–লুসিয়া, আবেগে রিচার্ডের দুটি চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সে ধীর পায়ে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এল, চোখে রাখল চোখ। দু’জনের ঠোঁটেই হাসির ইশারা।
-বাবার বয়সি এক প্রৌঢ়ের সামনে কোনো ইংরেজ নারী-পুরুষ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় না। জানি, এটা তাদের রীতি বিরুদ্ধ। অনেক দিন তো হল এদেশে বাস করছি, আপনাদের আদব কায়দা আমার জানা হয়ে গেছে। তাই বলছি মঁসিয়ে ও মাদাম অ্যামরি, আমি চলে যাচ্ছি, আপনারা প্রাণভরে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরুন, চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিন পরস্পরকে।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, এগিয়ে এসে লুসিয়া কৃতজ্ঞতা ভরে পোয়ারোর হাত দুটি চেপে ধরল–আপনাকে আমি কোনোদিন ভুলব না।
–আপনিও আমার স্মৃতিপটে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। পোয়ারো সামান্য ঝুঁকে পড়লেন, লুসিয়ার হাতে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন।
রিচার্ড এবার এগিয়ে এল। লজ্জিত কণ্ঠস্বরে বলল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে ভুল বুঝে অনেক বিশ্রী ব্যবহার করেছি, বুঝতে পেরে এখন নিজেই মরমে মরে যাচ্ছি। তবে আমি চিৎকার করে বলতে পারি, আপনার কারণেই আমি জীবন ফিরে পেয়েছি, যে সুস্থ দাম্পত্য জীবন হারিয়ে গিয়েছিল, তা মুঠোবন্দি করতে পেরেছি, আপনার মতো সজ্জন লোককে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাই না। রিচার্ড আর কথা বলতে পারল না, ছলছলে চোখে সে তাকিয়ে রইল।
–প্রচণ্ড এক সঙ্কটের মুহূর্তে আপনাদের পাশে যে দাঁড়াতে পেরেছি, আপনাদের যে আবার বিবাহিত জীবনের সুখসাগরে ভাসিয়ে দিতে পেরেছি…. আবেগে পোয়ারোর কণ্ঠ রুদ্ধ হল। জ্যাকেটের আস্তিনে চোখের জল মুছে নিলেন। এখান থেকে আমি আজ যা নিয়ে যাচ্ছি, এর থেকে বড়ো পাওনা আর কিছু হতে পারে না, মঁসিয়ে অ্যামরি। বিদায়বেলায় চোখের জল মুছে, আসুন, আমরা হেসে উঠি।
হাসি থামিয়ে পোয়ারো বললেন, বদ্ধ ঘরে আর বন্দি থাকবেন না। জানলা তো খোলাই আছে। বাইরে খোলা আকাশ, আর সবুজের হাতছানি। দুজনে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ান, মন হালকা হবে।
লুসিয়া আর রিচার্ড কথা না বাড়িয়ে পোয়ারোর নির্দেশ মেনে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো গলিয়ে বাগানে গিয়ে পড়ল।
পেছন থেকে পোয়ারো হাঁক দিলেন–লুসিয়া আর রিচার্ড, আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়ে উঠুক, সেই কামনা করি। বাপের বয়সি লোকেরাই এমন আশীর্বাদ করতে পারেন। আর হ্যাঁ, মাদাম, কোনো এক গাছের নীচে আপনার ননদ বারবারাকে পাবেন, সঙ্গে আমার একান্ত অনুগত সহকারী ও বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংসও আছেন। আমার সামনে বারবারাকে দেখলাম, টানতে টানতে হেস্টিংসকে নিয়ে গেলেন বাগানে। ছেলেমানুষ, আপত্তি, করতে পারিনি। কিন্তু এবার যে আমার বন্ধুটিকে ছাড়তে হবে। দয়া করে মাদমোয়াজেল বারবারাকে বুঝিয়ে বলুন, নয়তো লন্ডনে ফেরার ট্রেন ধরতে পারব না। বন্ধুটিকে আমার হাতে ফিরিয়ে দিলে আমি বাধিত থাকব।
নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন পোয়ারো। জানলা ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে এলেন ঘরের মাঝখানে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালেন ফায়ারপ্লেসের কাছে। ম্যান্টেলপিসে রাখা ফুলদানিটার গায়ে হাতের পরশ দিলেন। আপনমনে উচ্চারণ করলেন–যাক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু ভালোয় ভালোয় মিটল। বিক্ষিপ্তভাবে যেখানে যা কিছু ছড়িয়ে ছিল, সেগুলো আবার শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুচারুভাবে স্ব স্ব জায়গা ফিরে পেল।
আত্মতৃপ্তিতে মন তার পরিপূর্ণ। পৌরুষদৃপ্ত পদক্ষেপে চলে গেলেন ঘরের বাইরে।