–ধারণা…… আমি ……..না, পারছি না।
–না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ সকলের দেখার চোখ এক নয়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুরে রেনর বললেন।
-আপনি যতই আমার তারিফ করুন না কেন, আপনাকে আমি কিন্তু ছাড়ছি না, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন–সবার সামনে আপনার ভালো মানুষের মুখোশটা খুলে দেব, আমি এরকুল পোয়ারো বলছি।
পোয়ারোর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোল না, তিনি শরীরটাকে এলিয়ে দিলেন চেয়ারের গায়ে।
–এসব করার সময় আর আপনি পাবেন না মঁসিয়ে পোয়ারো। করুণা ও অবজ্ঞা মিশ্রিত হাসিতে মুখ ভরিয়ে এডওয়ার্ড রেনর বলে চললেন–তার আগে হুইস্কি কেন তেতো লাগল, সে ইতিহাস শুনে যাবেন না? আপনার অত বড়ো মাথাটা কেন যে এর কারণটা আবিষ্কার করতে পারল না, বুঝতে পারছি না। যাক সে কথা। মারা যাবার আগে স্যার ক্লডও কফি খেয়ে বড় তেতো লাগছে বলেছিলেন, এখবর আপনার অজানা নয়, মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এবাড়িতে আপনি ঢোকার অনেক আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম হিসকোসিনের বেশ কয়েকটা শিশি। স্যার ক্লডকে কফিতে যতটুকু ঢেলেছিলাম, মনে হয় আপনার বেলায় তার পরিমাণ বেশি পড়ে গেছে। তাই ফলটাও তাড়াতাড়ি দিচ্ছে। ভালোই হল, আমি তারিয়ে তারিয়ে দেখছি, আপনি কেমন ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাচ্ছেন। তবে যন্ত্রণা নেই বলুন, কেমন ঘুমের রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। না, কোনো স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে পাবেন না। সব দুঃস্বপ্ন হয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে আপনার মৃত্যুর সাথে।
-মঁসিয়ে রেনর, থামুন, আপনিই তা হলে……. হেস….টিং…স…..হে-স….
এরকুল পোয়ারো আর কিছু বলতে পারলেন না, দু চোখ বুজে ঢলে পড়লেন।
-ও মশাই, এত তাড়াতাড়ি চোখ বুজলে তো চলবে না। রেনর এগিয়ে এসে পোয়ারোকে ঠেলা দিলেন-নিন, নিন, চোখ খুলুন, জোর করে চোখের পাতা টেনে থাকুন। মরার আগে সেই গুপ্ত জায়গাটার খবর জেনে নি, যেখানে ফর্মুলাটা লুকোনো ছিল।
রেনর আবার তাকালেন পোয়ারোর দিকে, তারপর ফায়ার প্লেসের কাছে চলে এলেন, ম্যান্টেলপিসে রাখা ফুলদানিটা তুলে নিলেন। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কাগজের টুকরোগুলো বের করলেন। তাড়াতাড়ি সেগুলো জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। তাকালেন পোয়ারোর দিকে। বললেন–কাজ শেষ, চলি মি. এরকুল পোয়ারো।
খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো লক্ষ্য করে এডওয়ার্ড রেনর এগিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য জানলা গলিয়ে পগার পার হবেন।
কিন্তু তা আর সম্ভব হল না।
–এ কী! কোথায় চললেন? খামটা নিয়ে যান, যার মধ্যে ফর্মুলাটা ছিল।
পোয়ারোর স্বাভাবিক গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে রেনর চমকে উঠে ঘাড় ফেরালেন। ঠিক এই সময় বাগান থেকে জানলা টপকে ভেতরে এসে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর জ্যাপ, সঙ্গে তার কনস্টেবল জনসন।
রেনর ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে পালাবার জন্য জানলার দিকে ছুটে গেলেন। জানলা দিয়ে লাফ দেবার আগেই কনস্টেবল তাকে জাপটে ধরল, হেঁচড়ে হেঁচড়ে নিয়ে এল ঘরের মাঝখানে।
-ধন্যবাদ, জ্যাপ, ঠিক সময়ে তুমি এসে পড়েছ। পোয়ারো গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শরীরটাকে এপাশ-ওপাশ করে সহজ করলেন–আর সামান্যতম দেরি হলে ওই মহাগুরু জানলা টপকে বাগান পেরিয়ে নাগালের বাইরে চলে যেত। সত্যি, মোক্ষম সময়ে তুমি এসেছ।
জানলার বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালে ঘরের সব কথাবার্তা শোনা যায়, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর কাছে তোমার পাঠানো চিরকুটটা পেয়ে আমি জনসনকে নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করছিলাম, আর তোমাদের কথা চালাচালি শুনছিলাম, একেবারে স্পষ্ট। আগে ওর পকেটটা দেখি, কী আছে?
জ্যাপ হাত ঢুকিয়ে দিলেন রেনরের জ্যাকেটের পকেটে। বেরিয়ে এল কতগুলো টুকরো কাগজ। সেগুলো কফি টেবিলের ওপর রাখলেন। তার আর এক পকেট থেকে পাওয়া গেল হিসকোসিনের লেবেল আঁটা টিউব। বললেন–এটা দেখুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, একটা বড়িও নেই।
এইসময় জানলা দিয়ে ভেতরে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, তার হাতে সোড়া মেশানো হুইস্কির গ্লাস। তিনি সরাসরি তাকালেন রেনরের দিকে। তারপর গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন পোয়ায়োর হাতে।
-মঁসিয়ে রেনর, মদের গ্লাসটা অন্য টেবিলে রেখে পোয়ারো বললেন, আপনি যে নাটক শুরু করেছিলেন, তাতে আমায় কুশীলব বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুঃখিত, আমার নাটকে আপনি একক অভিনয় করে হাত তালি কুড়িয়ে নিলেন। জ্যাপকে আমি চিরকুটটা লিখে হেস্টিংস এর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এবার ভীষণ গরম লাগছে বলে ভণিতা করে আপনাকে খেলতে নামিয়ে দিলাম। আসলে আপনার গ্যাড়াকলটা আমার বুঝতে বাকি ছিল না। তাই টোপ ফেলতে হল। হেস্টিংস জনালার বাইরে দাঁড়িয়েছিল। ও এক গ্লাস হুইস্কি ওপর থেকে নিয়ে এসেছিল। আপনার চোখকে ধুলো দিয়ে আপনার আনা ট্রে থেকে গ্লাস তুলে হেস্টিংস-এর সঙ্গে পালটাপালটি করে নিলাম। ব্যাস নাটক জমে উঠল, অবশেষে যবনিকা পড়ে গেল।
-যে বিষ কফির সাথে মিশিয়ে উনি নিজের মনিব স্যার ক্লডকে হত্যা করেছেন, সেই একই বিষ আপনার হুইস্কিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, আপনাকে খুন করার জন্য। ওই হুইস্কির গ্লাস ফরেনসিকে পাঠালেই সব জানা যাবে। জ্যাপ বলে চললেন–ফাঁসির দড়ি গলায় ওঁকে পড়তেই হবে। এমন কোনো জাঁদরেল উকিল নেই, যে ওঁকে বাঁচাতে পারে।