রেনর এতক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার চোখ তুললেন, তাকালেন জ্যাপের দিকে। তারপর দৃষ্টি ঘুরে এল পোয়ারোর কাছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কেটে কেটে বললেন–জানেন, জবরদস্ত পরিকল্পনা করেছিলাম, ধাপে ধাপে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনাকে এ বাড়িতে দেখে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। এক অজানা ভয় আমায় জাপটে ধরল। ভেবেছিলাম, ওই ফর্মুলাটা হাতিয়ে নিয়ে বেচে দেব। নিদেনপক্ষে ষাট হাজার পাউন্ড তো পেতাম। তারপরে সুন্দর একটা জীবন, তখন আমাকে আর পায় কে? কিন্তু আপনি আসাতে সব মাঠে মারা গেল। এক ফুৎকারে মিলিয়ে গেল আমার সোনালী স্বপ্নগুলো। এখন বুঝতে পারছি, বৃথাই আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করছি। দোষ হল আমার মনের ভেতরের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের, যা আমার জীবনটাকে ছারখার করে দিতে চলেছে।
রেনর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–আপনি এখানে হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার উচিত ছিল, তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাওয়া। তবে আমার মনিব হতে পারেন এক যশস্বী বিজ্ঞানী, কিন্তু আমার চোখে তিনি ছিলেন এক অশ্রদ্ধার পাত্র। ছোট থেকে পয়সা কামাতে শিখেছেন বটে, কিন্তু যেমন কৃপণ তেমনি দেমাকি। বাড়ির কেউ তাকে পছন্দ করতেন না। স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা বিনা উনি কীভাবে এতগুলো বছর বেঁচেছিলেন, তা ভেবে অবাক হয়ে যাই। তবে এখনও আমার আফশোশ হচ্ছে, ওই নীচ মনের মানুষটাকে শেষ করে তখনই ফর্মুলা নিয়ে পালিয়ে কেন গেলাম না।
-মঁসিয়ে রেনর, পোয়ারো বললেন, আমি যখন ঝিমিয়ে পড়ার ভান করেছিলাম, আপনি তখন জাঁক করে কী বলেছিলেন মনে আছে? আপনি নাকি দারুণ বুদ্ধিমান, গোড়াতেই আমার তা বোঝা উচিত ছিল এবং অবজ্ঞা ভরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। তবে যাবার আগে জেনে নিন, ও ভুল আমি করিনি। আপনি যে অত্যন্ত ধূর্ত, তা আমি, এরকুল পোয়ারো আগেই টের পেয়েছিলাম। আপনার মতো উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিমান এক বিজ্ঞান সাধকের এই দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখে সত্যিই খারাপ লাগছে।
এবার ইন্সপেক্টর জ্যাপ এগিয়ে এলেন–এডওয়ার্ড রেনর, তার হাতে হাত কড়া পরাতে পরাতে বললেন–সুপরিকল্পিতভাবে ও সুস্থ মাথায় স্যার ক্লড অ্যামরিকে হত্যা করা এবং তাঁর ফর্মুলা চুরি করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। আপনি একটা কথা জানবেন, এখন থেকে আপনি যা কিছু বলবেন, মামলা শুরু হলে সেগুলো সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে।
ইন্সপেক্টর জ্যাপ এবার তাঁর কনস্টেবলকে ইঙ্গিত করলেন, এডওয়ার্ড রেনরকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে। বললেন জনি, ওই হুইস্কি ভর্তি গ্লাসটা নিয়ে খেতে ভুলো না, ওটাতে বিষ মেশানো আছে, খেয়াল রেখো।
কনস্টেবল জনসন রেনরকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক এই সময় দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন ক্যারোলিন অ্যামরি। রেনরের হাতে হাতকড়া দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। কনস্টেবল তাকে পাশ কাটিয়ে রেনরকে নিয়ে চলে গেল।
বড়ো বড়ো চোখ করে ক্যারোলিন পোয়ারোর কাছে জানতে চাইলেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, এসব কী দেখছি? আমার ভাই স্যার ক্লডের খুনি কি ওই এডওয়ার্ড রেনর?
