পোয়ারোর বকবকানি শুনে রেনরের জ্বরু দুটো কুঁচকে গেল, মুখে একরাশ বিরক্তি, অবশ্য তা প্রকাশ্যে নয়। কোনোরকমে মাঝে মাঝে বলছেন, হ্যাঁ, তাই তো, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার বক্তব্যকে আমি সমর্থন করি।
রেনর বুঝি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। তিনি পোয়ারোর কাছাকাছি হবার জন্য নিজের চেয়ারটা টেনে নিয়ে এলেন। ক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বরে বললেন আপনি সেই থেকে কীসব বকে চলেছেন বলুন তো! অর্থহীন কিছু সংলাপ। আপনি কি এসব ছাইপাশ শোনাতেই চেয়েছিলেন? এক গ্লাস হুইস্কি পেটে পড়তে না পড়তেই হাবিজাবি বকতে শুরু করে দিলেন?
নেশা আমার একটুও হয়নি, মঁসিয়ে রেনর। পোয়ারো পিঠ টান করে বসলেন–এখনও পর্যন্ত যা কিছু আপনাকে বলেছি, সুস্থ মস্তিষ্কেই বলেছি। হ্যাঁ, আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল ধুলো ময়লা। শুরু করেছি বটে শেষ করা হয়নি। আপনি কিন্তু আমার চোখে ধুলো দিতে পারেননি, অবশ্য ধুলো থাকলে তো দেবেন। পোয়ারোর মাথাটা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ল–কী, বুঝতে পেরেছেন? অবশ্য মগজে যদি ঘিলু থাকে।
-না, রেনরের বিরক্তির মাত্রা তখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভনিতা না করে স্পষ্ট করে বলুন, দয়া করে।
বেশ, তাই বলছি। পোয়ারো হাত তুলে রেনরকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন ধুলোময়লা মাদমোয়াজেল বারবারার কথা। শব্দটা আমার মনে দারুণ ভাবে রেখাপাত করে। ওষুধের টিনের বাক্সের ঢাকনায় কোনো ময়লা নেই, অথচ বাক্সটা যার ওপর রাখা হয়েছে, মানে শেল্টা ধুলোতে ঢাকা। বুঝতে আমার দেরি হল না যে ……পোয়ারো চুপ করলেন।
–কী হল, থেমে গেলেন কেন? শেষ করুন।
–বুঝতে দেরি হল না যে, কয়েকদিন আগে ওই ওষুধের বাক্সটা কেউ নীচে নামিয়ে ছিল। ওই সময় স্যার ক্লডের খুনি প্রয়োজন মতো বিষ সরিয়ে রেখেছিল, ফলে ওনাকে খুন করার সময় তাকে আর ওই বাক্সের আশে-পাশে যেতে হয়নি। আর খুনী এই কাজটা করেছিল, সকলের অগোচরে। মঁসিয়ে রেনর, আপনি আপত্তি করলে কী হবে, আমি নিশ্চিত, আপনিই আগে থেকে হিসকোসিন গোপন কোনো জায়গায় সরিয়ে রেখেছিলেন। মঁসিয়ে রিচার্ড কফির কাপ নিয়ে স্টাডিতে ঢুকেছিলেন, এটা ঠিক, কিন্তু আপনি ওই কাপে আগেই বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন, তারপরে বারবারার সঙ্গে নাচতে চলে যান। আমি ভেবেছিলাম, আপনার এই কুকর্মটি কারো চোখে ধরা পড়েনি, ভুল ধারণা। মাদাম লুসিয়া স্পষ্ট দেখেছিলেন।
-ওঃ ভগবান! রেনর ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ বটে, কিন্তু ঠোঁটে সামান্য হাসি টেনে বললেন–স্যার ক্লডের হত্যাকারী হিসাবে আপনি শেষ পর্যন্ত আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। সত্যিই, হুইস্কির নেশা আপনাকে পেয়ে বসেছে দেখছি।
–বেশ, আপনার কথাই সই, কিন্তু আপনি! আপনি তো দিব্যি সুস্থ মাথায় কথা বলছেন। তাহলে আপনি বলুন, আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্যি, না মিথ্যে?
