মাদমোয়াজেল, ইন্সপেক্টার জ্যাপের দিকে হাত তুলে দেখালেন। পোয়ারো বললেন–এই জটিল রহস্য সমাধানের কৃতিত্বের দাবীদার একমাত্র ইনি, আমার পুরোনো ও খুব ভালো বন্ধু, গোয়েন্দা ইন্সপেক্টার জ্যাপ, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এক জাঁদরেল অফিসার হিসাবে যিনি পরিচিত।
-মঁসিয়ে পোয়ারো সামান্য হাসলেন, নিরহঙ্কার ভাবটা দেখছি আপনি সযত্নে এখনও পালন করে চলেছেন। সত্যি আপনি একজন খাঁটি ভদ্রলোক।
এসময় কনস্টেবল জনসন ঘরে এসে ঢুকল। সে বিষমেশানো হুইস্কিসহ গ্লাসটা একটা পলি প্যাকে ভরে নিল।
জ্যাপ লক্ষ্য করলেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মুগ্ধ চোখে বারবারাকে দেখছেন। তিনি বললেন অসংখ্য ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনার সযত্নে রক্ষিত জিনিসটি আমি নিয়ে গেলাম। মঁসিয়ে পোয়ারোকে খুন করার প্রচেষ্টা মামলায় এটি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে লাগবে। চলো হে জনি।
বিদায় অভিবাদন জানিয়ে ইন্সপেক্টর জ্যাপ বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
***
এবার বারবারা মুখ খুলল। পোয়ারোর দিকে তাকাল, সামান্য হাসল, লজ্জা ঝরে পড়ল। জানতে চাইল–এবার আসল কথাটা বলুন তো, খুনিকে কে ধরল, আপনি নিশ্চয়ই, ঠিক বলেছি মঁসিয়ে পোয়ারো?
ভুল করছেন আপনি। পোয়ারো ঠোঁটে হাসি বুলিয়ে বন্ধুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–এ রহস্য উন্মোচনের অন্তরালে সবার আগে আছেন ইনি, আমার বন্ধু ও সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। এমন একটা কথা বলেছিলেন, কোন খেয়ালে বলেছিলেন জানি না, যা ওঁর অজান্তেই আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেল সাফল্যের দিকে। দেখুন তাকিয়ে ওর দিকে, বেচারা বন্ধুটি আমার, নিজের কৃতিত্ব জাহির করে বলতে হবে তো, তাই কেমন ছটফট করছে দেখুন।
….মাদমোয়াজেল, আপনাদের বাগানটা সত্যি সুন্দর। যান, ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। কোনো গাছের নীচে বসুন। ওর মুখে শুনবেন খুনিকে ধরার রোমাঞ্চকর কাহিনী, যা শুনে আপনার গায়ে কাঁটা দেবে।
পোয়ারো কথা শেষ করে বারবারা ও হেস্টিংসকে নিয়ে চলে এলেন খোলা জানলার কাছে।
-ও আমার প্রাণের সখা, বিলম্ব কেন, নাটকীয় ভঙ্গিতে সুর করে বলতে বলতে বারবারা হেস্টিংস-এর হাত ধরে জানলা টপকে বাগানের দিকে চলে গেল।
পোয়ারো এখন বসার ঘরে একা। রিচার্ড এসে ঢুকল সে ঘরে। পরক্ষণেই লুসিয়া হাজির। স্বামীকে দেখে আকুল স্বরে তাকে ডাকল–রিচার্ড!
রিচার্ড ঘাড় ফেরাল। স্ত্রীকে দেখে অবাক হল। বলল–লুসিয়া!
