-না না, কেবল মুখের কথা বিশ্বাস করব না, রিচার্ড হাত বাড়িয়ে বলল, নিজের চোখে দেখতে চাই। দাও, কাগজটা আমায় দাও। দেখি তোমার কথা সত্যি কিনা দাও, দাও, দেরি কর না।
কোথায় পাব ওটা? অসহায়তা ঝরে পড়ল লুসিয়ার কথাগুলিতে। ওটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিয়েছি, আমার কাছে নেই।
–লুসিয়া! রিচার্ড গর্জে উঠল, মুখে বাঘের নিষ্ঠুর হাসি। কেন খামোখা মিথ্যে কথা বলছ, লুসিয়া, আমি নিশ্চিত ওটা তোমার কাছেই আছে। দাও, দিয়ে দাও ওটা।
স্ত্রীর খুব কাছে এসে দাঁড়াল রিচার্ড, হাত বাড়াল।
লুসিয়া নীরব, কি যেন ভাবল, মুহূর্ত খানেক পরে বলল–তার মানে তুমি আমায় বিশ্বাস করছ না।
-যদি মনে করি, ওটা ছিনিয়ে নিতে পারি। রিচার্ড তখন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। দাঁতে দাঁতে পিষে বলল–আমার এই পেশীবহুল চেহারাটা দেখেছ তো। কিন্তু না, গায়ের জোর তোমার ওপর খাটাব না, এ আমার নীতিবিরুদ্ধ। বরং…….. রিচার্ড কথা শেষ করল না।
রিচার্ডের হিংস্র চাউনি লুসিয়াকে ভিত করল। আঁতকে উঠে তফাতে সরে গেল।
রিচার্ড তাকাল লুসিয়ার চোখের দিকে, মিনতি ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণ একভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইল রিচার্ড। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিল না, তোমাকে মারধোর করা সম্ভব নয়, সে কাজ আমার নয়।
লুসিয়ার দিকে কঠিন চোখে তাকাল রিচার্ড–তবে……… তবে তোমার ওই বন্ধু উঃ কারোলিকে আমি ছাড়ছি না। উচিত শিক্ষা দেব। আমার দু-চারটে ঘুসিই যথেষ্ট। মুখ থেকে : আসল কথা হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসবে। আমার বাড়িতে বসে আমার স্ত্রীর সঙ্গেই ফষ্টিনষ্টি। মজা করা বের করছি।
-না না, ওসব করতে যেও না। লুসিয়া আঁতকে উঠল। বোঝা গেল, দারুণ ভয় পেয়েছে সে দোহাই রিচার্ড, শান্ত হও। ওর গায়ে হাত দিও না, মারধোর করো না।
-বাঃ, চমৎকার, পুরনো প্রেমিকের জন্য দরদ উথলে উঠছে। রিচার্ড ব্যঙ্গের স্বরে বলতে থাকল–ডঃ কারোলিকে আমি মারবই, তাতে তোমার কি?
বাড়াবাড়ি কর না রিচার্ড। চাপা গর্জন শোনা গেল লুসিয়ার কথায়–উনি আমার প্রেমিক নন, কোনকালে ছিলেন না।
-আ-হা-হা! রেগে যাচ্ছো কেন? স্ত্রীকে শান্ত করতে রিচার্ড তৎপর হল। লুসিয়ার কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে বলল–হয়তো উনি এখনও তোমার প্রেমিক হয়ে ওঠেন নি, হয়তো উনি……..
রিচার্ড তার কথা শেষ করতে পারল না। বাইরে কারা যেন কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। রিচার্ড ঝট করে স্ত্রীর কাছ থেকে সরে এল, ফায়ার প্লেসের দিকে পা বাড়াল, সিগারেট ধরাল, দৃষ্টি দরজার দিকে মেলে দিল। লুসিয়া ততক্ষণে ভাল মানুষের মতো রিচার্ডের খালি চেয়ারটা দখল করেছে।
দরজা ঠেলে ঢুকলেন দুই মহিলা ক্যারোলিন অ্যামরি আর রিচার্ডের বোন বারবারা অ্যামরি।
কুড়ি-একুশ বছরের সদ্য তরুণী আধুনিকা বারবারার হাতে ঝুলছে সুন্দর একটি ব্যাগ। কোনদিকে না তাকিয়ে সে সটান এসে দাঁড়াল লুসিয়ার সামনে লুসিয়া, তোমার খবর কি? শরীর ভালো আছে তো?
