পোয়ারো ধীরে ধীরে ম্যান্টলপিসের কাছ থেকে সরে এলেন।
হেস্টিংস আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে এসে দাঁড়ালেন পোয়ারোর সামনে কী ব্যাপার? তুমি হঠাৎ সামনে–কী ব্যাপার? তুমি হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে কেন? ওই ফুলদানির মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?
পোয়ারো নীরবে ফুলদানিটা হাতে নিয়ে সোফার কাছে চলে এলেন, ফুলদানি উপুড় করে দিলেন। যত কাগজের কুচি ছিল, সব টেনে সোফার ওপর ছড়িয়ে দিলেন। এবার প্রত্যেকটা কাগজের টুকরো টান টান করলেন। তারপর তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে তুলে হেস্টিংস-এর হাতে দিতে দিতে বললেন–ধরো, এই নাও আর একটা, হ্যাঁ এই যে আর একটা…..
হেস্টিংস অবাক হয়ে মেলে ধরা কাগজগুলোর দিকে নজর দিলেন, সংক্ষেপে কিছু লেখা সাংকেতিক ভাষা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। উচ্চারণ করলেন–সি-১৯, এন-২৩, এইচ-২……….. এগুলো কী?
এখনও বুঝলে না? পোয়ারো জোর গলায় বলে উঠলেন–এগুলো স্যার ক্লডের হারিয়ে যাওয়া ফর্মুলার কাগজের টুকরো।
সাবাস পোয়ারো, খুশির দাপটে হেস্টিংস প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
–আরে কী করছ! সামলে, দেওয়ালেরও যে কান আছে, ভুলে গেলে? যাক, শেষ পর্যন্ত হদিস মিলল, খানিকটা হাল্কা হলাম এবার কেবল……… হেস্টিংস, দাঁড়িয়ে না থেকে কাগজগুলোকে চটপট যেমন দোমড়ানো মোচড়ানো ছিল, তেমনটি করে ফেলল। তাড়াতাড়ি ফুলদানির মধ্যে ভরে আগের জায়গায় রেখে এসো।
পোয়ারোর নির্দেশ মতো হেস্টিংস কাজ শুরু করলেন।
-আঃ হেস্টিংস, কী হচ্ছে? অত ঢিলেঢালা হলে চলবে না। হাত চালাও, হাত চালাও। আসলে তোমার মনটা যে এখন এদিকে নেই, বুঝতে পারছি, ফিক করে হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে বাগানের বাইরেটা দেখিয়ে দিলেন কিছুই অজানা নেই, বন্ধু।
এবার বন্ধুর সাথে পোয়ারোও হাত লাগালেন। দুজনে মিলে ঝটপট সমস্ত কুচানো কাগজ ফুলদানির মধ্যে ভরে ফেললেন। সেটাকে এবার ম্যান্টেলপিসের ওপর রাখলেন, অবশ্য দাঁড় করিয়ে নয়, কাত করে, যেমনটি ছিল আর কী!
হলো একটা বড়ো কাজ! পোয়ারো হাঁফ ছাড়লেন, এবার বলো তো, ওখানে কী রেখে এলাম?
–কী আবার, কুচানো কাগজ আর মোমের টুকরো। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন হেস্টিংস।
উঁহু, হলো না, পোয়ারো সামান্য হাসলেন, খানিকটা পনির, বুঝলে, পনির রেখে এলাম।
–মানে!
–হ্যাঁ, বন্ধু, কেবল পনির।
-কী সব অবোল-তাবোল বকছ, হেস্টিংস অবাক হলেন, তোমার মাথা বিগড়ে গেল নাকি?
