পোয়ারো এবার নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়ালেন। রেনর উঠতে গিয়ে বাধা পেলেন। পোয়ারো তাকে ওইখানে বসে থাকতে বললেন হাত নেড়ে। তারপর টু শব্দটি না করে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাউকে কিছু টের পেতে না দিয়ে দরজার হাতল ধরে হ্যাঁচকা টান মারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলেন–কিন্তু, কে কোথায়? সব ফাঁকা।
পোয়ারো বিড়বিড় করলেন ভোজবাজি আর কী!
হতাশার চাউনি মেলে এদিক ওদিক তাকালেন। তিনি আবার যথারীতি ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজার পাল্লা ভেজিয়ে দিলেন।
চেয়ারে বসতে বসতে বললেন–সত্যি বলছি, কার যেন হাঁফের অওয়াজ কানে এল, বিশ্বাস করুন, দরজার বাইরেই সে দাঁড়িয়েছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। দেখছি, আমার নিজেরই শোনার ভুল। তবে আমরা, গোয়েন্দারা, এই ধরনের ভুল শোনার ঘটনাকেই একটা বড় ঘটনা হিসাবে গণ্য করি।
–পোয়ারো কথা শেষ করে গ্লাসে আবার চুমুক দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্লাস ফাঁকা।
-আঃ, কী আরাম সত্যি স্বস্তি হল।
–মাফ করবেন মঁসিয়ে রেনর, স্বস্তি হল বললেন কেন বলুন তো?
–না না, তেমন কিছু নয়, বাইরে সন্দেহজনক কাউকে খুঁজে পেলেন না, ফলে মন থেকে দুশ্চিন্তার একটা পাথর সরে গেল, তাই স্বস্তি হল আর কী।
–সত্যি বলতে দোষ কী, বলুন মঁসিয়ে রেনর। হুইস্কি শূন্য গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন আপনারা মানে ইংরেজরা হুইস্কিই বেশি পছন্দ করেন, বলা হয় এই আপনাদের জাতীয় পানীয়। কিন্তু আমি? চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেশ কতগুলো বছর আগে, সেই থেকে লন্ডনেই বসবাস, অথচ-এখনও পর্যন্ত হুইস্কিকে আমার বন্ধু বলে জানতে পারলাম কই? এর কারণ আমার জানা নেই। তার ওপর আপনার বানানো এই তরল পানীয় একেবারে তেতো বিষ বুঝতে পারছি না হুইস্কিটা তেতো লাগল কেন?
-তেতো! রেনর বিস্ময় ভরা কণ্ঠে জানতে চাইলেন, আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন। তারপর তাকিয়ে রইলেন পোয়ারোর দিকে, প্রখর সে দৃষ্টি। বললেন–কিন্তু আমিও তো একই ড্রিংস নিলাম। আমার ছিটেফোঁটাও তেতো লাগল না। ছাড়ুন ওসব, কাজের কথায় আসুন, তখন কী যেন বলতে বলতে থেমে গেলেন, মনে পড়ছে?
-বলেছিলাম বুঝি। পোয়ারো অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–ব্যাপারটা মনে পড়ছে না, মঁসিয়ে রেনর। সত্যি, এই সামান্য সময়ের মধ্যে বুঝি আসল কথাটাই ভুলে গেলেন। মনে হচ্ছে, কোনো এক সময় একটা রহস্য সমাধান করতে কীভাবে তদন্ত করেছিলাম, সেই গল্পই বোধহয় আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম। অপরাধীর বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ পেলেই হল। তারপর সব প্রমাণ গুলি একটা অন্যটার হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। এভাবেই রহস্য সমাধানের পথ হয় প্রশস্ত। এরপরে যা হাতে আসে, তা আগের প্রমাণের চেয়ে তুচ্ছ, নগণ্য। অন্যদের সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে বড় বড় প্রমাণ সাজিয়ে গুছিয়ে যে শেকল তৈরি করা হল, তা গেল কেটে। তাই বলে আমরা কি তদন্তের কাজ থামিয়ে দেব? আবার নতুন করে শুরু হয় অনুসন্ধানের কাজ, খানা-তল্লাসি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যে প্রমাণ নগণ্য বলে সরিয়ে রাখা হয়, তার মাধ্যমেই মস্ত এক অপরাধমূলক রহস্যের দ্বার খোলার চাবিকাঠি পেয়ে যাই। অদ্ভুত ভঙ্গিতে পোয়ারো মুচকি হাসলেন, নিজের টাক মাথায় টোকা মেরে বললেন–এটা বড় ভয়ঙ্কর আর অতুলনীয়।
–হুঁ, তেমনটিই দেখছি পোয়ারোর কথার গভীরতা বুঝতে না পারায় রেনর বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–আমার মুখের দিকে ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন, মঁসিয়ে রেনর। আচমকা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে রেনরের গালে একটা খোঁচা মারলেন পোয়ারো। রেনর দ্রুত হাতে মুখ ঢাকলেন, চেয়ার থেকে পড়ে যেতে যেতে রক্ষা পেলেন।
যে গোয়েন্দা ছোট খাট ঘটনাকে উড়িয়ে দেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, ওইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেন না, তাদের বরাত অত্যন্ত বাজে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি ওই দলভুক্ত নই। প্রমাণ যত নগণ্য হোক না কেন, রহস্য সমাধানে তারও একটা ভূমিকা আছে মানতেই হবে। ফলে ছোট বড়োর মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সবকিছুর মধ্যেই সামান্য হলেও সত্য লুকোনো আছে, গোয়েন্দাকে তা খুঁজে বের করতে হয়।
পোয়ারো চুপ করলেন, নিজের ঝাঁ-চকচকে টাকে হাত বুলোলেন। তারপর বললেন হ্যাঁ, কী নিয়ে যেন আপনার সঙ্গে কথা বলছিলাম বলুন তো, তুচ্ছ প্রমাণ, তাই না? আমিও আপনাকে এক গুরুত্বহীন তুচ্ছ প্রমাণের কথাই বলছি, তা হল ধুলোময়লা!
-ধুলোময়লা! ব্যাস, আর কিছু নয়? রেনর না বুঝে সামান্য হাসলেন।
–হ্যাঁ, মশাই, তাই। পোয়ারো সামান্য হাসলেন আমার বন্ধু ও সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর কথা বলছি। অত্যন্ত করিত্বৰ্মা মানুষ। সব ব্যাপারে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়াই ওঁর কাজ। ওঁর কথাতেই আমি উপলিব্ধ করলাম, হ্যাঁ, সত্যিই তো, আমি একজন গোয়েন্দা, এ বাড়ির চাকর নই। কথাটা বন্ধুবর কোন উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, জানি না, তবে আমার উপকারে লেগেছে।
আপাতদৃষ্টিতে বাড়ির কাজের লোক, সে চাকর বা ঝি, যাই হোক না কেন, তার কাজ কী? বাড়ির সমস্ত ঘর সাফ করা। ঘরের যেখানে আলো পৌঁছোয় না, ধুলোময়লা ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, সেগুলো ঝাঁটা দিয়ে ঝেটিয়ে পরিষ্কার করে। মঁসিয়ে রেনর, মানছি আমি আপনার থেকে বয়সে বড়ো, কিন্তু শিক্ষা? তাও যথেষ্ট আছে। আপনার সাধারণ জ্ঞানও কিছু কম আছে বলে মনে করি না। আপনিই বলুন, গোয়েন্দাও কি চাকরের মতো কাজ করছেন না?