-না না, একেবারেই মিথ্যে নয়। রেনর রাগে ফেটে পড়লেন। গলা চড়িয়ে বললেন–এ অভিযোগ আমি মেনে নিচ্ছি। এর জন্য মাথা হেঁট? কখনো না। বরং আমি গর্বিত। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কত স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে কাজ করতে পেরেছি বলে। শেষ মুহূর্তে, মানে মারা যাবার আগে স্যার ক্লড কী মনে করে সিন্দুকটা খুলে দেখলেন, খাম নেই। যখন তখন সিন্দুক খোলা ওঁর অভ্যাস ছিল না। অথচ সে রাতে….. জানি না। কেন।
-কিন্তু… কিন্তু, পোয়ারো জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন–এসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?
কেন নয়? আপনি আমার পরম সুহৃদ, সহানুভূতিশীল নির্ভেজাল ভদ্রলোক, রেনরের ঠোঁটে কৃতিত্বের হাসি বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার মতো মানুষদের সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এ হল এক ব্যর্থতাকে সাফল্যে পরিণত করার প্রয়াস মাত্র, অবশেষে সফলতা পেয়েছি। এর জন্য আমি আনন্দিত ও গর্বিত। ভেবে দেখুন, জিনিসটা লুকিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু ভাবনা চিন্তা করার মতো সময় নেই। পলকের মধ্যে জায়গাটা বের করলাম, মাথায় কতখানি বুদ্ধি থাকলে তবেই এমনটি সম্ভব বলুন। যাই বলুন না কেন মঁসিয়ে পোয়ারো, নিজেকেই নিজে বাহবা দিচ্ছি। যাক, ওসব কথা, এবার ওই খোয়া যাওয়া ফর্মুলাটার হদিস আপনাকে দিতে হবে, তাই তো।
কিন্তু পোয়ারো তখন আর স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখতে পারছেন না, মাথা সোজা রেখে বসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন কই। ঝিমিয়ে পড়ছেন, কথাগুলো মুখের ভেতরেই রয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু বেরোচ্ছে, কিন্তু স্পষ্ট নয়।
তাও কোনোরকমে বললেন –মঁসিয়ে রেনর, কী হল বলুন তো? বুঝতে পারছি না।
কী যে করি, তাও মাথায় আসছে না।
আপনার কিছু করার নেই, মঁসিয়ে রেনর, সত্যি বলছি। রেনরের ঠোঁটে শেয়ালের ধূর্ত হাসি খেলে গেল। গোড়াতেই আপনি একটা ছোট ভুল করেছিলেন। আমার বুদ্ধিকে আমল না দেওয়ার ভুল। এ পর্যন্ত আমার বুদ্ধিকে সর্বদা নস্যাৎ করে দিয়েছেন আপনি। সকলের সন্দেহের নজর গিয়ে পড়ল ওই ছাঁচড়া ইটালিয়ানটার ওপর–যার চাল নেই, চুলো নেই। পেটের ধান্দায় যে একে-ওকে ব্ল্যাকমেল করে বেড়ায়। ওই জোচ্চোরটাই যে এ বাড়িতে ঢুকেছিল ফর্মুলা চুরি করতে, আর ওই স্যার ক্লডকে খুন করেছে এ ভাবনা আপনার মতো বুদ্ধিমান লোকের মাথায় কী করে এল, ভেবে হাসি পাচ্ছে। দূর, দূর, আপনাকে এসব কথা বললে কী হবে, কানে তো কিছুই যাচ্ছে না। মশাই, আমি বড়ো গাছে নৌকা বাঁধতে ভালোবাসি। ছোট্ট একটুকরো কাগজ, অথচ কত মূল্যবান। নেবার জন্য খদ্দেরটা বসে আছে। পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার পাউন্ড অনায়াসে পকেটে আসবে। অত অর্থ! কী করব বলুন তো? ধারণা করতে পারেন?