ব্যাটেল ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন। ট্রেন তখন লণ্ডনের দিকে ছুটে চলেছে।
ম্যাডাম আমি আপনার স্মৃতিশক্তির সাহায্য চাই পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
স্মৃতিশক্তি। বেশ অবাক হয় অ্যানা। একটু আগেই রোডার সাথে এরকুল পোয়ারোর বাড়িতে এসেছে সে।
হ্যাঁ। এর আগেই আমি ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেসপার্ড আর মিসেস লরিমারকে একই প্রহ্ন করছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে সঠিক উত্তর, মানে আমি যে উত্তরটা চাইছি, তা দিতে পারেন নি।
অ্যানা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
আপনি সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের ড্রয়িং রুমটা মনে করার চেষ্টা করুন। আমি জানি ঘটনাটা খুবই বীভৎস, মনে করতে কষ্ট হয়–বোধ হয় আপনি আগে কোনদিন এরকম ভয়ংকর খুনের মুখোমুখি হন নি, তাই না?
হঠাৎ রোডার চেয়ার একটু নড়েচড়ে উঠল।
অ্যানা বলল, ঠিক আছে। কি জানতে চান বলুন?
আপনি মিঃ শেটানের ড্রয়িংরুমের জিনিপত্রগুলোর একটা বর্ণনা দিন। যেমন ধরুন–চেয়ার, টেবিল, আগেকার দিনের অলংকার, দামী দামী পর্দা–এসবগুলোর একটা বর্ণনা চাইছি আমি।
ওঃ এই ব্যাপার। অ্যানা কুঁচকে চিন্তা করল। কিন্তু এতদিন পরে তো সবটা ঠিক মনে করতে পারব না। এমনকি দেয়ালগুলো কি রঙের ছিল তা ভুলে যাচ্ছি–যতদূর মনে পড়ছে দেওয়ালের মাঝে মাঝে কাজ করা ছিল। কতগুলো দামী কম্বল পাতা ছিল মেঝের ওপর। আর মস্তবড় পিয়ানো ছিল একটা। নাঃ, আর কিছু তো মনে পড়ছে না–
ম্যাডাম, একটু ভালো করে চেষ্টা করুন। কিছু কিছু জিনিসের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে কোন পুরানো যুগের অলংকার, কোন আসবাবপত্র, আকর্ষণীয় কিছু।
হ্যাঁ এখন মনে পড়ছে। অ্যানা আস্তে আস্তে বলে–জানালার পাশে একটা মিশরের গয়নার বাক্স ছিল।
হ্যাঁ, হা, ঘরের শেষ দিকে একটা জানালার ধারে তার উল্টোদিকের টেবিলেই ছুরিটা পড়ে ছিল।
কোন টেবিলে ছুরিটা ছিল–আমি তা জানি না। অ্যানা শান্তভাবে বলে।
তাই নাকি? মনে মনে বললেন পোয়ারো। তাহলে আর আমার নাম এরকুল পোয়ারোই নয়। কারো চরিত্র সম্পর্কে খুঁটিনাটি না জেনে আমি ফাঁদ পাতি না।
হ্যাঁ, নীল আর লাল রং দিয়ে তৈরি। কয়েকটি হীরের আংটি, কয়েকটা কঙ্কনও ছিল–তবে বিশেষ ভাল না। তাছাড়া ঘরটা তো জিনিসপত্রে বোঝাই
এমন কোন কিছু কথা মনে পড়ছে না, যা আপনার নজরে পড়েছিল।
একটা ফুলদানীতে কতগুলো গোলাপ ছিল মনে পড়ছে। বলতে বলতে অ্যানা মৃদু হাসল। তাতে জল পাল্টানো হয়নি।
পোয়ারো চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।
অ্যানা বলল, হয়ত আপনার পছন্দমত, সঠিক জিনিসটার ওপর নজর দিয়ে দেখিনি।
তাতে কিছু যায় আসে না। মৃদু হাসলেন পোয়ারো।
ভাল কথা, মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে খুব শিগগির কি আপনার দেখা সাক্ষাত হয়েছে?
