হল না। তাসের কথা আমি ভুলি না সহজে। মৃদুস্বরে জবাব দিলেন মিসেস লরিমার।
কিন্তু ম্যাডাম, অমি যে একটা সূত্রের হদিস পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন। সবকিছু আগে-ভাগে যাচাই করে নেওয়া আপনার স্বভাব। আপনি হঠাৎ ঠিক করলেন,আপনাকে সাংঘাতিক একটা ঝুঁকি নিতে হবে, অন্য কোন পথ নেই। ঝুঁকি নিলেন এবং সফলও হলেন। অথচ ঠিক দুসপ্তাহ বাদে আপনার মত বদলে গেল–এখন আপনি ধরা দিতে প্রস্তুত–পুরো ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।
মিসেস লরিমারের মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিল, হ্যাঁ। এর মধ্যে একটা ব্যাপার আপনার ঠিক জানা নেই মঁসিয়ে পোয়ারো। সেদিন মিস মেরিডিথের সঙ্গে আমার হার্লে স্ট্রীটে দেখা হয়েছিল।
হু, পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমি এখন যেন কিছুটা বুঝতে পারছি।
সেখানে আমি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আভাস-ইঙ্গিতে যা বললেন, আমি আগেই তা আঁচ করেছিলাম। মিসেস লরিমারের মুখে একটা শান্ত কোমল হাসি দেখা দিল।
আর বেশি ব্রীজ আমি খেলবো না। খুব সাবধান থাকলে নিয়ম মেনে চললে কয়েক বছর আমি বেঁচে থাকতে পারি। যাই হোক, সে নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। বিশেষজ্ঞের চেম্বার থেকে বেরিয়ে মিস মেরিডিথের সঙ্গে দেখা, একসাথে চা খেলাম আমরা। মিসেস লরিমার মিনিট খানেক চুপ করে রইলেন।
সেদিন চা খেতে খেতে অনেক চিন্তা করলাম। আমার কাজের ফলে মিঃ শেটানের প্রাণটাই শুধু গেল না আরও তিনজনের জীবন নিয়ে টানাটানি, শেটানের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু বাকি তিনজন? তারা তো আমার কোন ক্ষতি করেনি। আমার স্বীকারোক্তিতে তারা তো মুক্তি পাবেন। অবশ্য মেজর ডেসপার্ড বা ডাক্তার রবার্টস এদের জন্য মাথাব্যথা নেই। অ্যানা মেরিডিথ একেবারে অল্পবয়সী। কিছু হলে তার গোটা জীবনটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে–এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। তাই ভাবনা-চিন্তা করেই আপনাকে ফোন করলাম।
ঘরের মধ্যে আবার সেই থমথমে নীরবতা নেমে এল। কেউই কোন কথা বলছেন না। এরকুল পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিসেস লরিমারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মিসেস লরিমারের মুখে কোন ভাবান্তর নেই।
মিসেস লরিমার আপনি ঠিক বলছেন? আগে থেকে প্ল্যান করে আপনি সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের বাড়িতে হাজির হন নি? এটা আগে থেকে প্ল্যান করা খুন নয়? পোয়ারোর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
একমুহূর্ত পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস লরিমার, তারপর মাথা নাড়লেন, না। নিশ্চয়ই না।
তাহলে ম্যাডাম, খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি–আপনি নিশ্চয়ই আমাকে মিথ্যে বলেছেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি ভুল করছেন। মিসেস লরিমারের কণ্ঠস্বর বরফের মত ঠাণ্ডা শোনাল।
পোয়ারো অধৈৰ্য্যভাবে চেয়ার ছেড়ে ঘরের মধ্যে বিড়বিড় করতে করতে কয়েক পাক পায়চারি করলেন। হঠাৎ দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই উজ্জ্বল অপোয় সারা ঘর ভরে উঠল।
আবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসলেন পোয়ারো। দুই হাত হাঁটুতে রেখে তাকিয়ে রইলেন মিসেস লরিমার-এর দিকে।
এরকুল পোয়ারো কি কখনও ভুল করতে পারে?
৪. গম্ভীর স্বর ভেসে এল
সবসময় কেউই নির্ভুল হতে পারে না। বিরক্তিভরে বলে ওঠেন মিসস লরিমার।
আমি পারি। পোয়ারোর গম্ভীর স্বর ভেসে এল এবং এটা সবসময়ই এতই অনিবার্য যে মাঝে মাঝে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। তবুও এক্ষেত্রে একটা বিষয়ে আমার নিশ্চয় বড় রকমের ভুল হয়েছে। আপনি বলছেন যে খুনটা আপনি করেছেন। কিন্তু তা তো হতে পারে না। তাই যদি হত তাহলে কিভাবে আপনি এই খুনটা করেছেন এরকুল পোয়ারো তা আপনার থেকে ভালভাবেই জানত।
কি সব আবোল-তাবোল বকছেন। মিসেস লরিমার বলে ওঠেন।
আপনার মনে হতে পারে আমি পাগল। কিন্তু আমি তা নই। আমি নির্ভুল এবং অভ্রান্ত। মিঃ শেটানকে আপনি খুন করেছেন এ কথা আমি মেনে নিতে রাজি আছি, কিন্তু যেভাবে বলেছেন সেইভাবে খুনটা আপনি করতে পারেন না। নিজের চরিত্র বিরোধী কাজ কেউ করতে পারে না। হয় খুনটা আগে থেকে প্ল্যান করা, নয় আপনি এ খুন করেন নি। পোয়ারো মিসেস লরিমারের দিকে তাকালেন।
আপনি সত্যিই বদ্ধ পাগল। তীক্ষ্ণণ কণ্ঠে বলে ওঠেন মিসেস লরিমার। যখন আমি স্বেচ্ছায় বলছি যে খুনটা আমিই করেছি তখন কিভাবে খুনটা করেছি তাই নিয়ে মিথ্যে বলতে যাব কেন? আমার কি স্বার্থ?
এরকুল পোয়ারো আবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলেন। একটু পরে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। তাঁর উত্তেজনার ভাবটা কেটে গেছে।
এখন আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। খুনটা আপনি করেন নি। পোয়ায়োর শান্ত স্বর ভেসে এল, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি-কালেস্ট্রীটে অ্যানা মেরিডিথের বিষণ্ণ মূর্তির পাশাপাশি আরও একটি মেয়ের ছবি ফুটে উঠছে, যে মেয়েটি চিরটাকাল একাকী নিঃসঙ্গভাবে সময়ের সাঁকো পেরিয়ে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমার কাছে। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি নিশ্চিন্ত হলেন কি করে যে মিস মেরিডিথই খুন করেছে শেটানকে?
কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো–
মিথ্যে বলে কোন লাভ নেই ম্যাডাম। যেদিন কার্লেস্ট্রীটে আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি। ডাক্তার রবার্টস বা মেজর ডেসপার্ডের জন্য এরকম কাজ আপনি করবেন না। কিন্তু মিস মেরিডিথ?–তার প্রতি আপনার সমবেদনা আছে। কারণ সে যা করেছে অতীতে আপনি তাই করেছিলেন। আপনি হয়ত জানতেন না কি উদ্দেশ্যে মিস মেরিডিথ খুন করেছে শেটানকে, কিন্তু সে-ই যে খুন করেছে আপনি নিশ্চিতভাবে তা জানতেন। এমনকি ব্যাটেল যখন আপনাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তখনও জানতেন আপনি এ-কথা। বুঝতেই পারছেন গোটা ব্যাপারটাই আমার জানা। অপরের অপরাধের বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়ে আপনি যেভাবে একটি অল্পবয়সী মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন–সত্যি মহৎ আপনি।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন মঁসিয়ে পোয়ারো–শুকনো গলায় বলে ওঠেন মিসেস লরিমার, আমিও নিরপরাধ নই–অনেক বছর আগে আমি নিজের হাতে আমার স্বামীকে খুন করেছিলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন দুজনেই। তারপর পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এই হল বিধাতার অমোঘ বিচার। আপনার বিবেক বুদ্ধি রয়েছে নিজের অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে আপনি প্রস্তুত। খুনটা খুনই। নিহত ব্যক্তিই একমাত্র লক্ষ্য নয়। আপনার সাহস আছে ম্যাডাম। আপনার দৃষ্টিশক্তিও খুব স্বচ্ছ। কিন্তু মিসেস লরিমার–আপনি এত নিশ্চিন্ত হলেন কি করে যে মিস মেরিডিথই খুন করেছেন শেটানকে?
একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মিসেস লরিমার।
আমি যে তাকে খুন করতে দেখেছি মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো আচমকা হেসে উঠলেন। তার প্রাণখোলা হাসিতে সারা ঘর গম-গম করতে লাগল। একটু বাদে হাসি থামিয়ে বললেন, কি আশ্চর্য! ঘটনাটা নিয়ে এত তর্ক করলাম, যুক্তি দেখালাম, কত প্রশ্ন এল, অথচ এই ব্যাপারটার একজন প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। খুনটা তার চোখের সামনেই ঘটেছে। ম্যাডাম ঘটনাটা আমাকে খুলে বলুন।
তখন বেশ রাত। অ্যানা মেরিডিথ ডামি ছিল। ও উঠে দাঁড়িয়ে অন্য সকলের তাসগুলো উঁকি মেরে দেখে নিল। তারপর পায়চারি করতে লাগল ঘরের মধ্যে। এদিকে আমাদের তাসটাও সেরকম ঘোর প্যাঁচের ছিল না তাই খুব একটা মনোযোগ দিইনি। খেলাটা শেষ হবার মুখে আমার হঠাৎ নজর গেল মিঃ শেটানের দিকে। অ্যানা মেরিডিথ যেন সেখানে ঝুঁকে পড়ে কি করছে। তারপর আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়ালো কিন্তু তার হাতটা ভদ্রলোকের বুকের ওপর। মেরিডিথের চোখে মুখে আতঙ্ক আর ভয়ের ছাপ। সে চট করে আমাদের দিকে তাকালো, তখনই লক্ষ্য করলাম তার চোখে অপরাধের ছায়া। তখনও আমি ব্যাপারটা বুঝিনি, পরে অবশ্য সবই পরিস্কার হয়ে গেল। আহারে বেচারা কি ভয় বুকে নিয়েই না দিন কাটাচ্ছে। অথচ আমি যে ওকে লক্ষ্য করেছি তাও হয়ত জানে না। মঁসিয়ে পোয়ারো, আগে আমি এতটা সহানুভূতিশীল ছিলাম না। দয়া জিনিসটা কোন দিনই আমাকে এতটা বিচলিত করেনি, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই তো এ-সবের জন্ম।
কথাগুলো শুনতে ভালোই। পোয়ারোর মন্তব্য শোনা গেল। কিন্তু ম্যাডাম এর সবগুলোই সকলের প্রতি প্রযোজ্য নয়। অ্যানা মেরিডিথ অল্পবয়সী মুখে চোখে একটা ভীরু ভাব। মনে হয় একটু কড়া কথা বললেই কেঁদে ফেলবে–তাই না? হ্যাঁ ঠিকই, সকলের সমবেদনা জাগতে পারে। কিন্তু আমি সকলের সঙ্গে একমত নই। অ্যানা মেরিডিথ কেন শেটানকে খুন করেছে জানেন? কারণ মেরিডিথ এক কাজের বাড়িতে চুরি করে ধরা পড়ে, চিরকালের মত মুখ বন্ধ করার জন্য সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে খুন করেছিলেন, এ-কথা শেটান জানতেন।
অবাক হয়ে তাকালেন তার দিকে মিসেস লরিমার। এসব কি সত্যি মঁসিয়ে পোয়ারো?
প্রতিটি কথাই নিদারুণ সত্যি। লোকে ভাবে মিস মেরিডিথ শান্ত, ভদ্র মেয়ে। কিন্তু আসলে, ঐ ছোট, শান্তশিষ্ট মেয়েটি খুবই সাংঘাতিক, বিপজ্জনক। যেখানেই তার সুখ বা নিরাপত্তা জড়িত থাকবে সেখানেই সে হিংস্র বন্য হয়ে উঠবে। এবং ছোবল মারতেও দ্বিধা করবে না। কাউকে বিশ্বাস করে না সে। অপর এভাবেই খুন করতে করতে সে পাকাপোক্ত হয়ে যাবে। যাক আমি এখন বিদায় নেব ম্যাডাম, যা বললাম ভেবে দেখবেন।
যদি সেরকম মনে হয়, তবে আমি কিন্তু আজকের সমস্ত কথাবার্তা অস্বীকার করতে পারি। কোন সাক্ষীও নেই। সেদিন সন্ধ্যায় আমি যা দেখেছি তা শুধু আপনার আমার মধ্যেই থাকবে।
কোন ভয় নেই ম্যাডাম। আপনার অনুমতি ছাড়া কেউই কোন কথা জানবে না। তাছাড়া আমি নিজের সঠিক পথেই এগোচ্ছি।
মিসেস লরিমারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন পোয়ারো। রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পর কি মনে হতে মিসেস লরিমারের বাড়ির দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। অন্ধকারে স্পষ্ট না দেখা গেলেও মনে হল মিস মেরিডিথ গেট পেরিয়ে ঐ বাড়িতে ঢুকল। পোয়ারো ফিরে যাবেন কি না ভাবলেন একবার, কিন্তু মনস্থির করে নিজের পথেই পা বাড়ালেন তিনি।
বাড়ি ফিরেই ব্যাটেল কে ফোন করলেন পোয়ারো।
হ্যালো! ব্যাটেলের ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
আমি যা বলছি শুনুন। মিস মেরিডিথের সঙ্গে একবার দেখা করাটা খুব জরুরী। পোয়ারো উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন।
হ্যাঁ। সেটা আমিও জানি। কিন্তু এখনই ব্যাপারটা এত জরুরী হয়ে উঠল কেন?
মঁসিয়ে ব্যাটেল। যত সময় যাবে সে আরও সাংঘাতিকভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এটা ভুলে যাবেন না।
মিনিটখানেক চুপ করে থেকে ব্যাটেল বললেন, হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু সেরকম তো কেউ নেই–যাকগে, আমি অবশ্য তাকে সরকারীভাবে চিঠি লিখে জানাচ্ছি যে আমি আগামীকাল তার সঙ্গে উইলিংফোর্ডে দেখা করব। মনে হয়, এতে কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়বে সে। তখনই তাকে কায়দা করা সহজ হবে।
হ্যাঁ। এটা খারাপ না। আপত্তি না থাকলে আমি আপনার সঙ্গী হতে পারি।
আপত্তি? কি যে বলেন। আপনাকে সঙ্গী পেলে খুব খুশী হব।
রিসিভার নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইলেন পোয়ারো। তার মনটা কিছুতেই স্থির থাকতে চাইছে না। কিসের একটা আশঙ্কায় অস্বস্তি হচ্ছে তার।
কাল সকালেই দেখা যাবে। বিড় বিড় করতে করতে ঘুম চোখে বিছানার দিকে এগোলেন পোয়ারো।
আমার কর্ত্রী কিন্তু এসব ব্যাপার খুব অপছন্দ করতেন, স্যার। যাই ঘটুক না কেন গেরস্থ বাড়ি পুলিশ ঢুকবে কেন? তিনি যদি ভুল করে দু একটা বেশি ট্যাবলেট খেয়ে মারাই যান, সেটাতে দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। পুলিশের এতে মাথা গলাবার কি আছে?
