পোয়ারোর নির্দেশ মাথায় করে ভাঁজ করা কাগজটা হাতে নিয়ে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ঘর থেকে বিদায় নিলেন।
রেনর কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে জানতে চাইলেন–কাগজে কী লিখলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, বলবেন কি?
-কেন নয়? নিশ্চয়ই বলব। স্বস্থানে নোটবই আর পেন্সিল ঢুকিয়ে দিতে দিতে পোয়ারো বললেন ওতে লিখেছি, জ্যাপ, খানিক বাদেই হয়তো স্যার ক্লডের হত্যাকারীর নাম জানতে পারব।
পোয়ারো থামলেন, রেনরের আপাদমস্তক কঠিন দৃষ্টিতে জরিপ করলেন, বোঝা গেল রেনর তার ব্যক্তিত্বের কাছে চুপসে গেছেন।
পোয়ারো রসিয়ে রসিয়ে বললেন– হ্যাঁ, মঁসিয়ে রেনর, মনে হচ্ছে এতদিনে সেই খুশির নাম আমি জানতে পেরেছি। অবশ্য এর জন্য বাহবা দিতে হয় কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাকে। জানেন, লর্ড এডগোঁয়ারের খুনের ঘটনাটাও আচমকাই মনে পড়ে গেল, যা স্যার ক্লডের মৃত্যুর রহস্য সমাধানে আমায় সাহায্য করেছে। লর্ড এডগোঁয়ারকে খুন করে লোকটা পাকাল মাছের মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। আসলে অপরাধী কাজে ছিল অলস, কিন্তু মাথাটা ছিল ধূর্তামিতে ভরা। এই আমি, আমি এরকুল পোয়ারো প্রায় ওর কাছে হারতে বসেছিলাম, শেষ পর্যন্ত জিত আমারই হল। মঁসিয়ে রেনর, আপনি কি জানেন, যাকে আমরা সহজ সরল নিরীহ গোবেচারা বলে মনে করি, সেই ধরনের অপরাধীর সংখ্যা বেশি। অপরাধ করে ভালো মানুষের মতো চুপচাপ এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। সেদিক থেকে বলতে পারি, সার ক্লডের আসল খুনি বলে আমার সন্দেহ, সেও বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান। তবে নিজের ওপর অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস। এর তাড়নায় সর্বদা অস্থির থাকে। কী করব, কী করব, এমন একটা ভাব। হাতের কাছে কাজ না পেলে, লিলিফুলের ছবি আঁকতে বসে যায়।
পোয়ারো থামলেন। তিনি কৌতুক ও আনন্দ বোধ করলেন, কিন্তু প্রকাশ করলেন না, কেবল তা ধরা পড়ল তার বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখে।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, রেনর সামান্য এগিয়ে এলেন, ফিসফিসিয়ে বললেন, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না। তাহলে কী মিসেস লুসিয়া অ্যামরি তার শ্বশুরকে খুন করেন নি?
-একদমই নয়, পোয়ারো হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন–আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাছাড়া ইন্সপেক্টার জ্যাপকে ওই কাগজে লিখে জানিয়েছি, মিসেস লুসিয়া স্যার ক্লডের খুশি নন। ভদ্রমহিলার অতীত আমার অজানা নয়। বহু দুঃখ কষ্ট সয়েছেন। তাই অকারণে সন্দেহের বশে ওঁকে হয়রানি করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি না।
-তাহলে কাকে আপনি আসল খুনী বলছেন? কে সে? ভেবেচিন্তে রেনর নিজেই বললেন–হ্যাঁ, আমি হলফ করে বলতে পারি, ওই ইটালিয়ান ডঃ কারোলিই খুনী। কী, ঠিক বলেছি?
পোয়ারো তার উৎসাহের গোড়ায় জল দিয়ে বললেন–দুঃখিত মঁসিয়ে রেনর–আমি একজন গোয়েন্দা, পেশাগত স্বার্থে কিছু কিছু নীতি কঠোর ভাবে পালন করতে হয়। তাই বলছি, ধৈর্য ধরুন, শেষ মুহূর্তে দেখুন না কী হয়। এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করা আমি পছন্দ করছি না।
তারপরেই বিষয়ান্তরে চলে গেলেন। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করলেন কপালের ঘাম মুছলেন আর আপনমনে বলে উঠলেন–কী বিশ্রী গরমরে বাবা, অসহ্য!
সত্যিই গরমটা আজ বেশিই পড়েছে। রেনর ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন–দাঁড়ান, একটু হুইস্কির ব্যবস্থা করি। সঙ্গে সোডা। শরীর ঠাণ্ডা হবে। সবকিছু হাতের সামনেই আছে। কথাটা অবশ্য আমার আগেই বলা উচিত, কী করে ভুল করলাম, লজ্জা করছে। যাক, আমি আসছি।
–আপনার মতো দরাজ মনের মানুষরাই তো খাওয়াতে চান। যান, আমার আপত্তি নেই।
-বেশি সময় নেব না, এই এলাম বলে।
রেনর দ্রুত পায়ে স্টাডিতে অদৃশ্য হলে পোয়ারো দুলকি চালে পায়ে পায়ে চলে এলেন খোলা জানালার সামনে। বাইরের দিকে তাকালেন, কী যেন চিন্তা করলেন, কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। আবার ধীরপায়ে চলে এলেন সোফার পাশে, গদিগুলো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপরেই ম্যান্টলপিসের সামনে এসে পড়লেন, এক পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দুটো অ্যান্টিক। তিনি হাতে তুলে নিলেন, বেশ দামি, খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
এমন সময় রেনর দুই গ্লাস হুইস্কি ট্রে-তে সাজিয়ে স্টাডির দরজায় এসে দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন পোয়ারো কী যেন মন দিয়ে পরীক্ষা করছেন। তিনি পোয়ারোর কাছাকাছি এলেন, অবশ্য তফাত বজায় রেখে।
–এটা বেশ দামি, তাই না? পোয়ারো ঘর সাজাবার একটা জগ হাতে তুলে নিলেন, খুব সেকেলে বলে মনে হচ্ছে।
–আপনার তাই মনে হচ্ছে? রেনর জবাব দিলেন আসলে কী জানেন, এসব প্রাচীন জিনিস সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আসুন, আমরা পান করি।
রেনর হাতে ধরা ট্রে-টা ছোট টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন।
–অশেষ ধন্যবাদ, মঁসিয়ে রেনর। পোয়ারো চেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন, টেবিল থেকে একটা গ্লাস তুলে নিলেন।
–আপনার শুভেচ্ছা কামনা করি, মঁসিয়ে পোয়ারো। রেনর অন্য গ্লাসটা হাতে নিলেন, কয়েক চুমুকে সবটা শেষ হয়ে গেল।
–আমার তরফ থেকে আপনাকে জানাই শুভেচ্ছা, বন্ধু, ওয়াইনের গ্লাসে হালকা চুমুক দিলেন, বললেন–হ্যাঁ, তখন যেন আপনি কী জানতে চাইছিলেন? আমি কাকে খুনি হিসাবে সন্দেহ করছি, তার কথা, তাই না? হঠাৎই আমার অন্তদৃষ্টি খুলে গেল জানেন, আমি উপলব্ধি করলাম যে
এই পর্যন্ত বলে কথা থামিয়ে দিয়ে পোয়ারো মাথাটা সামান্য ঝাঁকুনি দিলেন, ঘাড় তুলে কী যেন শোনার চেষ্টা করলেন, পরক্ষণে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরলেন। বোঝাতে চাইলেন, ঘরের বাইরে কেউ পাত পেতেছে, অতএব চুপ।