এমনিই, হঠাৎ আমার মনে হল তাই। যাক আপনি যে কথা বলছিলেন বলুন।
বলছিলাম মেরিডিথের কথা। ব্যাটেল আবার শুরু করলেন, মিসেস এন্ডনের বোন আমাকে বলেছিলেন, অ্যানা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডেভনশায়ারে চলে যায়। কোথায় গেছে, কার বাড়িতে, এত খবর দিতে পারেনি। তবে মনে হয় সেখানে বেশিদিন থাকেনি। মেয়েটা এত মিথ্যেবাদী, আমাকে ঠকিয়েছে। আর যদি ডেভনশায়ারের ব্যাপারটা দুর্ঘটনাই হবে তো তার এত ভয় কেন? সে যদি সম্পূর্ণ নির্দোষই হয়?
পোয়ারো আপন মনে বিড় বিড় করলেন, সত্যিই আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে–
পোয়ারো এখন ক্রম্পটন রোড ধরে হেঁটে চলেছেন। একটু আগেই মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেছিলেন পোয়ারো। গেছিলেন অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য জানতে। প্রথমে মিসেস ল্যাক্সমোর কিছুই বলতে রাজি হননি। কিন্তু পোয়ারো তার নিজের কায়দায় সমস্ত কথাই আদায় করে ছেড়েছেন। ঘটনাটা হল এই :
মিসেস ল্যাক্সমোর তার স্বামীর সঙ্গে আমাজন নদীর কাছাকাছি অঞ্চলে এক অভিযানে গেছিলেন। তার স্বামী অধ্যাপক ল্যাক্সমোর ছিলেন বোটানিস্ট। ঐ অঞ্চলের দুষ্প্রাপ্য লতাগুল্মের সন্ধানেই তিনি যান। মেজর ডেসপার্ডও ঐ অভিযানে অংশ নেন–তিনি ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন, এবং অভিযানের বহু প্রয়োজনীয় ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন বলেই তাকে সঙ্গে নেওয়া হয়। এক রাত্রে কোন কারণে মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের ঝগড়া বাধে। অধ্যাপক ডেসপার্ড আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুঁড়েছিলেন যা অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়। সংক্ষেপে এই হল অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যু রহস্য।
পোয়ারো মনে মনে বিড় বিড় করলেন সত্যিই অভূতপূর্ব মহিলা–হতভাগ্য ডেসপার্ড। বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে হঠাই আপনমনে হাসতে শুরু করলেন পোয়ারো।
বাড়ি পৌঁছানোর পর আধঘণ্টা হতে না হতে মেজর ডেসপার্ড পোয়ারোর বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। তার চোখে মুখে রাগের ছাপ। অতিকষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছেন তিনি।
কি জন্যে আপনি মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেছিলেন? পোয়ারো মৃদু হাসলেন আমার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই আপনি এতক্ষণে জেনে গেছেন। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুরহস্যের আসল তথ্যটা খুঁজে বের করাই আমার উদ্দেশ্য।
আসল তথ্য! ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠেন ডেসপার্ড আপনি কি মনে করেন মেয়েদের পক্ষে সমস্ত ঘটনা জানা সম্ভব?
তা অবশ্য ঠিক। সায় দিলেন পোয়ারো।
আপনি জেনেছেন কতগুলো মিথ্যে কথা, বানানো কথা।
না না। পোয়ারো প্রতিবাদ জানালেন, সেরকম কিছু নয়। ভদ্রমহিলা একটু রোমান্টিক ধাঁচের এই যা–
হ্যাঁ, মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে মেনে নেওয়াটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। সবটাই ধাপ্পাবাজী। তার ওপর আবার তিনি ভীতু। উঃ কি অশান্তিতেই যে ওদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম!