মিসেস লরিমারের বাড়ির বৃদ্ধা দাসী পোয়ারোর কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। একটু আগেই মিসেস লরিমার-এর মৃত্যুর খবর পেয়েছেন পোয়ারো। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল তাকে ফোন করে খবরটা জানান। পুলিশের মতে–মিসেস লরিমার আত্মহত্যা করেছেন। পোয়ারোর সঙ্গে ডাঃ রবার্টসের দেখা হয়েছে এ বাড়িতে ঢোকার মুখে। তারও মত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন মিসেস লরিমার। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের কাছ থেকে পোয়ারো মোটামুটি ঘটনাটা জানতে পেরেছেন।
মৃত্যুর আগে মিসেস লরিমার বাকী তিনজন ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেপার্ড আর মিস মেরিডিথের নামে চিঠি লিখে গেছেন। পরিস্কার চিঠি, কোনরকম জটিলতা নেই। সব ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত হবার একটা পথই তার সামনে খোলা আছে আত্মহত্যা। শেটানের খুনী তিনি নিজেই। এই ঘটনায় অন্য তিনজনকে যে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। এই হল চিঠির মূল বক্তব্য।
সকাল আটটার ডাকে সর্বপ্রথম ডাঃ রবার্টস এই চিঠি পান। তারপর তিনি তার পরিচারিকাকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দেশ দিয়ে তড়িঘড়ি উপস্থিত হন মিসেস লরিমার-এর বাড়িতে। যেখানে গিয়ে শোনেন যে মিসেস লরিমার তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। দ্রুত পায় তার শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হন ডাঃ রবার্টস। কিন্তু তখন আর করার কিছু ছিল না, সব শেষ। ভদ্রমহিলার মাথার কাছে টেবিলে একটা ভেরোনাইলের ফাইল পাওয়া গেছে। এক ধরণের ঘুমের ওষুধ। ফাইলের অর্ধেকটাই খালি। ডাঃ রবার্টসের পরিচারিকার ফোন পেয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ডিভিশনাল সার্জেনও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস লরিমারের বাড়িতে উপস্থিত হন। তারও একই মত, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন মিসেস লরিমার।
মেজর ডেসপার্ড শহরের বাইরে গেছেন, সুতরাং সেদিন সকালের ডাকে চিঠি পাননি তিনি। মিস মেরিডিথ চিঠি পেয়েছেন।
পোয়ারো বাস্তবে ফিরে এলেন। তখনও সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বদ্ধা দাসী-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
কি ভয়ঙ্কর, বীভৎস ব্যাপার স্যার। কাল সন্ধ্যাবেলায় তো আপনি তার সঙ্গে চা খেলেন, কি সুন্দর ভদ্র ব্যবহার করলেন তিনি। আর আজ সকালেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ঐ যে ডাক্তার রবার্টস না কি যেন ভদ্র লোক। তা সেই ভদ্রলোক ভোরে এসে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, মিসেস লরিমার কোথায়? আমি তো অবাক, বললাম যে তিনি ঘুম থেকে উঠে ঘন্টি না বাজালে কেউ তাকে বিরক্ত করে না, এটাই তার আদেশ। ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তার শোবার ঘর কোথায়, বলতে বলতে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। আমিও দাঁড়ালাম তার পেছন পেছন। দূর থেকে শোবার ঘরটা দেখতেই তিনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠলেন।–হ্যায়-হায়, বড় দেরী হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি আমাদের কী খাটের ওপর পড়ে আছেন, স্থির দেহ। ডাক্তার ভদ্রলোক তবু তার হৃৎস্পন্দন চালু করার কত চেষ্টা করলেন। আমাকে বললেন গরম জল আর ব্রাণ্ডি নিয়ে আসতে। কিন্তু সব ব্যর্থ হল। ইতিমধ্যে আবার পুলিশের গাড়িও এসে গেছে–তারপর এই ঝামেলা, এটা কিন্তু ঠিক হল না স্যার। এখানে পুলিশ আসবে কেন?
পোয়ারো এ-কথার জবাব দিলেন না, প্রণাম করলেন, গতকাল রাত্রে মিসেস লরিমারকে কি কোন কারণে উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত মনে হচ্ছিল?
না তো স্যার। স্বাভাবিকই ছিল। তবে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, মনে হয় খুব যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন তিনি। ইদানিং শরীরও বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। গতকাল আপনি চলে যাবার পর আর একটি অল্পবয়সী মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। মনে হয় সেই কারণেও তিনি খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারেন।
পোয়ারো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালেন।
তরুণী মহিলা?
হ্যাঁ স্যার। নাম বললেন–মিস মেরিডিথ।
কতক্ষণ ছিলেন তিনি?
প্রায় ঘণ্টাখানেক। তারপর আমার কর্ত্রী শুতে গেলেন। সন্ধ্যোর ডিনারটা শোবার ঘরেই দিতে বললেন, খুব ক্লান্ত বোধ করছিলেন তিনি।
পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। গতকাল সন্ধ্যায় কি কোন চিঠিপত্র লিখেছিলেন তোমার কর্ত্রী?
শুতে যাবার আগে কিছু লিখেছিলেন কিনা ঠিক জানি না তবে বসবার ঘরের টেবিলের ওপর ডাকে পাঠাবার জন্যে কয়েকটা চিঠি পড়েছিল। রাত্রে গেট বন্ধ করবার আগে সেগুলো তাকে দিয়ে আসি আমি। কিন্তু সে চিঠিগুলোতে অনেক আগে থেকেই টেবিলে রাখা ছিল।
মোট কটা চিঠি ছিল?
ঠিক সংখ্যাটা মনে নেই। দুটো কি তিনটে। তিনটেই বোধহয়।
ডাকে দেবার আগে চিঠির ওপরের ঠিকানাগুলো লক্ষ্য করেছিলে? ভালো করে ভেবে বল, ব্যাপারটা খুব জরুরী।
চিঠিগুলো ডাকবাক্সে ফেলার সময় ওপরের চিঠির ঠিকানাটা নজরে পড়েছিল–সেটা হচ্ছে ফোঁটাম অ্যাণ্ড ম্যাসন। তবে অন্যগুলোর কথা তো ঠিক বলতে পারব না।
চিঠি যে ঠিক তিনটের বেশি ছিল না তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ স্যার।
পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন কয়েকবার। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সিঁড়ির দিকে। তোমার কী যে ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করতেন তুমি জানতে?
হ্যাঁ স্যার, ডাঃ লঙই তাকে ঘুমের ওষুধ খেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সেই ওষুধের শিশিটা কোথায় থাকত?
তার শোবার ঘরের ছোট জালের আলমারিটার মধ্যে।
আর কোন প্রশ্ন না করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন পোয়ারো। গম্ভীর থমথমে মুখ।
দোতলায় সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল এবং ডিভশনাল সার্জনের সঙ্গে দেখা হলো তার। তাদের সব পরীক্ষা তখন শেষ। ব্যাটেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মিসেস লরিমার-এর শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন পোয়ারো। মৃত দেহটা একবার নিজে পরীক্ষা করবেন তিনি।
ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন পোয়ারো। প্রাণহীন দেহটা বিছানার ওপর স্থির হয়ে পড়ে আছে। ঝুঁকে মিসেস লরিমারের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
পোয়ারোর বুকের ভেতর একটা জমাট অশান্তি ক্রমেই দানা বাঁধছে। সত্যিই কি মিসেস রিমার একটি তরুণীকে অপমান এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত এই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন? না কোন অন্য রহস্যময় কারণ আছে?
অন্তত কয়েকটা তথ্য যদি জানা যেত–
হঠাৎ খাটের ওপর আর একটু ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো। মৃতদেহের বাঁ হাতের মাঝখানে একফেঁটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো, তার দুচোখের মধ্যে চকচক করছে অদ্ভুত একধরণের সবুজ আলো। পোয়ারোকে যারা গভীরভাবে চেনেন, তারা এ দৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত।
ঘর ছেড়ে নিচে নেমে এলেন পোয়ারো। দেখলেন, ফোনের পাশে ব্যাটেল তার এক অধীনস্থ কর্মচারীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু বাদে ফোন নামিয়ে রাখলেন কর্মচারীটি। না, স্যার, তিনি এখনো তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন নি।
পোয়ারোর দিকে তাকালেন ব্যাটেল। মেজর ডেসপার্ডকে অনেকক্ষণ থেকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছে। তার নামে চেলসী ডাকঘরের ছাপ মারা একটা চিঠি আছে।
ডাক্তার রবার্টস কি এখানে আসার আগে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছিলেন? পোয়ারো হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন।
অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকালেন ব্যাটেল। না, ভদ্রলোক একবার বলেছিলেন, ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
তাহলে, নিশ্চয়ই বাড়িতে আছেন এখন।
কিন্তু কেন?
