তবে কি মিসেস লরিমার?
আরে না না। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে আমি বলছি না, শেটানের চরিত্র কেমন ছিল–এটাই আমার বক্তব্য। আর মিসেস লরিমারকে ভয় দেখানো অত সোজা নয়।
মেয়েদের মনের কথা, বিশেষ করে গোপন কথা বের করতে মিঃ শেটান খুবই পটু ছিলেন, এটা ঠিকই। পোয়ারো শান্তভাবে বললেন।
লোকটা তো একেবারে নির্বোধ ছিল–সেরকম বিপজ্জনকও নয়–অথচ মেয়েরা কেন যে ভয় পেতকথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন মেজর ডেসপার্ড। আরে, কথা বলতে বলতে আমার স্টপেজ ছাড়িয়ে চলে এসেছি। আচ্ছা, মঁসিয়ে পোয়ারো, কবে আবার দেখা হবে। জানালা দিয়ে একটু লক্ষ্য করুন, আমার অনুসরণকারীকেও দেখতে পাবেন, আমার সাথে সাথে বাস থেকে নামবে নিশ্চয়ই।
লম্বা পায়ে চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লেন মেজর ডেসপার্ড। পোয়ারো অবশ্য তার অনুসরণকারীকে খোঁজার কোন চেষ্টা করলেন না। কেউ হবে হয়ত। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা, বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়– বিড় বিড় করে বললেন পোয়ারো, সত্যি ভারী আশ্চর্য্যের তো!
মিসেস লরিমার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সিঁড়ির মাথায়। তার মুখে বিভিন্ন অভিব্যক্তির ছাপ একের পর এক খেলে চলেছে–কখনো দ্বিধা, কক্ষনো সংশয়, বিস্ময়, নিশ্চিন্ত। তার দীর্ঘ জ্বজোড়া কুঁচকে উঠল, কি যেন চিন্তা করছেন তারপর নিচে নেমে এলেন ধীরে ধীরে। তখনি রাস্তায় তার চোখ পড়ল অ্যানা মেরিডিথের দিকে, একটা আকাশ ছোঁয়া বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানা। মিসেস লরিমার একটু ইতস্তত করে রাস্তা পেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলেন।
কেমন আছেন মিস মেরিডিথ?
চমকে ফিরে তাকাল অ্যানা, ওঃ আপনি? অনেকদিন বাদে আবার দেখা হল।
লন্ডনেই আছেন এখনো?
না না, একটা বিশেষ কাজে লন্ডনে এলাম আজ। অ্যানা ঘন ঘন ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে।
ওদিকে অত তাকাচ্ছেন কেন মিস মেরিডিথ? কোন দরকার আছে?
কই না কিছুই নয়।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কোন ব্যাপার আছে। মৃদু হাসলেন মিসেস লরিমার।
হ্যাঁ–মানে ইয়ে, অ্যানা আমতা আমতা করে, আসলে আমার এক বন্ধুকে যেন বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখলাম। সত্যি সত্যি রোডাই তো? এই বাড়িতে মিসেস অলিভার থাকেন। আমাদের ওখানে বেড়াতে গিয়ে এ বাড়িটারই ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি।
আপনি কি দেখা করবেন মিসেস অলিভারের সঙ্গে?
না, আজ আর যাব না।
তবে চলুন, এক কাপ চা খাওয়া যাক। মিসেস লরিমার একটা নিরিবিলি রেস্তোরাঁতে অ্যানাকে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অ্যানাই প্রথম মুখ খুললেন, মিসেস অলিভার আপনার কাছে যাননি?
মঁসিয়ে পোয়ারো ছাড়া আর কেউই আমার কাছে যায়নি।
আমি ঠিক তা জিজ্ঞসা করিনি।
করেননি? কিন্তু আমার যেন মনে হলো আপনি এটাই জিজ্ঞাসা করছেন। অবাক হলেন মিসেস লরিমার।
অ্যানার চোখে ভয়ের ছায়া দেখা দিল। কিন্তু মিসেস লরিমার আগের মতই নির্বিকার। অ্যানা চট করে সামলে নিল নিজেকে।
মঁসিয়ে পোয়ারো আমার কাছে যাননি। আচ্ছা সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। মিসেস লরিমারের জবাব।
অ্যানা একটু ইতস্তত করে বলে, কি প্রশ্ন করলেন?
যেমন নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে যাকে সে রকমই। তবে ব্যাটেলের ব্যবহার খুব ভাল।
ভদ্রলোক মনে হয় সকলের সঙ্গেই দেখা করেছেন।
মিসেস লরিমার, আপনার কি মনে হয়, অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবে পুলিশ?
মিসেস লরিমারের চোখে অদ্ভুত একটা ছায়া খেলে গেল, আপনার বয়স কত মিস মেরিডিথ?
আমার বয়স? আমার অ্যানা তোতলাতে লাগল, পঁচিশ।
আমার তেষট্টি, মিসেস লরিমারের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আপনার সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে–
কেন? আমি তো আজই অ্যাক্সিডেন্টে মারাও যেতে পারি? অ্যানা ভয় পাওয়া গলায় বলে ওঠে।
হতে পারে। আবার হয়ত সারা জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না।
মিসেস লরিমারের কথায় অদ্ভুত ভঙ্গীমায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অ্যানা।
জীবন কত জটিল, আপনমনে বলতে থাকেন মিসেস লরিমার, বেঁচে থাকতে গেলে চাই প্রচণ্ড সাহস আর সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা। অথচ জীবনের শেষ সময় দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যিই কি এর কোন দরকার ছিল?
ওভাবে বলবেন না, অ্যানা ভয় পাওয়া গলায় বলে। মিসেস লরিমার মৃদু হাসেন, জীবন নিয়ে কথাবার্তা হয়ত খুব সস্তা দরের নাটকীয়তা হয়ে যাচ্ছে। বড্ড সস্তা। বেয়ারার বিল মিটিয়ে রাস্তায় চলে এলেন দুজনে। একটা ট্যাক্সি পেয়ে অ্যানাকে লিফট দিতে চাইলেন মিসেস লরিমার। অ্যানা ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিল, কেননা একটু দূরেই রোডাকে দেখতে পেয়েছে সে। রোডার কাছাকাছি হতেই অ্যানা তীক্ষ্ম গলায় প্রশ্ন করে, রোডা, তুই মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি?
হ্যাঁ, কেন তাতে কি হয়েছে?
তা হলে ঠিকই ধরেছি।
এতে আবার ধরাধরির কি আছে। আমি কি চুরির দায়ে ধরা পড়েছি না কি? তুইও তো এতক্ষণ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলি।
হঠাৎ মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি কেন?
বাঃ! তিনি তো আমাদের যেতে বলেছিলেন।
সে তো কথার কথা। সকলেই ওরকম বলে। আমি তো তাই নিয়েছি।
না রে তুই ভুল বুঝছিস। ভদ্রমহিলার মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। এই যুগের ব্যবহার, দেখ না আমাকে নিজে থেকেই একটা বই উপহার দিলেন।
অ্যানা তবুও নিঃসন্দেহ হতে পারে না। কি ব্যাপারে কথা হল? আমার ব্যাপারে নিশ্চয়ই নয়?