বারবারা, থামবি! ক্যারোলিন কৃত্রিম ধমক দিলেন। তারপর মুচকি হেসে লুসিয়াকে ইশারায় দেখিয়ে বলল–বেচারি, ওর জন্য আমার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, কেমন আছে ও, জানার জন্য মনটা আনচান করছিল, তাই তো আবার ছুটে আসতে হল। আর এসে অব্দি তুই আমার সঙ্গে মজা করে চলেছিস। এমন করে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলিস না, ভাল হবে না বলে রাখছি।
সত্যিই তো, লুসিয়ার কান্না ভেজা গলা। শেষ পর্যন্ত চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। দুই মহিলাকে লক্ষ্য করে বলল ধরা গলায় এ বাড়ির প্রত্যেকে আমার সঙ্গে কত সুন্দর ব্যবহার করে। ভাগ্যিস রিচার্ডের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, তোমার কাছে আশ্রয় পেলাম, দয়ামায়া কাকে বলে বুঝতে শিখেছি। বলতে দ্বিধা নেই, তোমাদের আশ্রয়ে এসে সামান্য ভালবাসার পরশ পেয়ে আমি কৃতার্থ হয়েছি। আমার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাব কি করে, বুঝতে পারছি না।
-বাছা, কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে আর লাভ নেই, অনেক দেখিয়েছ। নীচু স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে ক্যারোলিন এগিয়ে এলেন লুসিয়ার কাছে। আদরের ছোঁয়া রাখলেন তার মাথায়-গায়ে–জানি, জীবনের প্রথম দিকটা মেয়েদের মা-মাসির স্নেহ ভালবাসায় দিন কাটে, কিন্তু তুমি ওই সময় একাকী বহু দূরে, বিদেশে দিন কাটিয়েছ। ফলে লেখাপড়া দুরে থাক, সহবত শিক্ষা কিছুই হয়নি তোমার, একথাই বলতে চাইছ তো? যাক, ওসব ভেবে চোখের জল ফেলে কাজ নেই।
লুসিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তার দৃষ্টি আটকে আছে পিসিমার দিকে। পিসিমা তার হাত ধরলেন। সযত্নে সোফায় বসালেন। ছড়িয়ে পড়ে থাকা গদিগুলোকে নিজের সুবিধামতো সাজিয়ে আয়েস করে পাশে বসলেন। সোনা, মুখ ভার করে থেকো না। তোমার মনের মধ্যে কি ঝড় চলছে, আমি কি বুঝতে পারছি না? যাক, তোমার ঘাড় থেকে ইটালি নামক ভূতটাকে তাড়াও দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। লক্ষ্মীটি, আর মন খারাপ করে থেকো না।
লুসিয়ার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে তাকাতে বারবারা ফোড়ন কাটল–ওর এখন একটু ড্রিঙ্কস হলে ভাল হয়। যে সে নয়, কড়া। তার কথায় রুক্ষ্মতার প্রকাশ সহানুভূতি দেখানো চুলোয় দিয়ে একাল-সেকাল নিয়ে পড়ল–পিসিমা, আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছ? কি হাল! একালের হয়ে সেকালের পরিবেশের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে ড্রিঙ্কস বলতে তো ওই ডিনারের আগে হুইস্কি, নয়তো পরে ব্রান্ডি। এর বাইরে ককটেল নামে যে একটা পানীয় আছে, এ বাড়ির লোকেরা তো জানে না। আর রিচার্ডকে দেখ, ভাল করে একটা ম্যানহাটান ককটেল তৈরি করতে অক্ষম সে। সে কেবল হুইস্কিই চিনেছে। ডিনারের আগে এডওয়ার্ড রেনরকে হুইস্কি সার্ভ করতে বলবে, আর নিজেও তাই গিলবে। স্যাটনিস হুইস্কার জান? খানিকটা লুসিয়ার পেটে পড়লেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
-স্যাটনিস হুইস্কার? সেটা আবার কি? ক্যারোলিন ভুরু কুঁচকে অবাক মুখে তাকালেন–এমন বিদঘুঁটে নাম, না বাবা, জীবনে শুনিনি।
–এটা ঘরে তৈরি করা একটা পানীয়। বারবারা সবজান্তার মতো হেসে উঠল। ব্র্যান্ডি আর ক্রি ডি মেছে–দুটো সমান পরিমাণে নিয়ে মিশিয়ে দিতে হয়। এর পর দিতে হয় কিছুটা শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। পুরো মিশ্রণটা খুব ভাল করে ঝাঁকালেই তৈরি হবে এক ককটেল, তাকে স্যাটনিস হুইস্কার বলে, বুঝেছ? শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো না দিলে পানীয়ের ঝাঁঝ হবে না। জম্পেশ মাল তৈরি করতে হলে তাই চাই শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। দেখবে কেমন ঝাঁঝ ও ঝাল। সত্যি, দারুণ এক ককটেল!
–থাম দিকি, বারবারা, তোর বকবকানিতে মাথা ধরে গেল। বিরক্তিতে ক্যারোলিন বলে উঠলেন–বাবার মুখে শুনেছি, শরীর সতেজ রাখার জন্য টনিক জাতীয় কিছু খেতে হয়, অ্যালকোহল মোটেও নয়। আমার বাবা……..
ক্যারোলিনের কথা থামিয়ে দিয়ে বারবারা হো হো করে হেসে উঠল, বড় বড় চোখে তাকাল তোমার বাবা, মানে সিনিয়ার অ্যালগারলনের কথা বলছ? থাক, পিসিমা, তার কথা ঢাক ঢোল পিটিয়ে আর নাই-বা বললে। এ এলাকার কাকচিলও জানে, নেশা জমানোর জন্য ওনার তিনটি বোতল পরপর চাই-ই, আর আমরা জানব না!
ক্যারোলিনের মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে। তবুও কি ভেবে নিজেকে সংযত করলেন। এদৃশ্য দেখে বারবারা খুশিতে ফেটে পড়ল। মুচকি হাসি দেখা দিল তার ঠোঁটে।
আর লুসিয়া? আহা বেচারি, গোমড়া মুখ, শূন্য দৃষ্টি। সে একবার ক্যারোলিনকে লক্ষ্য করল, তারপর বারবারাকে দেখল। ধীরে ধীরে মুখ খুলল, আমতা আমতা করে বলল সেই থেকে তোমরা কি বলছ বল তো? আমি তো আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
-বাছা, তোমাকে নিয়েই তো আমার যত চিন্তা। পিসিমা আলগোছে লুসিয়ার চিবুক তুলে ধরলেন, তারপর বারবারাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–বারবারা ওর যা অবস্থা, কিছু একটা খাইয়ে না দিলে হবে না। খানিকটা স্যালবোলাটাইল হলেও চলত। আমার কাছে এক শিশি ছিল, কিন্তু ওই শয়তানি ঝি-টা। সকালে ঘর ঝাঁট দিতে এসে ফেলল মেঝেতে, ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।
–এত চিন্তা করছ কেন তুমি? বারবারা বলে চলল–তোমার স্যালবোলাটাইল নেই তো কি হয়েছে, হাসপাতালের গুদোম ঘর আছে, যাও, খোঁজ কর, কিছু একটা পেয়ে যাবে মনে হয়।
–হাসপাতালের গুদোমঘর? আবার অবাক হতে হল ক্যারোলিনকে কি বলছিস, স্পষ্ট করে বলতো।
-আরে এডনার ধনভান্ডারের কথা বলছি, বারবারা জবাব দিল, হাতড়ে দেখ, ঠিক কিছু মিলবে।