পোয়ারো ততক্ষণে রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করেছেন।
ডাঃ রবার্টস? সুপ্রভাত। আমি এরকুল পোয়ারো। একটা প্রশ্ন আছে। আপনি কি লরিমারের হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত? পরিচিত নন? আগে কখনো দেখেননি বলছেন। আচ্ছা আচ্ছা, ধন্যবাদ, অশেষ ধন্যবাদ। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন পোয়ারো।
আপনার মতলবটা কি মঁসিয়ে পোয়ারো। ব্যাটেল অবাক হয়ে বলে উঠলেন।
ব্যাটেলের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো। গতকাল সন্ধ্যায় এখান থেকে আমি বিদায় নেবার পর, মিস মেরিডিথ এ-বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি চলে যাবার পর মিসেস লরিমার শুতে যান। সেই সময় এ বাড়ির ঝি তাকে কোন চিঠিপত্র লিখতে দেখেনি। আর গতকাল সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার আগেই যে তিনি এ চিঠিগুলো লিখে রেখেছিলেন সেটাও ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কারণ, তাহলে তার কথাবার্তাতেও কিছু একটা আঁচ করা যেত। তবে চিঠি তিনটে কখন লিখলেন?
কেন? কাজের লোকেরা শুতে যাবার পর, হয়ত নিজেই বাইরে গিয়ে এগুলো ডাকে দিয়ে এসেছিলেন।
হ্যাঁ হতে পারে। মাথা নাড়লেন পোয়ারো। আবার এমনও তো হতে পারে যে চিঠিগুলো তিনি আদৌ লেখেন নি।
কি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো-ব্যাটেলের কথা শেষ হবার আগেই ঝনঝন শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরে একটু পরেই রিসিভার নামিয়ে রাখল পুলিশ কর্মচারীটি।
স্যার মেজর ডেসপার্ডের ফ্ল্যাট থেকে সার্জেন্ট ওকোনার জানাচ্ছে যে ডেসপার্ড আজ সকালে উইলিংফোর্ড-এ যেতে পারেন।
পোয়ারো রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন–ব্যাটেলের হাত ধরে টানলেন তিনি। এক্ষুণি উইলিংফোর্ডে যাবার ব্যবস্থা করুন, এক মুহূর্তও সময় নেই। একটা ভয়ানক কিছু ঘটতে যাচ্ছে, হয়ত এই শেষ নয়। আপনাকে আগেই বলেছি সুন্দরী মেরিডিথ অল্প বয়সী হলেও খুবই সাংঘাতিক আর বিপজ্জনক–এটা ভুললে চলবে না।
অ্যানা, রোডা বলে উঠল, কি হল তোর, তখন থেকে ডাকছি। ওসব পাজল-টাজল রাখ। যা বলছি মন দিয়ে শোন।
অ্যানা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটা দৈনিক পত্রিকার ক্রশ-ওয়ার্ড পাজলের সমাধান খুঁজছিল। রোডার কথায় কাগজটা মুড়ে রাখল। কি বলছিস বল?
হ্যাঁ, শোন্–ইতস্তত করল রোডা। ভদ্রলোক তো আবার আসছেন।
কার কথা বলছিস? সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল?
হ্যাঁ। আমার কি মনে হয় জানিস, মিসেস বেনসনের ব্যাপারটা তাকে বলে দেওয়াই ভালো।
তুই কি পাগল নাকি? অ্যানার ঠাণ্ডা জবাব ভেসে এল, এখন এ কথা বলতে যাবো কেন?
কারণ–কারণ তিনি ভাবতে পারেন তুই হয়ত ঘটনাটা লুকোতে চাইছিস। অত ঝামেলার কি দরকার? তার থেকে আসল ব্যাপারটা ভদ্রলোককে জানিয়ে দে।
এখন আর তা বলা যায় না।
প্রথমে বললেই ভালো করতিস।
হ্যাঁ। কিন্তু এতদিন বাদে আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
তা অবশ্য ঠিক।
আমি তোর কথার মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারছি না রোডা। বিরক্ত হয়ে ওঠে অ্যানা।
সেই ঘটনার সঙ্গে তখনকার ঘটনার কি সম্পর্ক? তা ছাড়া সুপারিনটেন্টে ব্যাটেল চাইছেন আমার স্বভাব-চরিত্রের সম্বন্ধে খোঁজখবর। আমি তো সেখানে ছিলাম মাত্র দু মাস। ঐ দুমাসে তারা আমার কতটুকু পরিচয়ই বা পাবে?
ঠিকই বলেছিস। অমি হয়ত বোকার মতো কথা বলছি। তবুও জানিস কেমন একটা অস্বস্তি রয়েছে। সবকিছু খুলে বলাটাই ভাল। ধর, ব্যাটেল ব্যাপারটা কোনভাবে জানতে পারলেন, তখন তো ভাববেন যে তুই ইচ্ছে করে ব্যাপারটা চেপে গেছিস। অযথা সন্দেহ বাড়বে।
একটা জিনিস কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, বাইরের কেউ এ কথা জানবে কি করে? একমাত্র তুই আর আমিই ব্যাপারটা জানি, আর কেউই জানে না।
না, তা যদিও জানে না– তোতলাতে শুরু করল রোডা।
অ্যানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোলার দিকে ফিরে তাকাল, রোডার ইতস্তত ভাব আর নজর এড়ায় নি। কেন আর কে জানে বলে তোর মনে হয়?
একটু চুপ করে থেকে রোডা উত্তর দিল, অনেকেই। কোম্বীকারের বাসিন্দারা নিশ্চয়ই অত সহজে ঘটনাটা ভুলবে না।
ওঃ এই কথা! হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অ্যানা। সেখানকার কারো সাথে সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের দেখা হবে কি না সন্দেহ। একেবারেই অসম্ভব।
কিন্তু অসম্ভব অনেক কিছুই এ পৃথিবীতে ঘটে থাকে।
রোডা! সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছিস তুই।
খুব দুঃখিত, অ্যানা, তবে কথাটা পুলিশের কানে গেলে তারা ভাববে তুই কিছু লুকিয়েছিস।
তারা জানবে কি ভাবে? কে বলবে এ কথা? তুই আর আমি ছাড়া তো কেউই জানে না। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কথাটা উচ্চারণ করল অ্যানা, কিন্তু তার গলার স্বর পাল্টে গেছে, উচ্চারণের ভঙ্গীটাও অদ্ভুত, কেমন একটা শিরশিরে শিহরণ জাগায়।
রোডা ব্যাজার মুখে বলল, তাহলেও কিন্তু তোর বলা উচিত। অ্যানার দিকে ফিরে তাকাল রোডা। কিন্তু অ্যানা তখন চুপ করে কি যেন ভাবছে। তার দীর্ঘ –জোড়া কুঁচকে মনে মনে যেন কোন কিছু হিসাব কষছে সে।
রোডা হঠাৎ প্রশ্ন করল, গোয়েন্দাপ্রবর ব্যাটেল কখন এখানে পায়ের ধুলো দেবে?
