ক্যারোলিন লাইব্রেরি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখলেন।
উফ, কি মতলববাজ মহিলা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিচার্ড ঘরের দরজা বন্ধ করে এগিয়ে এল। লুসিয়ার পিঠের ওপর হেলান দিয়ে বসল। বলল–পিসিমা খুব জ্বালাচ্ছিলেন, তাই না, লুসিয়া?
রিচার্ড, এই পরিবারে যেদিন আমি বউ হয়ে এসেছি, সেদিন থেকেই লক্ষ্য করেছি, আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা না বললে ওনার শান্তি হয় না। আমি ইটালিয়ান বলে হয়তো আমাকে সহ্য করতে পারেন না। ইটালিয়ানরা কেন যে ওনার দুচোখের বিষ, বুঝে পাই না।
–এসব হল হিংসা, জ্বালা, বুঝেছ লুসিয়া। সামান্য হেসে রিচার্ড বলতে থাকে, অনেক মহিলা আছে, যাদের বিয়ে হয়নি, সে আশাও নেই, কমবয়সী বিবাহিত মেয়েদের দেখলে তাদের গা রি-রি করে জ্বলে–ঈর্ষায়। পিসিমার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে গেছে। আর একটা কারণ হতে পারে, ছোটবেলায় আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আমার পিসি এসে এই সংসারের হাল ধরেছিলেন। তিনিই এ বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী। তুমি আসার পর থেকে তার মনে সম্ভবত একটা আশঙ্কা সর্বদা তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
–এই বোধ হয় গদিচ্যুত হলাম।
রিচার্ড একটু থামল, আবার বলতে শুরু করল–তবে আমি নিশ্চিত, পিসিমার চটে যাওয়ার পেছনে অন্য আর কারণ আছে। পিসিমাকে একবার ইটালিতে যেতে হয়েছিল লিওনার্ডো ডা ভিসির ওপর গবেষণামূলক কাজ করতে। ওইসব এক ইটালিয়ান গাইডের প্রেমে পড়েন, লোকটি তার থেকে বয়সে অনেক ছোট ছিল। প্রেম পেকে যখন রসপূর্ণ হয়েছে, ঠিক সেই সময় তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। মনমরা হয়ে পিসিমা ফিরে এসেছিলেন। এসব মা-ই শুনিয়ে ছিলেন।
রিচার্ড আবার থামল, দম নিল। আবার শুরু করল–আমারও নিজের ওপর কম রাগ হয়, লুসিয়া বাবার কথা মেনে চাকরিতে স্বেচ্ছা অবসর দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বাবার ইচ্ছানুযায়ী তার গবেষণার কাজে সাহায্য করতে শুরু করলাম। ভাবলাম, এর ফলে আর্থিক দিক থেকে উন্নতি ঘটবে। কিন্তু এখন দেখছি সব ভুল, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার নিজস্ব পরিচয় বলতে কিছু নেই। না আমি এক ফৌজী ইঞ্জিনিয়ার, না আছে বাবার মতো বৈজ্ঞানিক প্রতিভা, গবেষণার কাজে এক্কেবারে অনুপযুক্ত।
কথা শেষ করে রিচার্ড স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এল। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। চার চোখের মিলন ঘটে গেল।
লুসিয়া, বল, কিভাবে তোমায় সাহায্য করি? কিছু প্রয়োজন? আমি এখন তোমার কাছেই থাকব।
-তাই বুঝি! লুসিয়ার ঠোঁটে কাষ্টহাসি। কিন্তু রিচার্ড, ডিনার টেবিল থেকে খাওয়া ফেলে চলে আসা বাবার অপছন্দ, পিসিমাকে স্মরণ করিয়ে দিলে, অথচ তুমি নিজের বেলায় ভুলে গেলে? যাও, ডিনার হলে গিয়ে খাওয়া শেষ করে নাও।
আমি খাওয়া সেরেই এসেছি তোমার কাছে, কিছুক্ষণ গল্প করব। রিচার্ড মুচকি হেসে বলল–ওভাবে না বললে পিসিমাকে এ ঘর থেকে নড়ানো যেত?
–কিন্তু রিচার্ড, লুসিয়া আলগোছে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরল, আমি যে একা থাকতে চাই, তাই এঘরে চলে এসেছি। আমার শরীরের কথা ভেব না, ভাল আছি, বিশ্বাস কর।
লুসিয়ার মাথার পাশের ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটা খোলার জন্য রিচার্ড এগিয়ে এল, জানলা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হল। ঘেমে নেয়ে একশা। শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে, ফিরে এল স্বস্থানে–ধু! এ যেমন-তেমন ছিটকিনি নয়। তারপর চুপ। ভাবনার আলোড়ন-বুঝেছি, নিরাপত্তার কারণে বাবা বিশেষ ছিটকিনির ব্যবস্থা করেছেন, চাবিটা নিজের কাছেই রেখেছেন।
লুসিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল–বাদ দাও, জানলাটা বন্ধই থাক।
রিচার্ড টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। চেয়ার টেনে বসল। টেবিলে কনুই রেখে সামান্য ঝুঁকল–আমার বাবা, আশ্চর্য মানুষ বটে। চব্বিশ ঘণ্টা আবিষ্কারের নেশায় মশগুল। পারমাণবিক অস্ত্র শুরু থেকে নতুন মানের মজবুত ছিটকিনি, আর কি বাকি আছে কে জানে। ভাবনার অন্ত নেই।
-তোমার বাবা কতরকমের আবিষ্কার করেছেন, নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ রোজগারও করেছেন? লুসিয়ার অন্যমনস্ক কণ্ঠস্বর।
–কি বলছ, লুসিয়া! প্রচুর নয়, কাড়ি কাড়ি। কিন্তু টাকা কড়ির প্রতি তেমন লোভ নেই। রিচার্ডের নীরস কণ্ঠস্বর, সবই বিজ্ঞানীরা বোধহয় একই ধাতু দিয়ে গড়া, অর্থ, বিষয় সম্পত্তির প্রতি আসক্তি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক কম। মানুষ যেসব জিনিস অকেজো ভেবে ফেলে দিচ্ছে, বিজ্ঞানীরা সেগুলো কুড়িয়ে কাড়িয়ে নিয়ে আসছেন, সর্বক্ষণ গবেষণা করে চলেছেন।
-তাহলে উনি যে সে মানুষ নয় বল?
নিশ্চয়ই, রিচার্ড জোর গলায় বলে উঠল, আমি আমার বাবাকে বর্তমান বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন বলে মনে করি। তবে ওঁর একটা দোষ আছে–নিজের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দেন। আমার সঙ্গে উনি যে আচরণ করে চলেছেন, আমি তা সহ্য করতে পারছি না। বিরক্ত ধরে গেছে।
–ঠিকই বলেছ, রিচার্ড, লুসিয়া স্বামীকে সমর্থন করল, নয়তো কেউ নিজের ছেলেকে বিনা কারণে বাড়িতে বন্দী রাখতে পারে, যেন জেলের কয়েদি।
একথা আগেই তোমায় বলেছি, রিচার্ড বলে চলল–বাবা বললেন চাকরিটা ছেড়ে দিতে। তাঁর গবেষণার কাজে সহযোগিতা করতে। তাহলে শুরু করা কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করা সম্ভব হবে। আর অর্থনৈতিক উন্নতিও ঘটবে আমাদের। রিচার্ড কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি এনে বলে চলল বাবা ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভেবে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। আর এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে। আমি কি ছাই ওইসব মৌলিক গবেষণার কিছু বুঝি। সামান্য এক ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি সূক্ষ্ম ব্যাপারে মাথা ঘামানো কি চাট্টিখানি কথা! তবে একটা রক্ষে, স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছিলাম, মেয়াদ এখনও ফুরোয়নি। চাইলে যে কোন সময় কাজে যোগ দিতে পারি। দরকার পড়লে ওরাও ডাকতে পারে।