হ্যাঁ, আমারও একথাটা সত্যি বলে মনে হয়, পোয়ারো মাথা দোলালেন।
হঠাৎ একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ডেসপার্ড। তাহলে আসল ঘটনাটা আপনাকে খুলেই বলি মঁসিয়ে পোয়ারো। অল্প থেমে বলতে শুরু করলেন ডেসপার্ড, আমি জানি আমি যা-ই বলি তাতে কারোর এক বিন্দু সমবেদনা পাব না। বরঞ্চ সকলের চোখে সন্দেহের ভাগী হব আমি-ই। তবুও আমার কাছে একটাই পথ খোলা আছে–তা হল ঘটনাটা আপনার কাছে খুলে বলা। বিশ্বাস করুন বা না করুন এই হল আসল ঘটনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মেজর ডেসপার্ড বলতে শুরু করলেন, অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের অভিযানের যাবতীয় ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। ল্যাক্সমোর সত্যিই একজন ভদ্রলোক। সবসময় গাছ লতা নিয়ে মেতে থাকতেন। আর মিসেস ল্যাক্সমোরকে তো দেখেই এলেন–অতিরিক্ত ভাবুক। আমি বিশেষ পছন্দ করতাম না তাকে। যাই হোক, ওখানে পৌঁছানোর পর অল্পদিনের মধ্যেই আমরা তিনজনেই জ্বরে পড়লাম। আমি এবং মিসেস ল্যাক্সমোর অল্প ভুগেই সুস্থ হয়ে উঠলাম, কিন্তু অধ্যাপকের জ্বর উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। একদিন আমি তাঁবুর বাইরে সন্ধ্যেবেলা চেয়ারে বসে আছি হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক টলতে টলতে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নদীর দিকে এগোেচ্ছন। তিনি যে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে এরকম কাণ্ড করতে যাচ্ছেন এতে কোন সন্দেহ ছিল না। আর এক মিনিটের মধ্যে ভদ্রলোক নদীতে গিয়ে পড়বেন। একবার পড়লে বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না। আমি যে ছুটে গিয়ে তাকে থামাব সে সময়ও নেই। পাশেই গুলিভরা বন্দুকটা পড়ে ছিল। ভদ্রলোকের পায়ে গুলি মেরে তাকে থামাতে চাইলাম আমি। আমার টিপ অব্যর্থ ছিল। বন্দুকটা তুলে সেদিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে যাই এমন সময় হঠাৎ মিসেস ল্যাক্সমোর কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে বাধা দিলেন। তার ধারণা হয়েছিল যে আমি তার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলছি। ভদ্রমহিলার টানাটানিতে বন্দুকের নলটা ঘুরে গিয়ে গুলিটা সোজা অধ্যাপকের পিঠে গিয়ে বিধল। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন তিনি।
ভদ্রমহিলা এত বোকা, তিনিই যে ঘটনাটার জন্যে দায়ী এ-কথা কিছুতেই মানতে রাজী হলেন না। তার ধারনা আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের ঝগড়া ছিল যার ফলে রাগে আমি তাকে মেরে ফেলেছি। ভদ্রমহিলা যে কি করে বসেছেন তা নিজেই জানেন না। শেষে তিনি বললেন যে বাইরের লোকেদের কাছে জানানো হবে যে অধ্যাপক ল্যাক্সমোর কালাজ্বরে মারা গেছেন। আমিও শেষ পর্যন্ত তার কথাতেই রাজী হলাম কারণ প্রকৃত ঘটনা জানলে শুধু শুধুই লোকের মিথ্যে সন্দেহে জড়িয়ে বদনামের ভাগী হব। পরদিন সকালে কুলিদের জানিয়ে দিলাম অধ্যাপক ল্যাক্সমোর কালাজ্বরে মারা গেছেন। সকলে মিলে তাকে নদীর ধারে কবর দিলাম। কুলিরা যদিও সকলেই আসল ঘটনা জানত, কিন্তু সকলেই খুব বিশ্বাসী, আমাকে শ্রদ্ধাও করত। তারা আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করল বাইরে কোনদিন কেউ এই ঘটনা কাউকে জানাবে না। তারপর আমরা লন্ডনে ফিরে আসি।