বেলা বারোটায়। অ্যানা জবাব দিল–এখন তো সাড়ে দশটা। চল রোডা নদী থেকে স্নান করে আসি।
কিন্তু মেজর ডেসপার্ড তো এগারোটা নাগাদ এসে পড়বেন, সেই রকমই তো চিঠিতে জানিয়ে দেন তিনি।
তাতে কি? মিসেস অষ্টওয়েলের কাছে একটা চিরকুট লিখে রেখে গেলেই চলবে। সেরকম জরুরী দরকার থাকলে তিনি নদীর ধারেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
তা অবশ্য ঠিক, চল্ নদী থেকেই ঘুরে আসি
বাগানের পায়ে চলা সরু পথ ধরে নদীর দিকে পা বাড়াল রোডা আর অ্যানা।
দশ মিনিট বাদে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হাজির হলেন মেজর ডেসপার্ড। দু-জনেই বেরিয়ে গেছে শুনে অবাক হয়ে গেলেন, মেঠো পথ ধরে নদীর দিকে রওনা হলেন তিনি।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কলিংবেলটা বেজে ওঠে ওয়েডেন কুটিরে। পরিচারিকা মিসেস অস্টওয়েল আপনমনে গজগজ করতে করতে দরজা খুলে দিল।
এখানে ছোটখাট চেহারার বিদেশী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, তার সঙ্গে একজন বলিষ্ঠ চেহারার ইংরেজ। মিস মেরিডিথ কি বাড়িতে আছেন? লম্বা ভদ্রলোকটি এগিয়ে এলেন।
না, নদীতে স্নান করতে গেছেন।
বিদেশী ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আর মিসেস দোবাস?
দুজনেই এক সাথে গেছেন।
ধন্যবাদ। ব্যাটেল বললেন, নদীর দিকে যাবার রাস্তাটা কোনদিকে? মিসেস অস্টওয়েলের কাছ থেকে রাস্তাটা জেনে সেদিকে পা বাড়ালেন ব্যাটেল এবং পোয়ারো।
পোয়ারোকে উত্তেজিতভাবে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে দেখে ব্যাটেল কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। কি ব্যাপার মঁসিয়ে পোয়ারো? হঠাৎ এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে?
কেন জানি না, খুব অস্বস্তি বোধ করছি।
কোন কিছু আশঙ্কা করছেন নিশ্চয়ই। সকালবেলাই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এখানে চলে এলেন। আবার আপনার কথাতেই আমি কনস্টেবল টার্পারকে এ অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করার নির্দেশ পাঠালাম। মেয়েটা কি সাংঘাতিক কোন কিছু করে বসতে পারে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?
এই পরিস্থিতিতে আর কি আশঙ্কা করব বলুন?
ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। তা ঠিক। তবে আমি একটা কথা ভাছি–মেরিডিথ কি জানে যে তার বন্ধু মিসেস অলিভারের কাছে গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে?
মাথা দোলালেন পোয়ারো। ঠিক তাই। সেই জন্যই তো বলছি তাড়াতাড়ি চলুন।
দুজনেই তাড়াতাড়ি হেঁটে চললেন। নদীতে নৌকা বা স্টীমার নেই। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে রাস্তার পাশে স্থির হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন পোয়ারো।
তাদের থেকে শ-দুয়েক গজ দূরে মেজর ডেসপার্ড নদীর দিকে এগোচ্ছেন।
এখান থেকে নদীটা দেখা যাচ্ছে। নদীর মাঝ-বরাবর একটা ডিঙিতে বসে আছে। অ্যানা আর রোডা। দাঁড় টানছে রোডা, তার সামনে বসে গল্প করছে অ্যানা। দুজনেই কেউই তীরের এই লোকগুলোকে লক্ষ্য করেনি।
ঠিক সেই সময় অ্যানা দু হাত বাড়িয়ে ধাক্কা মারল রোডাকে। পড়ে যেতে যেতে অ্যানার জামা ধরে টাল সালাবার চেষ্টা করল রোডা। কঁকানিতে উল্টে গেল ডিঙিটা, দুজনে জড়াজড়ি করে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
ব্যাটেল ও পোয়ারো দুজনেই দৌড়তে শুরু করলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল দেখুন দেখুন, অ্যানা মেরিডিথ ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে তার বন্ধুকে জলে ফেলে দিল।
কিন্তু তাদের অনেক আগেই ছিলেন মেজর ডেসপার্ড। মেয়ে দুজনের কেউই যে সাঁতার জানে না তাদের হাবেভাবেই বোঝা যাছিল। ইতিমধ্যে ডেসপার্ড নদীর তীরে পৌঁছে গেছেন। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। সাঁতার কেটে তাদের দিকে এগোলেন ডেসপার্ড।
ব্যাটেলও জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ততক্ষণে রোডাকে জল থেকে তুলে নদীর তীরে একটা পরিষ্কার জায়গায় শুইয়ে দিলেন ডেসপার্ড। আবার ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়লেন তিনি। এবার তিনি এগিয়ে চললেন সেই দিকে, যেখানে অল্প আগেও অ্যানাকে হাঁকডাক করতে দেখা গেছে।
সাবধান! চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল। এখানে অনেক বুনো আগাছা আছে। পায়ে জড়িয়ে বিপদ হতে পারে।
তারা দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে সেই জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছলেন, কিন্তু ততক্ষণে অ্যানা জলের তলায় তলিয়ে গেছে।
শেষ অবধি অনেক চেষ্টা করে অ্যানাকে খুঁজে পাওয়া গেল। ব্যাটেল আর ডেসপার্ড তুলে আনলেন অ্যানাকে। রোডার থেকে হাত তিনেক দূরে শোয়ানো হল তাকে।
পোয়ারোর সেবা শুশ্রূষায় ইতিমধ্যে রোডার জ্ঞান ফিরে এসেছে। শ্বাস প্রশ্বাসও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনা ছাড়া উপায় নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ব্যাটেল। তবে মনে হয় না কোন কাজ দেবে। সম্ভবতঃ অ্যানা মেরিডিথ মারা গেছে।
ব্যাটেল তৎক্ষণাৎ শ্বাস প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লেগে গেলেন, তাঁকে সাহায্য করার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন পোয়ারো।
আপনি কি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো– নোডার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–অ্যানা আমাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল? আমারও অবশ্য সেইরকমই মনে হল, কেননা ও তো জানত আমি সাঁতার জানি না। কিন্তু ও কি এটা ইচ্ছাকৃত করল?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করা– পোয়ারো গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন। গাড়ি তখন ছুটে চলেছে লণ্ডনের সীমান্ত দিয়ে।
কিন্তু কেন?
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল ফিরে তাকালেন রোডার দিকে। কেন জানতে হলে আপনার মনকে প্রস্তুত করুন মিস দোবাস। আমি এবার যা বলব তাতে আপনি প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। আপনার বন্ধু যে মিসেস বেনসনের বাড়িতে কাজ করতেন তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে খুন করে আনা মেরিডিথ।
এসব কি বলছেন আপনি?
আমাদের বিশ্বাস, পোয়ারোর জবাব ভেসে এল। অ্যানাই বোতল দুটো বদলে রেখেছিল।
না-না–এ হতে পারে না। এমন সাংঘাতিক কাজ অ্যানা করতেই পারে না। কেনই বা সে খুন করবে?
তার পেছনেও কারণ আছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল বললেন। সে যাই হোক, অ্যানার ধারণা ছিল একমাত্র আপনিই আমাদের কাছে এ ঘটনার হদিশ দিতে পারেন। আচ্ছা, মিস দোবাস, আপনি কি মিসেস অলিভারের কাছে এই ঘটনাটা নিয়ে গল্প করেছেন এ-কথা নিশ্চয়ই আপনার বন্ধুকে জানাননি?
