তাদের থেকে শ-দুয়েক গজ দূরে মেজর ডেসপার্ড নদীর দিকে এগোচ্ছেন।
এখান থেকে নদীটা দেখা যাচ্ছে। নদীর মাঝ-বরাবর একটা ডিঙিতে বসে আছে। অ্যানা আর রোডা। দাঁড় টানছে রোডা, তার সামনে বসে গল্প করছে অ্যানা। দুজনেই কেউই তীরের এই লোকগুলোকে লক্ষ্য করেনি।
ঠিক সেই সময় অ্যানা দু হাত বাড়িয়ে ধাক্কা মারল রোডাকে। পড়ে যেতে যেতে অ্যানার জামা ধরে টাল সালাবার চেষ্টা করল রোডা। কঁকানিতে উল্টে গেল ডিঙিটা, দুজনে জড়াজড়ি করে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
ব্যাটেল ও পোয়ারো দুজনেই দৌড়তে শুরু করলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল দেখুন দেখুন, অ্যানা মেরিডিথ ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে তার বন্ধুকে জলে ফেলে দিল।
কিন্তু তাদের অনেক আগেই ছিলেন মেজর ডেসপার্ড। মেয়ে দুজনের কেউই যে সাঁতার জানে না তাদের হাবেভাবেই বোঝা যাছিল। ইতিমধ্যে ডেসপার্ড নদীর তীরে পৌঁছে গেছেন। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। সাঁতার কেটে তাদের দিকে এগোলেন ডেসপার্ড।
ব্যাটেলও জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ততক্ষণে রোডাকে জল থেকে তুলে নদীর তীরে একটা পরিষ্কার জায়গায় শুইয়ে দিলেন ডেসপার্ড। আবার ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়লেন তিনি। এবার তিনি এগিয়ে চললেন সেই দিকে, যেখানে অল্প আগেও অ্যানাকে হাঁকডাক করতে দেখা গেছে।
সাবধান! চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল। এখানে অনেক বুনো আগাছা আছে। পায়ে জড়িয়ে বিপদ হতে পারে।
তারা দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে সেই জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছলেন, কিন্তু ততক্ষণে অ্যানা জলের তলায় তলিয়ে গেছে।
শেষ অবধি অনেক চেষ্টা করে অ্যানাকে খুঁজে পাওয়া গেল। ব্যাটেল আর ডেসপার্ড তুলে আনলেন অ্যানাকে। রোডার থেকে হাত তিনেক দূরে শোয়ানো হল তাকে।
পোয়ারোর সেবা শুশ্রূষায় ইতিমধ্যে রোডার জ্ঞান ফিরে এসেছে। শ্বাস প্রশ্বাসও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনা ছাড়া উপায় নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ব্যাটেল। তবে মনে হয় না কোন কাজ দেবে। সম্ভবতঃ অ্যানা মেরিডিথ মারা গেছে।
ব্যাটেল তৎক্ষণাৎ শ্বাস প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লেগে গেলেন, তাঁকে সাহায্য করার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন পোয়ারো।
আপনি কি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো– নোডার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–অ্যানা আমাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল? আমারও অবশ্য সেইরকমই মনে হল, কেননা ও তো জানত আমি সাঁতার জানি না। কিন্তু ও কি এটা ইচ্ছাকৃত করল?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করা– পোয়ারো গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন। গাড়ি তখন ছুটে চলেছে লণ্ডনের সীমান্ত দিয়ে।
কিন্তু কেন?
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল ফিরে তাকালেন রোডার দিকে। কেন জানতে হলে আপনার মনকে প্রস্তুত করুন মিস দোবাস। আমি এবার যা বলব তাতে আপনি প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। আপনার বন্ধু যে মিসেস বেনসনের বাড়িতে কাজ করতেন তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে খুন করে আনা মেরিডিথ।
এসব কি বলছেন আপনি?
আমাদের বিশ্বাস, পোয়ারোর জবাব ভেসে এল। অ্যানাই বোতল দুটো বদলে রেখেছিল।
না-না–এ হতে পারে না। এমন সাংঘাতিক কাজ অ্যানা করতেই পারে না। কেনই বা সে খুন করবে?
তার পেছনেও কারণ আছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল বললেন। সে যাই হোক, অ্যানার ধারণা ছিল একমাত্র আপনিই আমাদের কাছে এ ঘটনার হদিশ দিতে পারেন। আচ্ছা, মিস দোবাস, আপনি কি মিসেস অলিভারের কাছে এই ঘটনাটা নিয়ে গল্প করেছেন এ-কথা নিশ্চয়ই আপনার বন্ধুকে জানাননি?
না। মৃদু জবাব দেয় রোড, ভেবেছিলাম ও তাতে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে।
তা হতো, খুবই বিরক্ত হত। ব্যাটেল মন্তব্য করলেন, তবে মিস মেরিডিথ জানত ঘটনাটা একমাত্র আপনিই জানেন। তাই আপনার দিক থেকেই বিপদ আসবার সম্ভাবনা সেইজন্য পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল আপনাকে।
আমাকে সরিয়ে দিতে? কি সাংঘাতিক কাণ্ড। আমার কিন্তু এখনও ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
যাক, যখন সে মারাই গেছে, তখন আর এ নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। তবে বন্ধু হিসাবে মিস মেরিডিথ যে মোটেই ভাল ছিল না, এতে কোন সন্দেহ নেই।
গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল।
এটা হচ্ছে মঁসিয়ে পোয়ারোর বাড়ি। চলুন, আমরা সকলে এখানে বসেই সমস্ত বিষয়টা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করবো।
পোয়ারোর ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিলেন মিসেস অলিভার আর ডাক্তার রবার্টস।
আসুন আসুন। মিসেস অলিভার সকলকে স্বাগত জানালেন, আপনার টেলিফোন পাওয়া মাত্রই আমি ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করে, দুজনে এখানে এসে হাজির হয়েছি। রবার্টসের পেশেন্টরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সে যাই হোক, আমরা কিন্তু এই ঘটনার আগা-গোড়া সমস্তটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছি।
হ্যাঁ। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল–শেষ পর্যন্ত আমরা মিঃ শেটানের খুনীকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।
আমার কাছে কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই অস্পষ্ট ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরী মেরিডিথই যে খুনী, এ তো কোনদিন ভাবতেই পারিনি। রবার্টস বললেন।
সে যে একজন খুনী, কোন সন্দেহ নেই। ব্যাটেলের মন্তব্য শোনা গেল, এর আগেও তিন-তিনটে খুন করে শেষবারে অর্থাৎ চার নম্বর খুনটাতে সফল হতে পারেনি।