পোয়ারো পিঠ টান করলেন, মনের ভেতর জড়ো করা ভাবনাগুলোকে ঝালিয়ে নেবার জন্য তৈরি হলেন। বেশ জোরালো গলায় বললেন–এপর্যন্ত যা যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি করছি, মন দিয়ে শোনো। সেদিন ওই সময় ঘটনাক্রমে স্যার ক্লড তাঁর স্টাডিতে ঢুকেছিলেন। সিন্দুকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার মনে কেমন খটকা হল। তিনি সিন্দুক খুললেন। দেখলেন কয়েকদিন আগে পুরে রাখা ফর্মুলা সমেত খামটা নেই। তার মানে কে হাতিয়ে নিয়েছে। স্যার ক্লডের ধারণা, যে ফর্মুলা চুরি করেছে, সে এই বাড়ি ছেড়ে এখনও বেরোতে পারেনি, তিনি সকলকে শুনিয়ে কথাও বলেছিলেন যে, এই ঘরটা হল ইঁদুর ধরা ফাঁদ, ফর্মুলা চোর অন্যন্যদের সঙ্গে সেই ফাঁদেই আটকে আছে। এসব কথা অবশ্য তাঁর মুখ থেকে আমি শুনিনি। জেনেছি বাড়ির সদস্যদের কাছ থেকে। সত্যি ভায়া এই বসার ঘরটা ইঁদুর ধরার একটা ফাঁদ, মোক্ষম তুলনা। এমনকি তার খুনি সেই ফর্মুলা চোর এমন কিছু জানতো, যা স্যার ক্লডের কল্পনার বাইরে ছিল। ফর্মুলা চোর পুরুষ অথবা মহিলা, যে কেউ হতে পারে। এবার তার একটাই কাজ–ফর্মুলাটাকে সকলের চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা। কিন্তু তা সম্ভব কী ভাবে? সার ক্লড যখন বললেন, সমস্ত আলো নিভিয়ে বসার ঘরকে অন্ধকার করে দেওয়া হবে, চোর যেন ফর্মুলাটা ফিরিয়ে দেয়। ফর্মুলা চোর ঠিক করল, এই সুযোগটাই গ্রহণ করবে। আঁধারের মধ্যে এমন কোনো জায়গায় ওটা লুকিয়ে রাখবে যা কেউ খুঁজে পাবে না।
পোয়ারো তাকালেন তার সহকারীর দিকে হেস্টিংস, মিস ক্যারোলিন যেমন চোখ বুজে জবাব দিয়েছিলেন, তুমিও তেমনই চোখ বোজো। আমিও বন্ধ করলাম আমার চোখ। ঠিক আছে? এবার কী দেখছ? কিছু না, তাই তো, কেবল চাপ-চাপ অন্ধকার ছাড়া কিছুই নয়। গতরাতের মতো এই মুহূর্তেও নিভে গেছে ঘরের প্রতিটি আলো। আমাদের চোখ বন্ধ, কিন্তু কান খোলা। মিস ক্যারোলিন আমার প্রশ্নের জবাবে যেসব অওয়াজের বর্ণনা দিয়েছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই, সেগুলো ফের তুমি আমায় শোনাও, কোনোটা বাদ যেন না পড়ে।
ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দুটি চোখের পাতা একটির সঙ্গে আর একটি লেপটে আছে। তিনি তখন গভীরভাবে চিন্তা করছেন। তারপর কেটে কেটে জবাব দিলেন–হাঁফানোর আওয়াজ শোনা গেল, কেউ বুঝি হাঁফাচ্ছে।
-বাঃ, দারুণ বলেছ। এরপর? দ্বিতীয় শব্দটা কীসের ছিল?