না। মৃদু জবাব দেয় রোড, ভেবেছিলাম ও তাতে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে।
তা হতো, খুবই বিরক্ত হত। ব্যাটেল মন্তব্য করলেন, তবে মিস মেরিডিথ জানত ঘটনাটা একমাত্র আপনিই জানেন। তাই আপনার দিক থেকেই বিপদ আসবার সম্ভাবনা সেইজন্য পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল আপনাকে।
আমাকে সরিয়ে দিতে? কি সাংঘাতিক কাণ্ড। আমার কিন্তু এখনও ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
যাক, যখন সে মারাই গেছে, তখন আর এ নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। তবে বন্ধু হিসাবে মিস মেরিডিথ যে মোটেই ভাল ছিল না, এতে কোন সন্দেহ নেই।
গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল।
এটা হচ্ছে মঁসিয়ে পোয়ারোর বাড়ি। চলুন, আমরা সকলে এখানে বসেই সমস্ত বিষয়টা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করবো।
পোয়ারোর ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিলেন মিসেস অলিভার আর ডাক্তার রবার্টস।
আসুন আসুন। মিসেস অলিভার সকলকে স্বাগত জানালেন, আপনার টেলিফোন পাওয়া মাত্রই আমি ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করে, দুজনে এখানে এসে হাজির হয়েছি। রবার্টসের পেশেন্টরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সে যাই হোক, আমরা কিন্তু এই ঘটনার আগা-গোড়া সমস্তটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছি।
হ্যাঁ। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল–শেষ পর্যন্ত আমরা মিঃ শেটানের খুনীকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।
আমার কাছে কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই অস্পষ্ট ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরী মেরিডিথই যে খুনী, এ তো কোনদিন ভাবতেই পারিনি। রবার্টস বললেন।
সে যে একজন খুনী, কোন সন্দেহ নেই। ব্যাটেলের মন্তব্য শোনা গেল, এর আগেও তিন-তিনটে খুন করে শেষবারে অর্থাৎ চার নম্বর খুনটাতে সফল হতে পারেনি।
অবিশ্বাস্য! বিড় বিড় করলেন রবার্টস।
মোটেই না। মিসেস অলিভার বলে উঠলেন গোয়েন্দা গল্পে যে রকম ঘটে, যার ওপর কম সন্দেহ হয়, দেখা যায় সে-ই আসল খুনী। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
আচ্ছা মিসেস লরিমারের চিঠিটা নিশ্চয়ই জাল?রবার্টস ফিরে তাকলেন পোয়ায়োর দিকে।
নিঃসন্দেহে, তিনটে চিঠিই জাল।
তাহলে মিস মেরিডিথও নিজের নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন?
সেটাই স্বাভাবিক। নকলটাও খুব দক্ষতা নিয়ে করা হয়েছিল। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে ঠিকই ধরা পড়ল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামতের দরকার হত না, মিসেস লরিমার যে আত্মহত্যা করেছেন, পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো তাই বলে।
মসিয়ে পোয়ারো, মিসেস লরিমারের মৃত্যুটা যে আদৌ আত্মহত্যা নয়, একেবারে পরিকল্পনা করা খুন এটা আপনি সন্দেহ করলেন কিভাবে?
চেইন লেনে। তার বাড়িতে বৃদ্ধা কাজের লোকের সঙ্গে কথা বলে।
তাঁর কাছ থেকেই বোধহয় খবর পেয়েছিলেন, যে অ্যানা মেরিডিথ আগের দিন সন্ধ্যায় দেখা করতে আসেন মিসেস লরিমারের সঙ্গে?
হ্যাঁ, অন্যান্য খবরের সঙ্গে এটাও সে বলেছিল। তাছাড়া আসল খুনী কে, সে সম্বন্ধেও মনে মনে আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, মানে মিঃ শেটানের খুনী কে আমি জানতাম এবং তিনি মিসেস লরিমার নন, এও জানতাম।
মিস মেরিডিথকে আপনি সন্দেহ করলেন কেন? ডাঃ রবার্টস বললেন।
ধৈর্য্য ধরুন। ডাক্তার রবার্টসকে বাধা দিলেন পোয়ারো।
সবটাই বলব আমি। তবে আমার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এক এক করে বাছাই করে বলা। সেভাবেই বলব। মিসেস লরিমার খুন করেননি, মিঃ শেটানকে। মোরে ডেসপার্ডও তাকে খুন করেননি। শুনলে আরও অবাক হবেন এই খুনের পেছনে মিস মেরিডিথের কোন হাত ছিল না–
সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো, তার মৃদু কোমল কণ্ঠস্বর বাতাস ছুঁয়ে গেল। তাহলে বুঝতে পারছেন ডাক্তার রবার্টস, বাকি থাকেন আপনি। আপনিই মিঃ শেটানকে খুন করেছেন এবং মিসেস লরিমারকেও।
মিনিট তিনেক কারোর মুখেই কথা ফুটল না।
একটা চাপা অস্বস্তিকর নীরবতায় থমথম করছে সারা ঘর। হঠাৎ রবার্টস বীভৎস ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আপনি কি পাগল মঁসিয়ে পোয়ারো? মিঃ শেটানকে আমি খুন করিনি আর মিসেস লরিমারকে খুন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। মিঃ ব্যাটেল এসব আজগুবি কথা শুনবার জন্যই আমাকে ডেকে এনেছেন?
মঁসিয়ে পোয়ারোর বক্তব্যটা শুনলেই আপনি ভাল করবেন ডাঃ রবার্টস। ব্যাটেলের শান্তস্বর ভেসে এল।
যদিও কিছুদিন আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে একমাত্র আপনার পক্ষেই মিঃ শেটানকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু আমার হাতে কোন সঠিক প্রমাণ ছিল না। কিন্তু পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রবার্টসের দিকে। কিন্তু মিসেস লরিমারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে আপনি প্রত্যক্ষদর্শী থেকে জানা গেছে যে আদালতে দাঁড়িয়ে আপনার অপকীর্তির সাক্ষ্য দিতে পারবে।
রবার্টসের হাবভাব ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো, চোখের দৃষ্টিতে একটা উজ্জ্বল চকচকে আভা। আপনি আবোল তাবোল বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
একটুও ভুল নয়। আজ ভোরে আপনি ঝিয়ের কাছে বাজে ভাওতা দিয়ে মিসেস লরিমারের শোবার ঘরে ঢুকলেন–গত রাত্রে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে মিসেস লরিমার তখন গভীর ঘুমে অচেতন। আপনি আবার বৃদ্ধা ঝিকে ভাওতার দিয়ে বললেন, মিসেস লরিমার খুব সম্ভবত মারা গেছেন তবুও একবার শেষ চেষ্টা করবেন আপনি। এজন্য তাকে ব্রাণ্ডি আর গরম জল আনতে পাঠান, ঘরে কেউ ছিল না। ঝি একবার মাত্র উঁকি দিয়ে তার কর্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিল, তাই তিনি মৃত কি জীবিত এটা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আপনি হয়ত জানেন না ডাক্তার রবার্টস সেই ভোরে জানালায় জমে থাকা বরফ পরিস্কার করতে একজন উইণ্ডো-ক্লীনার্স মিসেস লরিমারের জানালার কাঁচ পরিস্কার করতে এসেছিল। ব্যাপারটা সেই দেখে, তার মুখ থেকেই শোনা যাক।
পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন-ভেতরে এসো স্টিফেন্স।
একটু পরেই শ্রমিক শ্রেণীর দশাসই চেহারার একজন লোক ঘরে ঢুকলো, ডান হাতে ধরা একটা ক্যাম্বিসের টুপি। তাতে গোল করে লেখা-চেলসী উইণ্ডো ক্লীনার্স অ্যাসোসিয়েশান।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঘরের মধ্যে কাউকে কি তুমি চিনতে পেরেছ?
লোকটা চারিদিকে তাকিয়ে দেখল তারপর ডাক্তারকে দেখিয়ে বলে উঠল, এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছি।
শেষ যখন তুমি এঁকে দেখ, কি করছিলেন তখন এই ভদ্রলোক?
আজ ভোরবেলা, তখন বোধহয় আটটাও বাজেনি, চেইন লেনে এক ভদ্রমহিলার ঘরের জানলায় জমে থাকা বরফ সাফ করছিলাম। এই ভদ্রলোক তখন ভদ্রমহিলার বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে সিরিঞ্জ দেখে ভেবেছিলাম বোধহয় ডাক্তার। ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়ে ছিলেন, খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে। ঘুমের ঘোরে একবার চোখ মেলে তাকালেন। এই ভদ্রলোক তখন ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা খুব দ্রুত ভদ্রমহিলার হাতে ফুঁড়ে দিলেন, ভদ্রমহিলা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন চোখ বুজে। আমি সেখানে আর অপেক্ষা না করে অন্য দিকে এগোলাম।
বাঃ অপূর্ব, অপূর্ব! পোয়ারো বলে উঠলেন, তাহলে ডাক্তার রবার্টস?