পোয়ারো এসব ব্যঙ্গ বিদ্রুপে কান না দিয়ে নিজের মনে বলে চললেন, পনির আমরা খাই, এছাড়া গৃহস্থের আর কোন কাজে লাগে, জানো? একটু থামলেন, ইঁদুর ধরার কাজে। ইঁদুর ধরার ফলে সামান্য পৰির রেখে দিলেই হল, লোভে লোভে ইঁদুর এসে ঢুকবে ওই কলে, তখনই কলে টান, ব্যাল বন্ধ, বেরোবার পথ নেই। আমিও তেমনই ফাঁদ পেতেছি, অবশ্য পনির নয়, খাদ্য ওই কাগজ কুচানো। এবার আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না ইঁদুর বাবাজী আসছে ততক্ষণ চুপ করে থাকতে হবে।
কিন্তু ইঁদুর কখন আসবে, তা জানো?
-জানি বৈকি, পনিররূপী ওই কাগজছেঁড়া খেতে তাকে আসতেই হবে, পোয়ারো বললেন, তাকে আসার জন্য খবর পাঠিয়েছি, সবুর করতে হবে না তোমায়। ওই এল বুঝি!
ঠিক এসময় বসার ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে গেল। ভেতরে পা রাখল এডওয়ার্ড রেনর।
-আশ্চর্য, আপনারা এখানে বসে আছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। দিব্যি গল্পগুজব করছেন, আর ইন্সপেক্টার জ্যাপ আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। উনি ওপরে আছেন, আমাকে পাঠালেন। চলুন, এক্ষুনি ডাকছেন।
এডওয়ার্ড রেনর চিৎকার করে কথাগুলো বলল।
.
১৪.
-ইস, কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো, পোয়ারো মোলায়েম সুরে বলতে থাকলেন, ইন্সপেক্টার জ্যাপ আমাদের জন্য সারা বাড়ি তোলপাড় করছেন, আর আমরা কিনা…… চলুন, যাচ্ছি।
ওঁরা তিনজনে দরজার কাছে এলেন। হঠাৎ পোয়ারো ঘাড় ঘুরিয়ে রেনরের কাছে জানতে চাইলেন–ডঃ কারোলির সঙ্গে আজ সকালে কি আপনার দেখা হয়েছে?
নিশ্চয়ই, দেখা হয়েছে, রেনর খুশি মনে জবাব দিলেন–এখানেই ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। উনি টেলিফোন করতে এ ঘরে এসেছিলেন।
–আচ্ছা মি. রেনর, ডঃ কারোলি কি তখন টেলিফোনে কথা বলছিলেন, মানে আমি বলতে চাইছি, ওনাকে ফোন করতে আপনি দেখেছেন কিনা?
-না, মঁসিয়ে পোয়ারো, কী যেন রেনর ভাবলেন, ওনাকে স্যার ক্লডের স্টাডিতে ঢুকতে দেখেছিলাম। আমাকে এঘরে আসতে দেখে উনি বেরিয়ে এসেছিলেন।
কথা বলতে বলতে রেনর ফায়ারপ্লেসের ধারে এসে দাঁড়ালেন।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–আপনি ওই সময় এঘরের কোন অবস্থানে ছিলেন?
–আমি? এখানে, যেখানে এখন দেখছেন, সেখানেই আমার অবস্থান ছিল।
–টেলিফোনে ডঃ কারোলির কোনো কথা শুনতে পেয়েছিলেন কি?
–না, ঘাড় নাড়লেন রেনর। উনি যে আমার সামনে কথা বলতে চান না, সেটা বুঝেই আমি সরে এসে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
-বুঝলাম। কী মনে করে পোয়ারো পকেট থেকে তার ছোট্ট নোট বই আর পেন্সিল বের করলেন। খসখস করে কী সব লিখলেন। উপস্থিত দু’জনের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। পাতাটা ছিঁড়ে ভাঁজ করে হেস্টিংস-এর হাতে দিলেন, বললেন হেস্টিংস, তুমি এটা নিয়ে ইন্সপেক্টার জ্যাপের হাতে দাও। তাকে বলল, আমি না যাওয়া পর্যন্ত যেন ঠাণ্ডা হয়ে থাকেন। খানিক বাদেই আমি যাচ্ছি।