–দাম পাবে না?
তাহলে এটা নিয়ে কী করবে তুমি? লুসিয়া নিস্পৃহ কণ্ঠে জানতে চাইল।
–জানি না। রিচার্ড পাল্টা প্রশ্ন করল, এবার তোমার জবাবটা শুনি।
–যা করব, তার বিরুদ্ধে যাবে না তো? লুসিয়া জানতে চাইল।
–একদমই নয়। কাগজের ভাঁজ করা টুকরোগুলো রিচার্ড হাতের মধ্যে তুলে নিল। লুসিয়াকে দিয়ে বলল–ধরো, যা খুশি করো, আমি কিছু বলব না।
-ধন্যবাদ রিচার্ড, গলার স্বর নীচুতে নামিয়ে লুসিয়া বললো, দেখো, আবার বলছি, আমি আমার মতো এগুলোর ব্যবস্থা করছি, পরে এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করো না, বলে রাখছি।
লুসিয়া ফায়ারপ্লেসের সামনে এসে দাঁড়াল। ম্যান্টেলপিস থেকে দেশলাই তুলে নিল। কাঠি জ্বেলে কাগজে আগুন লাগাল। একটা একটা করে ছুঁড়ে দিল ফায়ারপ্লেসের মধ্যে। রিচার্ড নির্বাক হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে, বাবার সাধনার ফল কীভাবে একটু একটু করে আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফর্মুলা লেখা ভাঁজ করা কাগজগুলোর গতি সুসম্পন্ন হল। পড়ে রইল কেবল ছাই।
–আপোদ বিদেয় হল, বাঁচা গেল। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে লুসিয়া দেশলাইটা জায়গা মতো রেখে দিল। নামী বিজ্ঞানী হয়েছেন, কোথায় মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করবেন, তা না করে মানুষকে ধ্বংস করার কথা ভেবে চলেছেন। রাতদিন মুখ গুঁজে পড়ে আছেন ওই মারাত্মক বোমা তৈরিতে। কারণ হাজার হাজার পাউন্ড পকেটে আসবে, অর্থের বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন, সেই স্বপ্নেই বিভোর। সত্যি বলছি, মঁসিয়ে পোয়ারো, ওই ফর্মুলা বিক্রির অর্থের প্রতি আমাদের লোভ নেই, আমরা চাই না বড়ো লোক হতে।
-সাবাস মাদাম, সাবাস। নিজের চোখে যা দেখলাম, তা প্রশংসার যোগ্য। হাজার হাজার পাউন্ড লোভের বশবর্তী না হয়ে আপনি কেমন স্বচ্ছন্দে ওই মারাত্মক বোমার ফর্মুলা পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন, আশ্চর্য।
–কিন্তু আমার বিবাহিত জীবন, আমার পরিবার, অশান্তির আগুনে সব এভাবেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দুঃখে ভারাক্রান্ত লুসিয়ার মন। ধরা গলায় বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি কি আবার সেই সুখ শান্তি ফিরে পাব?
নিশ্চয়ই পাবেন, পোয়ারো ধমকের সুরে বললেন, এই আমি, এরকুলো পোয়ারো, আপনার বাবার বয়সি একজন ভদ্রলোক, এখনও কি আমার প্রতি আপনার অবিশ্বাস জমে আছে। যেসব ঘৃণ্য চক্রান্তে আপনি জড়িয়ে পড়েছিলেন, কীভাবে তা থেকে মুক্তি পেলেন, /৩৯ তলিয়ে দেখুন। আবার বলছি মাদাম, এই এরকুল পোয়ারোর ওপর আর একটু আস্থা রাখুন, জীবনের সুখ শান্তি সব ফিরে পাবেন, আমি আপনাকে একাজে সাহায্য করব, প্রতিশ্রুতি দিলাম। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সেই ফিনিক্স পাখির গল্পের কথা, ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, আগুনে পুড়ে পাখিটা ছাই হয়ে গেল বটে, পরক্ষণে ফিরে পেল নতুন দুটো ডানা, মনের খুশিতে ডানা মেলে সে আবার আকাশে উড়ে গেল। আপনি হলেন সেই ফিনিক্স পাখি, যে রাশি রাশি দুঃখ, নিন্দা, কলঙ্ক আর সন্দেহের আগুনে পুড়ে ছাই হবার পরেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে নতুন ভাবে বেঁচে উঠেছে। আপনাদের বিবাহিত জীবনে সামান্য চিড় ধরেছে মাত্র। এর মূলে আছে ভুল বোঝাবুঝি আর অবিশ্বাস। আপনারা নিজেরাই নিজেদের দুঃখের জীবনকে নতুন সূর্যের আলোতে ভরিয়ে তুলতে পারেন, সেখানে থাকবে না কোনো অবিশ্বাস, থাকবে না সন্দেহের বাতাবরণ, থাকবে শুধু নতুন ভাবে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকার মন্ত্রমালা।
কিন্তু আমি আমার আসল পরিচয় না দিয়ে আমার স্বামীকে ঠকিয়েছি। এই অপরাধবোধ সব সময় আমায় কুরে কুরে খাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পাব কী করে?
লুসিয়া তুমি একাই কি অপরাধ করেছ? রিচার্ডের গলা বুজে এল, আমিও তোমাকে সন্দেহ করেছিলাম, আমার বাবার ফর্মুলা তুমিই চুরি করেছ ভেবেছিলাম।
-মাদাম লুসিয়ার কানের কাছে পোয়ারো মুখ নামিয়ে নিয়ে এলেন। চাপাস্বরে বললেন–স্যার ক্লডও আপনাকে ফর্মুলা-চোর হিসাবে সন্দেহ করেছিলেন, এখবর আমার জানা। অবশ্য স্যার ক্লডকে দোষ দিই না। উনি কেন, ওঁর জায়গায় যে কেউ থাকলে এমনটিই হত। উনি খুন হবার তিন-চারদিন আগে একটা চিঠি পেয়েছিলেন, নামহীন স্বাক্ষরহীন চিঠি। আপনার সম্পর্কে স্যার ক্লডকে হুঁশিয়ারি করে চিঠিটা লেখা। আজ বুঝতে পারছি, চিঠিটা কে লিখেছিল। ডঃ কারোলি নিজে অথবা ওর কোনো চ্যালার কাজ। ওই চিঠিই স্যার ক্লডের মনে আপনার সম্পর্কে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার স্বামী রিচার্ডের কথা ভাবুন তো। পুলিশের জেরার মুখে যাতে আপনাকে না পড়তে হয়, তাই আগে ভাগে তিনি নিজেই ইন্সপেক্টার জ্যাপের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি স্যার ক্লডের খুনী। উনি কেন একাজ করেছিলেন জানেন? ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে। উনি কখনোই চাননি, সন্দেহের বশে পুলিশ আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাক।
রিচার্ড! অস্ফুটে বলে উঠল লুসিয়া, তাকাল স্বামীর দিকে, সে চাউনিতে ঝড়ে পড়ছে কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালোবাসা।
এবার আপনাকে বলি, মঁসিয়ে রিচার্ড, পোয়ারো কঠিন কণ্ঠে বললেন–আপনি কি জানেন, আপনার স্ত্রী আপনাকে বাঁচানোর জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। উনি বারেবারে আমায় জানিয়েছিলেন, স্যার ক্লডকে উনিই খুন করেছেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে এমন কাজ স্ত্রী করতে পারেন, তার ভালোবাসা মেকি তো হতে পারে না।