একটা সাধারণ-সাধারণ শক্তিবর্ধক ওষুধ তোতলাতে শুরু করলেন রবার্টস, তার জ্ঞান ফেরাবার জন্য
সাধারণ শক্তিবর্ধক? পোয়ারো তীব্র দৃষ্টিতে ডাক্তার রবার্টসের দিকে। এন-মিথাইল-সাইক্লো হেক্সানিল-ম্যালাথিন ইউরিয়া। যাকে বলে এভিপ্যান। ছোটখাটো অপারেশান-এর সময়ে সেই জায়গাটা অসাড় করতে লাগে। শিরার মধ্যে বেশি পরিমাণ এভিপ্যান ইনজেক্ট করলে সঙ্গে সঙ্গে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়তে বাধ্য। ভোয়রাম্যাল বা ঐ জাতীয় ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের পর এভিপ্যান প্রয়োগ প্রচণ্ড বিপজ্জনক। মিসেস লরিমারের হাতের ওপর আমি তো একটা ইনজেকশানের চিহ্ন দেখেছিলাম। পুলিশ সার্জেনকে ব্যাপারটা জানানোর পর তারা পরীক্ষা করে আমাকে এই তথ্য জানান।
এতেই আমাদের চলে যাবে। ব্যাটেল মন্তব্য করলেন শেটানের মৃত্যুর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার হবে না। অবশ্য প্রয়োজন হলে মিঃ ক্র্যাক আর মিসেস ক্র্যাডককে খুন করার দায়ে আপনাকে অভিযুক্ত করা যায়।
ক্র্যাডকদের নাম শুনেই ডাঃ রবার্টস হতাশভাবে মুষড়ে পড়লেন। কোন প্রতিবাদ করতে পারলেন না তিনি। হতাশাভাবে এলিয়ে পড়লেন চেয়ারের ওপর।
বেশ, আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন ডাঃ রবার্ট, আর বাধা দেব না, মনে হয় শয়তান শেটানই এ বিষয়ে আপনাদের কোন আভাস দিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম খুব ভালোভাবেই শেটানের মুখটা বন্ধ করতে পেরে
না, শেটান নয়। ব্যাটেল বললেন, সমস্ত কৃতিত্বটাই মঁসিয়ে পোয়ারোর।
ডাক্তার রবার্টসকে সঙ্গে করে দুজন পুলিশ কর্মচারী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তখনই বলেছিলাম, রবার্টস-এর কীর্তি– মিসেস অলিভার বলে উঠলেন।
পোয়ারো গম্ভীরভাবে সোফার ওপর বসে রয়েছেন, ঘরের সকলের উদগ্রীব দৃষ্টি তার দিকে। বলতে শুরু করলেন পোয়ারো।
আমি জীবনভর যতগুলো রহস্যময় মামলার মুখোমুখি হয়েছি বলতে বাধা নেই তার মধ্যে সবথেকে জটিল আর চমকপ্রদ মামলা হল এটা। এগিয়ে যাবার মত কোন সূত্র হাতে নেই, চারজন মাত্র লোক এবং তাদের মধ্যে একজন এই অপকীর্তির নায়ক। কিন্তু কে সে? কোন প্রমাণ-কাগজপত্র এমনকি কোন হাতের ছাপও নেই। শুধু সন্দেহভাজন চারজনই আমাদের সামনে হাজির।
আর একটা মাত্র সূত্র পাওয়া গেছে ব্রীজ খেলার চারটে স্কোরশীট, শুধু হাতে এল এইটা।
আপনাদের হয়ত মনে আছে, আমি প্রথমদিকে এই স্কোরশীটগুলোর উপর বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলাম। কারণ এর মধ্যেই ঐ চারজনের মনের গতিবিধির কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। সত্যিই এর মধ্যে একটা মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেল। দেখলাম রাবারের স্কোরশীটে একদিকে লেখা রয়েছে১৫০০ সংখ্যাটা। বুঝলাম এটা বেশ বড় খেলা মানে গ্রাণ্ডস্ল্যামের খেলা। সেদিন সন্ধ্যের পরিবেশটা কল্পনা করুন, সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে শেটানকে যখন খুন করার কথা ভাবছে কোন একজন তাকে অন্তত দুটো মারাত্মক ঝুঁকি নিতে হবে, প্রথমটা মারা যাবার আগে শেটান চীৎকার করে উঠতে পারেন, দ্বিতীয়ত সেই মুহূর্তে কেউ খুনীকে দেখে ফেলতে পারে।
ভেবে দেখুন, প্রথম ঝুঁকিটায় করার কিছু নেই, ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু দ্বিতীয়টা? সেটা তা নয়, চেষ্টা করলে কিছু করা যেতে পারে। সাধারণ তাস পড়লে ব্রিজ খেলোয়াড়রা খুব একটা মনোযোগ দেন না, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন, গল্প করেন নিজেদের মধ্যে। কিন্তু কোন জটিল তাসের খেলা হলে, বিশেষতঃ তা যদি গ্র্যাণ্ডস্ল্যামের খেলা হয় সকলেই খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গ্র্যাণ্ডস্ল্যামের খেলা। তিনজন খেলোয়াড়ই মন দিয়ে তাস খেলছে। একজনের চিন্তা কিভাবে তেরোটা পিটই তোলা যায়। আবার অন্য পক্ষ চেষ্টা করছে কোন সুযোগে একটা পিটও অন্তত ছিনিয়ে নেওয়া যায়। পার্টনার কোন রঙটায় উৎসাহ দেখাচ্ছে, কোনটায় দেখাচ্ছে না, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখতে হয় সবকিছুর ওপর। ভেবে দেখলাম, একমাত্র ডামিই পারে এরকম পরিবেশে খুন করতে। খোঁজ করে জানলাম ডাঃ রবার্টসই ছিলেন এই ডিলটার ডামি। যে কোন দুজন পার্টনারের মধ্যে একজন অন্যজনের তাস নিয়ে খেলতে পারে। অন্যজন হল ডামি। সে ইচ্ছেমত ঘোরাফেরা করতে পারে।
আপনার মনে আছে মামলাটার অপরাধীদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটায় আমি বেশি জোর দিয়েছিলাম। সন্দেহভাজনদের মানসিক গঠন বিচার করে আমার ধারণা হয়েছিল যে একমাত্র মিসেস লরিমারই পারেন কোন প্ল্যানকে সার্থক রূপ দিতে। কিন্তু মুহূর্তের উত্তেজনায় খুন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব। তার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল হয় তিনি শেটানকে খুন করেছেন নয়ত শেটানের খুনী কে তা জানেন। আর বাকি তিনজনের যে কেউই খুন করতে পারেন কিন্তু খুন করতে গেলে এদের প্রত্যেক-এর মনে ভিন্ন মনোভাব কাজ করবে।
এরপর আমি সকলকেই একটাই প্রশ্ন করলাম যে সেদিন ঘরের মধ্যে কি কি জিনিস তাদের চোখে পড়েছে। ডাক্তার রবার্টসের ছুরিটা চোখে পড়ার কথা। কেন না তিনি সবকিছু খুঁটিনাটি নজর দিয়ে দেখেন–ডাক্তারদের এই গুণটা সহজাত। কিন্তু সেদিন ব্রীজ খেলার তাসের সম্বন্ধে কোন কথাই তিনি বলতে পারলেন না। আমি অবশ্য আশাও করিনি, কিন্তু এতটা ভুলে যাবার কি কারণ হতে পারে? তবে কি তিনি তখন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন? এদিক থেকেও সন্দেহটা ডাক্তার রবার্টসের ওপরেই পড়েছে।
মিসেস লরিমারের কাছ থেকে একটা মূল্যবান তথ্য পেলাম। ডাক্তার রবার্টস গ্র্যাণ্ডস্ল্যামের ডাক দিয়েছিলেন, খুবই অযৌক্তিকভাবে। এবং তিনি তার পার্টনার মিসেস লরিমারের রঙেই ডাক দেন। ফলে ভদ্রমহিলাকে তাসটা খেলতে হয়। এও একটা পয়েন্ট।