.
০৩.
লোক দেখানো হাসির ঝিলিক ঠোঁটে ছড়িয়ে লুসিয়া জবাব দিল–হ্যাঁগো সোনা, আমার শরীর ঠিক আছে, কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
-সত্যি? তাই বুঝি? বারবারা রসিয়ে রসিয়ে কথাগুলো বলল।
খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় ভাই রিচার্ডকে লক্ষ্য করে চাপা গলায় বলল–সুখেই আছ। তোমাদের মতলবটা বুঝতে পেরেছি। তাই দু’জনে এঘরে এসে ঢুকেছ।
ননদের রসিকতাপূর্ণ ইঙ্গিতটার অর্থ বুঝতে দেরি হল না লুসিয়ার। সে শুকনো হাসি হেসে ঘাড় কাত করল।
বারবারা! এসব কি মজা হচ্ছে? পিসি ক্যারোলিন ধমকে উঠলেন–কি যে অসভ্যতা করিস, ভাল লাগে না।
–আমার কথাগুলো অসভ্যের মতো শোনাচ্ছে, বারবারা উত্তর দিল, বিয়ের পরে মা হওয়া মামুলি এক দুর্ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনার শিকার হবে বলেই নারী জাতির জন্ম। এই সহজ সত্যি কথাটা কেন তুমি মেনে নিতে পারছ না, পিসিমা?
–আবার ফাজলামো! ক্যারোলিন আবার ধমকে উঠলেন। বর্তমান যুগের মেয়েরা এত নোংরা রসিকতা করতে কোথ থেকে শিখেছে, কে জানে। আপন মনে বলে চললেন পিসিমা–আমরা বাপু, তোদের মতো বয়সে এত ফাজিল হয়ে উঠতে পারিনি, কখন কার পেটে বাচ্চা আসবে তা দূর অস্ত।
এসময় রিচার্ড নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
–দিলি তো তোর দাদাকে রাগিয়ে, ক্যারোলিন আবার ধমকে উঠলেন, আহা বেচারা, পুরুষ মানুষ, নিজের বউয়ের সামনে এমন খোলমেলা আলোচনা সহ্য করতে পারে। তাই তো গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সত্যি বারবারা, তোর যে কবে জ্ঞান গম্যি হবে, কে জানে।
শোনো পিসিমা, বারবারা মৃদু হেসে বলতে লাগল, কিছু মনে করো না, অবশ্য মনে করলে আমার বয়ে গেল, রানী ভিক্টোরিয়ান যুগে যা করেছ, তাই আঁকড়ে ধরে বসে আছে। দুনিয়া কি সেই মান্ধাতা আমলে পড়ে আছে? এখন এগিয়ে যাবার সময়, সামনের দিকে সবাই ছুটছে–এসব খবর কি রাখ?
–মেনে নিলাম তোর কথা। তবে সেকাল-একাল নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। অতএব পছন্দ অপছন্দের দ্বন্দ্বও নেই, জেনে রাখিস তুই।
-এ নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার, পিসিমা। বারবারা হেসে উঠল–কিন্তু তোমাদের জমানায় মানুষ কি ভাবে বাবা-মা হয়, এ প্রশ্নের উত্তরে ছোট ছেলেমেয়েদের বলা হত, কোন দেবদূত বা সারস পাখি বেঁচি গাছের ঝোপে বাবা-মায়ের জন্য বাচ্চা রেখে যায়। সত্যি, তোমাদের কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতে হয়, তাজ্জব হতে হয়। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, পিসিমা, বাস্তব না-হলেও তোমাদের ওই ব্যাখ্যা আজও শুনতে ভাল লাগে। ভারী মিষ্টি।