হেস্টিংস আবার চুপ। পরক্ষণে মাথা নেড়ে বললেন হা, চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাতব আওয়াজ। মেঝেতে ছোট জিনিসটা ছিটকে পড়েছে বুঝি। আওয়াজটা মেঝেতে চাবি পড়ার আওয়াজের মতোই।
ঠিকই বলেছ, ওটা চাবিরই আওয়াজ ছিল। মিস ক্যারোলিন আর কোন শব্দের কথা বলেছিলেন, বলো।
-এরপর একটা আর্তনাদ শোনা গেল, পরে জানতে পেরেছি, ওটা লুসিয়ার আর্তনাদ, শ্বশুর স্যার ক্লডকে কী যেন বলতে চেয়েছিল। তারপর টোকার আওয়াজ, দরজার বাইরে থেকে। দুঃখিত! প্রথম দিকে মিস ক্যারোলিন ঘরের ভেতর কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ পেয়েছিলেন, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বুঝি রেশমি কাপড় কেউ ছিঁড়ছে, অবিকল তেমনই আওয়াজ।
হেসিটংস-এর বলা শেষ, তিনি চোখ খুললেন।
পোয়ারো খুশি– হ্যাঁ, নির্ভুলভাবেই বলেছ, কথা শেষ করে তিনি পায়ে পায়ে ডেস্কের গা ঘেঁষে ফায়ারপ্লেসের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিড়বিড়িয়ে বললেন–ওই যে কয়েক মিনিটের আঁধার স্যার ক্লড মারা যাবার আগে তৈরি করেছিলেন, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি হেস্টিংস, ওই ছোট্ট সময়টুকুর মধ্যেই ফর্মুলা চুরি রহস্যের সমাধানের পথ লুকিয়ে আছে। তবু ঘরের ভেতর আর যাঁরা ছিলেন তারা কিছুই শুনতে পাননি।
হেস্টিংস ঘুরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে। দেখলেন, আগুন ধরানোর সুবিধার জন্য কাগজের কুচি আর মোমের খণ্ড খুঁজে রাখা যে বড় ফুলদানিটা ম্যান্টলপিসের ওপর দাঁড় করানো ছিল, সেটা কাত হয়ে একপাশে পড়ে আছে দেখে পোয়ারো যত্নে সেটাকে আগের জায়গায় দাঁড় করিয়েছিলেন।
–ওহ্, তোমার স্বভাব একটুও পাল্টাল না, বন্ধু। হেসিটংস-এর গলায় ভর্ৎসনার সুর।–থাকনা ওটা যেখানে খুশি পড়ে, সামান্য একটা জিনিস, তা নিয়েও মাথা ঘামানোর কী আছে যে বুঝি না। শুধু
হেস্টিংসের কথাগুলো থেমে গেল, পোয়ারোর অস্বাভাবিক তীব্র চাউনি তাকে ভীত করল।
-সামান্য, তাই না? পোয়ারো তাকালেন ফুলদানিটার দিকে, পলকহীন দৃষ্টি, বলে চললেন–আমার খুব ভালোভাবেই মনে আছে, এখানে একটা আওয়াজ হচ্ছিল, প্রায় এক ঘণ্টা আগে, শুনে মনে হয়েছিল, এই ফুলদানির ভেতরের দোমড়ানো কাগজের কুচিগুলো কেউ যেন মুচড়ে সোজা করছে। তাতে ওদের যা হাল হয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো ধরে ধরে দুমড়ে মুচড়ে আবার আগের মতো টান টান করে দিই। পোয়ারোর কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা গেল, তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।–আচ্ছা, বলোত, এ কাজটা করার ইচ্ছা আমার হল কেন?
-কেন আবার! কাগজগুলো দুমড়ে মুচড়ে আছে, তাই। হেস্টিংস কণ্ঠে সামান্য বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, তোমার যা পিটপিটানি স্বভাব, সব কিছু ঝকঝকে তকতকে না দেখলে চোখে ভালো লাগে না–এটা তারই একটা ছোট্ট উদাহরণ। রেশমি কাপড় ঘেঁড়ার আওয়াজ, না? উল্লাসে ফেটে পড়লেন পোয়ারো। ওটা আসলে কাগজ কুচানোর আওয়াজ। অন্ধকার ঘরে সে রাতে কাগজ ছেঁড়া হয়েছিল, রেশমি কাপড় নয়, অবশ্য দুটো আওয়াজ হুবহু একরকম। কাগজ কুচিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি ম্যান্টলপিস থেকে ফুলদানিটা তুলে নিলেন হেস্টিংস, আবার বলছি, সে রাতে অন্ধকারের মধ্যে মিস ক্যারোলিন অ্যামরি কাগজ ছেঁড়ার আওয়াজই শুনেছিলেন, কাপড় নয়।