মাদাম, নিজের চোখেই দেখলেন, পোয়ারো জবাব দিলেন, রেনর ফর্মুলা চুরি করে আপনার ভাইকে বিষ মেশানো কফি খাইয়ে মেরেছে। পালাতেই যা বাকি ছিল। কিন্তু বিধি বাম, তাই বামাল সমেত ধরা পড়ে গেলেন।
-ওঃ ভগবান! এসব কী শুনছি। ক্যারোলিনের আর্তকণ্ঠ শোনা গেল, হতবিহ্বল তার দৃষ্টি। –লোকটার পেটে পেটে এত শয়তানি ছিল, বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা ওকে আমাদের পরিবারের একজন করে নিয়েছিলাম। সময়ে-অসময়ে ওর পাশে থেকেছি। শরীর খারাপ হলে ওষুধ দিয়েছি। এই তো ক’দিন আগে, আমি নিজে ওকে বীসওয়াক্স ওষুধ খাইয়েছি। এত কিছু করে পাল্টা আমরা কী পেলাম। ক্যারোলিন ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পোয়ারোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। এইসময় দরজার পাল্লা দুপাশে ধরে রিচার্ড এসে দাঁড়াল। ক্যারোলিন কোনোদিকে না তাকিয়ে রিচার্ডকে সরিয়ে ছিটকে চলে গেলেন বাইরে।
ঠিক এই সময় বাগান থেকে জানলা দিয়ে লাফিয়ে বারবারা ঘরে এসে ঢুকল। সেও শুনল রেনরের গ্রেপ্তারের কাহিনী। প্রথমটায় মানতে সেও পারছিল না। তারপর আপন মনে বলল–আশ্চর্য! রেনর এই কাজ করতে পারে ভাবাই যায় না। ওনার ব্যবহার দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে, আপনিই বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো। এখন আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে, হাতের কাজ শেষ না করে ওই রেনরই আমাকে ফক্সট্রট নাচে সঙ্গ দেবে বলে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, এর খানিক বাদেই জ্যেঠুর মৃত্যু হয়।
–শুধু কী তাই, ইন্সপেক্টার জ্যাপ বারবারাকে লক্ষ্য করে বললেন–লোকটার কুকীর্তির শেষ নেই। যে বিষ খাইয়ে আপনার জ্যেঠুকে খুন করেছে, সেই একই বিষ দিয়ে মঁসিয়ে পোয়ালরার জীবন খতম করতে চেয়েছিল।
তাই নাকি! কী সর্বনাশ কান্ড ঘটে যেত বলুন তো! বারবারা এবার ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে দেখিয়ে কৈফিয়তের সুরে জানতে চাইল কেন উনি, বাগান থেকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন?
মঁসিয়ে পোয়ারোর লেখা চিরকুট পেয়ে আমি, জনসন আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, কখন নাটকের যবনিকা টানা হবে। রেনর যে বিষ মেশানো হুইস্কি মঁসিয়ে পোয়ারোকে দিয়েছিল, সেটা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বদলে দিয়েছেন তা রেনর টের পায়নি। মঁসিয়ে পোয়ারো এমন অভিনয় শুরু করলেন যে, সত্যি সত্যি ওই হুইস্কি খেয়ে তার প্রাণবায়ু এখুনি বেরিয়ে যাবে। রেনর ভাবল, লোকটা তো মরেই যাবে, আমি যদি সত্যি কথাটা বলে দিই, কে আর জানতে পারছে। বেশ জোরালো কণ্ঠস্বরে নিতে অপরাধের কথা স্বীকার করল। স্যার ক্লডকে খুন আর ফর্মুলা চুরি রেনরের এই স্বীকারোক্তি আমরা সকলে স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। তারপরেই বামাল সমেত অপরাধীকে আমরা ধরে ফেলি। রেনরের দুর্ভাগ্য, আত্মবিশ্বাস যে তার সাথে এমন ছলনা করবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি।