মিসেস লরিমার মিনিট কয়েক চুপ করে রইলেন। তার মুখে চোখে এক অদ্ভুত হাসি খেলা করছে।
তাহলে আপনার ধারণা অনুযায়ী আমিই হলাম সেই মহিলা যে কি না নিখুঁত প্ল্যান করে ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করতে পারে
অন্তত এই প্ল্যানকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন আপনি। সেই ক্ষমতা আপনার আছে।
বেশ মজার ব্যাপার। তাহলে, ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে একমাত্র আমিই শেটানকে খুন করতে পারি? পোয়ারোর শান্ত স্বর ভেসে আসে, এখানেই একটা অসুবিধা আছে, ম্যাডাম।
কি অসুবিধা মঁসিয়ে পোয়ারো?
একটু আগে আমি যে কথাটা বললাম নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। কোন অপরাধ সফল করতে হলে সচরাচর সমস্ত খুঁটিনাটি পরিকল্পনা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হয়। সচরাচর কথাটা মনে রাখবেন। কারণ আর এক ধরণের সফল অপরাধ করা সম্ভব। ধরুন, আপনি আচমকা কাউকে ঢিল ছুঁড়ে দূরের একটা গাছের গুঁড়িতে লাগাতে বললেন। যাকে বললেন সে হয়ত না ভেবেচিন্তেই ঢিলটা ছুঁড়ে বসল এবং সত্যি সত্যি লক্ষ্যভেদ করতে পারল। একবার সফল হয়েই সে যদি ঐ ঢিল ছুঁড়তে যায় দেখা যাবে ব্যাপারটা আর ততখানি সহজ হবে না। কারণ তখন সে চিন্তা করতে শুরু করেছে। ঢিলটা ছোঁড়ার আগে মনে হচ্ছে একটু ডানদিকে আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না না, একটু বাঁদিক ঘেঁষেই ছোঁড়া উচিত। প্রথমটা ছিল অবচেতন প্রক্রিয়া, যেখানে শারীর মনের হুকুম তামিল করেছিল। এই হল এক ধররের ক্রাইম–থেমে, ভেবে দেখবার কোন সময় নেই–এক মুহূর্তেই ঘটে যায়। বলতে বাধা নেই মিঃ শেটানের খুনের পিছনেও এ ধরনেরই একটা মনোভাব কাজ করেছিল।
হঠাৎ একটা প্রয়োজনে না ভেবে-চিন্তে, দ্রুত কাজটা ঘটে গেল। আপনার স্বভাবের সঙ্গে ঠিক এ ধরনের ক্রাইম খাপ খায় না। আপনি শেটানকে খুন করতে চাইলে, খুব ভাল ভাবে পরিকল্পনা নিয়ে খুনটা করবেন।
তাই বুঝি! মিসেস লরিমারের মুখে সেই অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো। আপনি বলতে চাইছেন যেহেতু এটা আগে থেকে পরিকল্পনা করা কোন খুন নয়–অতএব আমি শোনকে খুন করিনি।
ঠিক তাই, ম্যাডাম। পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।
কিন্তু তবুও– মিসেস লরিমার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে ওঠেন, সিয়ে পোয়ারো, আমিই শেটানকে খুন করেছি।
অনেকক্ষণ দু-জনেই চুপচাপ। একটা অস্বস্তিকর চাপা নীরবতা ঘরের বাতাস ভারী করে তুলেছে, বাইরের অন্ধকার আরো ঘনিয়ে এসেছে। পোয়ারো এবং মিসেস লরিমার দুজনেই ফায়ার প্লেসের দিকে তাকিয়ে আছেন, সময়ও যেন থমকে রয়েছে সেখানেই।
নীরবতা ভাঙলেন পোয়ারো। তাহলে এই হল আসল ঘটনা। কিন্তু ম্যাডাম, কেন আপনি শেটানকে খুন করলেন?
কারণটা আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো
শোন তাহলে আপনার অতীত জীবনের কোন গোপন ঘটনা জানতেন এবং সে ঘটনা সম্ভবত কোন মৃত্যু তাই না মিসেস লরিমার?
মিসেস লরিমার চুপ করে রইলেন। বোঝা গেল মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।
আজ কেন এ কথা বললেন আমাকে? ডেকেই বা পাঠালেন কেন?
একদিন আপনিই বলেছিলেন, কোন সময়ে হয়ত আমি আপনাকে ডেকে পাঠাতে পারি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক। আমি জানতাম আপনি যদি নিজে থেকে কোন কথা না বলেন তবে কোনদিনই আপনার মুখে থেকে কেউই কিছু আদায় করতে পারবে না। আমার মনে হয়েছিল, অথবা বলতে পারেন একটা সম্ভাবনা ছিল হয়ত কোনদিন নিজের সম্বন্ধে কথা বলবার ইচ্ছে আপনার মধ্যে জেগে উঠতে পারে।
বিমর্ষভাবে মাথা নাড়লেন মিসেস লরিমার। আপনি দূরদর্শী, তাই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন।
সেদিন ডিনার টেবিলে মিঃ শেটান যে কথা বলেছিলেন, সেটা কি আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল বলে আপনার ধারণা? শান্ত গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন পোয়ারো।
হ্যাঁ, মিঃ শোন বলেছিলেন বিষই হল মেয়েদের প্রধান অস্ত্র। কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। এর আগেও একদিন অনেকের সামনে এই ধরনের একটা মামলার কথা বলবার সময় তিনি আমাকে লক্ষ্য করেছিলেন। আমার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল মিঃ শেটান আমার গোপন ব্যাপারটা জানেন, সেদিনই সন্দেহটা দৃঢ় হল। নিশ্চিত হলাম যে, ব্যাপারটা আর অজানা নেই।
ভদ্রলোকের ভবিষ্যৎ ইচ্ছাটাও কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন?
সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল আর আপনার উপস্থিতি যে দৈবাৎ হয়েছে এমন কথা বিশ্বাস করা শক্ত। আমি তা বুঝে নিলাম, এরপর মিঃ শোন বাহাদুরী দেখিয়ে বলবেন, যা কেউ কোনদিন পারেননি আজ তিনি তাই পরিষ্কার করতে পেরেছেন।
মিঃ শেটানকে খুন করবেন,কখন ঠিক করলেন?
অল্প ইতস্তত করেন মিসেস লরিমার, কখন যে ঠিক করলাম বলা শক্ত। তবে ডিনারে যাবার আগেই ছোরাটা আমার নজরে পড়েছিল। ডিনার শেষ করে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসার সময় সকলের চোখ এড়িয়ে ছোরাটা তুলে আমার আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিলাম কেউই দেখতে পায়নি ব্যাপারটা।
এ যে একেবারে নিপুণ শিল্পীর মত হাত সাফাই। মন্তব্য করলেন পোয়ারো।
তখনই আমি মনস্থির করে ফেললাম। কাজটা নিঃসন্দেহে খুব ঝুঁকির। কিন্তু আমার তো আর কোন উপায় ছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিসেস লরিমার পুরোনো কথার খেই ধরে বলতে লাগলেন-ব্রীজের আসর বসল। খেলা এগিয়ে চলেছে। একসময় সুযোগ এসে গেল। আমি তখন ডামি। পায়চারি করার ভান করে ফায়ার-প্লেসের কাছে হাজির হলাম। চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন মিঃ শেটান, অন্য তিনজনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রত্যেকেই তাসে মগ্ন। ব্যাস! সুযোগ হাতছাড়া করলাম না-ঝুঁকে পড়ে হৃৎপিণ্ড তাক করে ছুরি চালালাম-