-হ্যাঁ, আমি লুসিয়া আর কোনো কথা বলতে পারল না। কী এক ভয় এসে বুঝি তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। হতাশ হয়ে সে ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
লুসিয়া, তুমি। রিচার্ড দ্রুত লুসিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল।
লুসিয়া উঠে দাঁড়াল, চোখে জল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা। রিচার্ডের চোখ থেকে ঝরছে অনুতাপের হাহাকার। কেউ কোনো কথা বলছে না, অনিমিখ তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে।
হঠাৎ পোয়ারোর দিকে দৃষ্টি পড়ল লুসিয়া। সে অসহায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল, যেন বাবার কাছে মেয়ে এসেছে সান্ত্বনা লাভের আশায়। লুসিয়ার দুটি হাত বাড়িয়ে দিল–মঁসিয়ে পোয়ারো, ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে আর ছোট করব না।
পোয়ারো পরম স্নেহে লুসিয়ার হাত দুটি নিজের মুঠোতে ধরে বললেন–মাদাম, আপনি এবার নিশ্চিন্ত হলেন।
নিশ্চিন্ত হলাম কী করে? আমার শ্বশুরের খুনি ধরা পড়েছে বটে, তাই বলে আমার দুঃখের অবসান কি হল?
কথা বলতে বলতে লুসিয়া তার স্বামীর দিকে তাকাল, অবশ্য সরাসরি নয়।
-হুঁ, বুঝতে পারছি। আপনি এখনও আপনার পারিবারিক সুখ শান্তি, যা আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, তা ফিরে পাননি, আপনার চোখ-মুখই তার প্রমাণ দিচ্ছে।
-আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আপনি সত্যিই আমার বাবার বয়সি মানুষ তাই তো আমার মনের অশান্তির কথা কেমন পড়ে ফেললেন। বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি কি আমার হারানো সুখ-শান্তি আর কোনো দিন ফিরে পাব না?
জীবনে ঝড় ওঠে, সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়, তারপর একসময় থেমে যায়। তখন নতুন জীবন। আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে পোয়ারো বললেন, পরিবারে আবার শান্তি সুখ, সবকিছু ফিরে আসে।
-মাদাম, ভরসা হারাবেন না, আপনাকে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাকে ভরসা করে ঠকবেন না। হঠাৎ পোয়ারোর মুখ আনন্দে উদ্ভাস হয়ে উঠল, মনে হল লুসিয়ার দাম্পত্য শান্তির হদিস তিনি পেয়েছেন। লুসিয়াকে নিয়ে কফি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন, এখানেই পড়ে আছে ফর্মুলার টুকরো কাগজগুলো, একটু আগে যেগুলো জ্যাপ বের করেছিলেন রেনরের জ্যাকেটের পকেট থেকে।
হাতের ইশারায় রিচার্ডকে কাছে ডাকলেন। রিচার্ড এলে আঙুল দিয়ে ভাঁজ করা কাগজের টুকরোগুলোকে দেখিয়ে বললেন–এই হল আপনার বাবা স্যার ক্লডের চুরি যাওয়া ফর্মুলা। তবে তিনি যে কাজটা শেষ করে যেতে পারেননি, তা নিশ্চিত জানি। অসম্পূর্ণ হলেও এগুলো যে উদ্ধার করতে পেরেছি, তা ভেবেই গর্ব হচ্ছে। মঁসিয়ে রিচার্ড আর মাদাম লুসিয়া, আপনারা দুজনেই জেনে রাখুন, সামান্য প্রচেষ্টায় এগুলো আবার আগের মতো ছেড়ে দেওয়া যায়, তখন হুবহু আগের মতোই দেখাবে।
ভগবান! এই সেই সর্বনেশে ফর্মুলা, মঁসিয়ে পোয়ারো, রিচার্ড বলতে থাকল, এগুলোর কথা আমি একটুও মনে রাখিনি। আমার বাবা আর তার হতভাগ্য সেক্রেটারির কাছে হয়তো এই কাগজের দাম অনেক অনেক টাকা, কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছি না, এর দাম আমার কাছে এক কানাকড়িও নয়। ধ্বংসাত্মক বোমার সাথেই ওই কাগজের তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে, বাবাকে খুন করেছে, সংসারের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে, এমনকি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে। এমন এক ফর্মুলা আমার কাছে কী দাম পাবে বলুন?