–টাকা। প্রচুর টাকা। কাড়ি কাড়ি টাকা, বিড়বিড় করে উঠল লুসিয়া। তারপর অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলতে থাকল–টাকা, টাকা আর টাকা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মূলে আছে অহোরাত্রি ছুটে মরছে–আরো টাকা! আরো টাকা!
-লুসিয়া, জালে আটকে পড়া মাছি দেখেছ তুমি? রিচার্ডের গলায় বিষণ্ণতার সুর। পিষে মেরে ফেলা মাছি? আমার অবস্থাও ঠিক তাই, অসহায় এক মাছি!
রিচার্ড! লুসিয়া স্বামীর দিকে তাকাল, ব্যাকুলতা ঝরে পড়ছে তার কণ্ঠে আমার দিকে ভালভাবে তাকাও। কি মনে হয় তোমার? আমি কি খুব ভাল আছি? তোমার মতোই অসহায় এক মাছি।
স্ত্রীর কথা শুনে রিচার্ড চমকে উঠল। অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হল।
রিচার্ড, আমায় রক্ষা কর। কথা বলতে বলতে লুসিয়া উঠে দাঁড়াল। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে সে আবার বলল–চল, আমরা পালিয়ে যাই, দূরে অনেক দূরে, এবাড়ির দমবন্ধ করা পরিবেশ যেখানে নেই। দয়া কর, রিচার্ড!
–কি বলছ! পালিয়ে যাব? তোমাকে নিয়ে? কিন্তু কোথায়? কত দূরে সেই জায়গা? রিচার্ডের কথায় ফাঁকা হতাশার সুর।
–যেখানে তুমি বলবে। পৃথিবীতে কি এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে আমরা নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে দিন কাটাতে পারি। কিন্তু এ বাড়ি নয়, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় হওয়া যায়, ততই মঙ্গল। রিচার্ড, আমাকে সর্বদা ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে। ভালভাবে তাকাও। কি মনে হয়, আমি কি খুব ভাল আছি? তোমার মতোই অসহায় এক মাছি।
স্ত্রীর কথা শুনে রিচার্ডের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল, অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হল।
রিচার্ড, আমাকে বাঁচাও, লুসিয়া উঠে দাঁড়াল, চাপা উত্তেজনার আবেগে কাঁপছে তার শরীর আমি বাঁচতে চাই। এই দমবন্ধকরা পরিবেশে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। তুমি আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল, দোহাই তোমার।
ঘাড় ঘুরিয়ে লুসিয়া পেছন দিকে কি যেন দেখাল। তারপর আবার বলল–অশুভ কালোছায়ারা সর্বদা এ বাড়ির যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বাস কর।
রিচার্ডের বোধহয় কথা হারিয়ে গেছে। খানিক বাদে জানতে চাইল কিন্তু লুসিয়া, যেখানেই যাই না কেন টাকার প্রয়োজন। সে টাকা কোথায় পাব। প্রচুর টাকা চাই। লুসিয়া, তুমি তো ভাল ভাবেই জান, পুরুষ মানুষ যতই সুদর্শন হোক না কেন, পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে কোন মেয়ের কাছে কদর পায় না। কি ঠিক বলেছি তো?
–কি যা-তা বকছ? লুসিয়া চমকে উঠল, আসল কথাটা খুলে বল তো।
-বেশ, তাই হোক। তুমি যখন রিচার্ড নিজেকে গুটিয়ে নিল–না না, কিছুই বলার নেই আমার।
আর এখানে থাকা ঠিক হবে না বুঝে রিচার্ড উঠে দাঁড়াল, পা বাড়াতে গিয়ে বাধা পেল। ততক্ষণে লুসিয়ার দুটি হাত চেপে বসেছে রিচার্ডের কাঁধে। তাকে চেপে ধরে জোর করে আগের জায়গায় বসিয়ে দিতে দিতে বলল–রিচার্ড, লক্ষ্মী সোনা–স্বামীর চোখের দিকে তাকাল, নীলনয়না লুসিয়া তখনও মুখ খুলছে না।
রিচার্ডের বিরক্তি ভরে এক ঝটকায় কাঁধ থেকে স্ত্রীর হাত দুটো সরিয়ে দিল।
–রিচার্ড, কোনরকম শব্দটা বের করে স্তব্ধ হয়ে গেল লুসিয়া, কে যেন তার মুখ টিপে ধরেছে, মনে হল।
লুসিয়া, তুমি ভেবেছ, আমার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, গোবর পোরা, গবেট, কোনও দিকে চোখকাণ নেই, তাই তো। বোঝা গেল রিচার্ড ধীরে ধীরে তার রাগ প্রকাশ করছে। পলকহীন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল ডিনারে বসার আগে তোমার ওই পুরনো বন্ধু এক টুকরো কাগজ তোমার হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন, কেউ না লক্ষ্য করুক, ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায়নি।
একটু থামল রিচার্ড, তার মাথায় এখন রক্ত চড়ে গেছে–তুমিও তালবাহানা শুরু করলে, চোখেমুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তুললে যে, এখনই জ্ঞান হারাবে। ডিনার টেবিল ছেড়ে উঠে এলে, রিচার্ডের গলার স্বর তখন উঁচু পর্দায় চলে গেছে। আসলে ব্যাপারটা ছিল এইরকম–তোমার ওই পুরনো বন্ধু, যিনি আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে ঢুকেছেন, ওই চিলতে কাগজে তিনি কি লিখেছেন, তা জানা-না-পর্যন্ত তোমার স্বস্তি হচ্ছিল না। তখন তুমি উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছ। কিন্তু একদিকে আমি, আর অন্যদিকে আমার পিসিমা যে তোমাকে সবসময় গোয়েন্দার দৃষ্টিতে নজর রেখে চলেছেন, তাদের সামনে তো পড়া সম্ভব নয়। তাই অসুস্থতার ভান করলে, ডিনার টেবিলে ছেড়ে পালিয়ে এলে এঘরে, তোমার পেছন স্মেলিং সল্ট নিয়ে পিসিমাও ছুটে এলেন, তোমাকে সুস্থ করতে হবে তো, খানিকবাদে আমি এসে পড়লাম। আমি যে এঘরে ঢুকে পড়ব, তা তোমাদের দুজনের কেউই আন্দাজ করতে পারোনি।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রিচার্ড থামল। লুসিয়া বুঝতে পারল, তার আচরণে স্বামী দেবতাটি ক্ষেপে গেছে, অপমানের জ্বালায় জ্বলছে।
রিচার্ড, লুসিয়া কঁদো কাঁদো গলায় বলল, কি আজে বাজে কথা বলছ? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। সত্যি বলছি রিচার্ড, ডঃ কারোলির সঙ্গে আমার কোন গোপন সম্পর্ক নেই। দিনরাত ওঁর কথা ভাবতে যাব কেন? বিশ্বাস কর আমায়, মিথ্যে বলছি না। এসব ভুল ধারণা মন থেকে ত্যাগ কর।
–কথা বাড়িও না। কঠিন কণ্ঠ রিচার্ডের। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে ঘৃণা কারোলি ওই কাগজে কি লিখেছে, আমি শুনতে চাই। বল, তোমার মঙ্গলের জন্যই বলছি।
-কিন্তু না, বিশ্বাস কর তুমি। কাগজে কিছুই লেখা ছিল না।