এরপর সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল আর মিসেস অলিভারের চেষ্টায়, সন্দেহভাজন চারজনেরই অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর চালান হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, অতীতে কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে তারা খুন করেছেন অথবা আদৌ খুন করেননি। বর্তমান ক্ষেত্রেও তারা পুরোনো পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন কি না। কিন্তু সব খোঁজ খবর করেও সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল হতাশ হলেন। কেন না তার ধারণা আগের খুনগুলোর সঙ্গে, অর্থাৎ অতীতে এদের চারজন যেভাবে খুনগুলো করেছে, তার সঙ্গে বর্তমান খুনের কোন মিল নেই। কিন্তু তা নয়। ডাক্তার রবার্টস আগে যে দুটো খুন করেছেন, তার সঙ্গে বর্তমান খুনের কোন মিল হয়ত নেই। কিন্তু এদের চারিত্রিক মিল নিশ্চয়ই আছে। ক্র্যাডকদের খুন করাটার কথা ভেবে দেখা যাক। যেন সকলের সামনে হাসতে হাসতে বুক ফুলিয়ে খুনটা হয়ে গেল। রোগীকে পরীক্ষা করার পর বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ডাক্তারদের রীতি, সেই সুযোগে বাথরুমে একজনের শেভিংব্রাসে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু মাখিয়ে রেখে আসা, কত সহজ ব্যাপার। মিসেস ক্র্যাডককে খুন করা হল টাইফয়েডের প্রতিষেধক ইনজেকসন দেবার সুযোগে। কোন লুকোচুরি নেই, সকলের সামনে দিয়ে হাসতে হাসতে খুনটা হয়ে গেল।
এবার মিঃ শেটানের কথাটা চিন্তা করুন। ডাঃ রবার্টস হঠাৎ বুঝতে পারলেন যে খুব তাড়াতাড়ি শেটানের মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করতে না পারলে, তার সমস্ত কুকীর্তির কথা জানাজানি হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি নিলেন। আমরা ব্রীজ টেবিলের ডাঃ রবার্টসকে জানি তিনি ঝুঁকি নিয়েও দক্ষভাবে খেলেন। এক্ষেত্রেও তিনি সম্পূর্ণ কাজটা হাসিল করলেন।
আমি মনে মনে প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছি ডাঃ রবার্টসই খুনি, ঠিক তখনই মিসেস লরিমার আমাকে জানালেন খুনটা তিনিই করেছেন। প্রথমে আমি প্রায় তার কথা বিশ্বাসই করে বসেছিলাম, কিন্তু একটু পরেই আমার মনে হল–না, তিনি এ-কাজ কিছুতেই করতে পারেন না।
কিন্তু ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায় যখন মিসেস লরিমার বললেন, যে অ্যানা মেরিডিথকে তিনি এই খুনটা করতে দেখেছেন। পরের দিন মিসেস লরিমারের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, তিনি যা বলেছেন তাও সত্যি, আবার আমার ধারণাও সত্যি।
আসলে ব্যাপারটা ছিল এই–অ্যানা মেরিডিথ জমি থাকাকালীন ঘুরতে ঘুরতে শেটানের কাছে চলে যায়। শেটান যে মারা গেছেন এটা সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। কিন্তু মেরিডিথের নজরে পড়ে শেটানের বুক পকেটের দিকে, কিছু একটা চকচক করতে দেখে সে হাত বাড়ায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চকচকে জিনিসটা কি সে বুঝে যায়।
ঘাবড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। ডিনার টেবিলে শেটানের মন্তব্য মনে ছিল তার। হয়ত শেটান কোন কাগজপত্রে এই ঘটনা সম্বন্ধে লিখে রেখে যেতে পারেন। তাতে, প্রমাণ হবে সেই শেটানকে খুন করেছে এবং সকলেই ভাববে এতে মেরিডিথের কোন উদ্দেশ্য ছিল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ব্রীজ টেবিলে ফিরে এল সে।
তাহলে মিসেস লরিমার যা দেখেছেন তাও ঠিক। আবার আমার ধারণাও ঠিক তিনি খুনীকে দেখেননি।
ডাক্তার রবার্টস যদি এই খুনের পর চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন তবে হয়ত তাকে কোনভাবেই ধরা যেত না। অবশ্য এতো সহজে হাল ছাড়তাম না আমি।
যাই হোক শেটানকে খুন করে বেশ অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন রবার্টস। তিনি জানতেন যে ব্যাটেল যত দিন না এই খুনের কিনারা হয় ততদিন তার পেছনে লেগে থাকবেন। আর এইভাবে পুলিশের খোঁজখবর করার ফলে তার আগেকার অপরাধের কথা হয়ত প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। এর থেকে বাঁচতে তিনি একটা চমৎকার উপায় বের করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মিসেস লরিমার আর বেশিদিন বাঁচবেন না। রোগের জ্বালাযন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতে তাঁর পক্ষে আত্মহত্যা করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর আত্মহত্যার আগে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
সেই কারণেই ডাক্তার রবার্টস কোনভাবে মিসেস লরিমারের হাতের লেখা যোগাড় করে সেই লেখার নকলে তিনটে চিঠি লিখলেন, তারপর কাক পক্ষী জাগার আগে সেই চিঠির ছুতো করে ছুটলেন মিসেস লরিমারের বাড়িতে। তার আগে নিজের বাড়ির পরিচারিকাকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে যান। পুলিশের সার্জন এসে পৌঁছনোর আগে নিজের কাজ হাসিল করবার সময় তিনি পেয়েছিলেন এবং সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। ছককাটা প্ল্যান। একেবারে নিখুঁত।
রবার্টসের তখন একমাত্র লক্ষ্য নিজের নিরাপত্তা আর মিসেস লরিমারের মৃত্যু। তাই আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে মিসেস লরিমারের হাতের লেখা তার পরিচিত কিনা–তখন তিনি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, সত্যিই যদি কোন সময় এই নকলের ব্যাপারটা ধরা পড়ে। তিনি মিসেস লরিমারের হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন এই অজুহাতই তাকে রক্ষা করল। সেইজন্য আমার প্রশ্নের জবাব তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দিলেও খুব একটা তৎপরতার সঙ্গে দিতে পারেন নি।
উইলিংফোর্ড থেকে আমার ফোন পেয়ে মিসেস অলিভার আমার বাড়িতে রবার্টসকে নিয়ে এলেন। ডাক্তার রবার্টস সব ঝামেলা মিটে গেছে ভেবে যখন মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাত। এরকুল পোয়ারো বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শিকারের ওপর। ডাক্তার রবার্টসও আর কোন নতুন খেলা দেখানোর আগেই অসহায়ভাবে ধরা দিলেন।
কিছুক্ষণ কারোর মুখে কোন কথা নেই। সকলেই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। একসময় রোডার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ভাগ্যিস জানালা দিয়ে ঐ উইণ্ডোক্লীনার্স লোকটা ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছিল। তা না হলে ডাক্তার রবার্টসের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই খাড়া করা যেত না।
না, না ম্যাডাম। এতে ভাগ্যের কোন হাত নেই। পোয়ারো হেসে উঠলেন, লোকটা আদৌ কোন উইণ্ডো-ক্লীনার্স নয়। এখানে উদীয়মান অভিনেতা মিঃ জেরাল্ড হেমিংওয়ে। এসো এসো এদিকে চলে এসো বন্ধু। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে উইণ্ডো ক্লীনার্সকে নিয়ে এলেন। তখন সেই ভদ্রলোককে এখানে অন্যরকম মনে হচ্ছে।
বন্ধু তুমি তোমার ভূমিকা চমৎকার অভিনয় করেছ, সত্যিই চমৎকার। তারিফ করলেন পোয়ারো।
তাহলে! রোডা চেঁচিয়ে উঠল, রবাটর্সকে কেউই দেখেনি, গোটা ব্যাপারটা দারুণ ভাঁওতা।
আমি দেখেছিলাম ম্যাডাম। পোয়ারোর রহস্যময় গম্ভীর কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে বেড়ালো, আমি দেখেছিলাম। কিভাবে জানেন? মৃদু হাসলেন পোয়ারো মনের চোখ দিয়ে।