ভদ্রলোক বলেছিলেন আমাদের সঙ্গে একদিন দেখা করতে যাবেন। অ্যানা বলে ওঠে।
হঠাৎ রোডা বলে ফেলে, আমরা কিন্তু নিশ্চিত, এ কাজ মেজর ডেসপার্ড করেন নি।
পোয়ারো মনে মনে হেসে ফেলে।
ম্যাডাম। অ্যানাকে লক্ষ্য করে পোয়ারো বললেন, আপনি যদি আমার একটা উপকার করেন-ব্যাপারটা অবশ্য সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত।
অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল অ্যানা।
ব্যাপারটা কিছুই নয়। বড়দিন উপলক্ষে আমি আমার নাতনীদের একটা করে উপহার দিতে চাই। কিন্তু আমার পক্ষে আজকালকার মেয়েদের পছন্দ কি, বোঝা মুশকিল।
আচ্ছা, সিল্কের মোজা উপহার দেওয়া চলে কি?
হ্যা, অ্যানা জবাব দেয়, আজকাল সিল্কের মোজা খুবই চলে।
চলে! যাক নিশ্চিন্ত হলাম। পাশের ঘরে টেবিলের ওপর পনের কি ষোল জোড়া মোজা আছে–বিভিন্ন রঙের। যদি আপনি একটু দেখেশুনে ছজোড়া আলাদা করে বেছে দেন।
ঠিক আছে, আমি বেছে দিচ্ছি। উঠে দাঁড়ায় অ্যানা।
পোয়ারো তাকে সঙ্গে নিয়ে পাশের ঘরের টেবিলের সামনে নিয়ে এলেন। টেবিলের ওপর মোজার বান্ডিল, কিছু খালি চকোলেটের বাক্স, গোটা চারেক পশমের দস্তানা ছড়িয়ে আছে।
এই হল মোজার বাণ্ডিল। এর থেকে ছটা বেছে দিন।
তাদের পেছন পেছন রোডাও সেখানে হাজির হয়েছে। পোয়ারো তার দিকে ফিরে তাকালেন। মিস রোডা, এই ফাঁকে আপনাকে আর একটা জিনিস দেখিয়ে আনি, চলুন। সেটা হয়ত আপনার বন্ধুর বিশেষ পছন্দ হবে না
জিনিসটা কি? রোডা কৌতূহলী হয়। পোয়ারো নীচু গলায় বলে ওঠেন, ছোরা।
যে ছোরা দিয়ে বারো জনকে খুন করা হয়েছিল। এক বিখ্যাত হোটেল মালিক আমাকে ছোরাটা উপহার দেন
বীভৎস! শিউরে ওঠে রোডা। ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।
চলুন তো দেখে আসি। রোডা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পোয়ারো তাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলেন। আলমারি খুলে ছোরাটা রোডাকে দেখাতে দেখাতে মিনিট তিনেক কেটে গেল। রোডাকে নিয়ে পোয়ারো যখন পাশের ঘরে আবার এসে ঢুকলেন তখন অ্যানার মোজা বাছা শেষ।
অ্যানা এগিয়ে এল। এই ছটাই আমার বেশ পছন্দ হল মঁসিয়ে পোয়ারো। গাঢ় রঙের গুলো সান্ধ্য পোশাকে ভালো মানাবে। আর হাল্কা রঙের গুলো গ্রীষ্মকালের জন্য।
ধন্যবাদ ম্যাডাম। অসংখ্য ধন্যবাদ।
অ্যানা আর রোডা শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেয়। দরজা পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিলেন পোয়ারো। তারপর টেবিলের কাছে ফিরে এলেন। ছটা প্যাকেট আলাদা সরিয়ে রেখে বাকিগুলো গুনে দেখলেন তিনি। মোট উনিশটা প্যাকেট ছিল, কিন্তু এখন পড়ে রয়েছে সতেরটা। পোয়ারো হাসতে হাসতে আপনমনে মাথা দোলালেন।