পোয়ারো চোখ মেলে ছিলেন খোলা জানলা দিয়ে বাগানের দিকে। দেখো, সন্ধ্যা ও রাতের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে সময়, অন্ধকার চারপাশ। ঠিক গত সন্ধ্যের মতো। আঁধারের কালো কালিমালিপ্ত এই বাড়ি আর তখনই
পোয়ারো চুপ করলেন, সামান্য সময় নিলেন। পরক্ষণে বলতে শুরু করলেন–হ্যাঁ, এই জমাট বাঁধা অন্ধকারই আমাদের আলোর দেশে পৌঁছোতে সাহায্য করবে। হ্যাঁ, হেস্টিংস, এই পথ ধরেই আমরা সফলতার শীর্ষে পৌঁছোতে পারব।
-কী সব হেঁয়ালি করছ বলল তো, হেস্টিংস বললেন, যা বলতে চাইছ বুঝিয়ে বলল, বাপু!
–পোয়ারোর কণ্ঠস্বর হঠাৎ গম্ভীর হল–আচ্ছা বলতে পারো স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যু হল কীভাবে?
এ কি নতুন কথা। স্যার ক্লড কেন মারা গেলেন, তা কারো অজানা নেই। ওঁর শরীর কাটাছেঁড়া করে পোস্টমর্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে মারাত্মক বিষ মেশানো কফিতে ওঁর মৃত্যু হয়েছে, মানে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।
তাতে কারো সন্দেহ নেই, পোয়ারোর বুঝি ধৈৰ্য্য ধরছে না। কিন্তু বলতে পারো, এর কারণ কী? কেন বিষ খাইয়ে খুন করা হল?
সম্ভবত, কথা শেষ না করে মুখ বুঝলেন হেস্টিংস, পোয়ারোর দিকে তাকালেন, ফর্মুলা চোরের মনে কোনো সন্দেহ উঁকি দিয়েছিল, এমনটিও হতে পারে–হেস্টিংস আবার নীরব হলেন।
সহকারীর ব্যাখ্যা শুনে পোয়ারো বুঝি খুশি হলেন, তার ঘাড় নাড়া দেখেই হেস্টিংসের বুঝতে দেরি হল না।
-কিন্তু হেস্টিংস, পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, যদি তোমার ধারণার উল্টোটা হয়ে থাকে, মানে ফর্মুলা চোরের মনে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়নি। এবার তুমি কী বলবে?
–সত্যি কথা বলছি, ভায়া, ক্লান্ত স্বরে হেস্টিংস বললেন, আমার বুদ্ধি-সুদ্ধি সব গোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
পোয়ারো এগিয়ে এলেন, গলা খাঁকানি দিলেন। তারপর বললেন–আচ্ছা বেশ, মগজ খাটাতে হবে না। যা বলছি, শোনো। গত সন্ধ্যায় যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। আমি একের পর এক বলে যাচ্ছি, ভুল হলে ধরিয়ে দিও, কেমন!
ক্যাপ্টেন হেস্টিংস কোনো সাড়া না দিয়ে চেয়ারের ওপর ক্লান্ত শরীরটাকে বসিয়ে দিলেন।
পোয়ারো শুরু করলেন–মারা যাবার খানিক আগে স্যার ক্লড অ্যামরি তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, বসেছিলেন এই আর্মচেয়ারে, ঘরের একমাত্র আরামকেদারাটিতে নিজে বসলেন। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নীরবতার মধ্যে, বোঝা গেল পোয়ারো এখন স্মৃতির সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন–হ্যাঁ, শেষবারের মতো এবং এই চেয়ারে বসেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, তাও ঠিক। তার কয়েক মিনিট পরে পরিবারের সদস্যরা ডিনার সেরে এই ঘরে এসে হাজির হয়েছিলেন, এমনকি ডঃ কারোলিও। স্যার ক্লডের অচেতন দেহটা উনিই প্রথম পরীক্ষা করেছিলেন এবং বলেছিলেন উনি মারা গেছেন, হার্ট অ্যাটাকই এর কারণ। এ ব্যাপারে ডঃ কারোলি নিশ্চিত। এর পরে আসেন অ্যামরি পরিবারের চিকিৎসক। দ্বিতীয়বার স্যার ক্লডকে পরীক্ষা করে ডঃ গ্রাহাম জানিয়ে ছিলেন, ওনার হার্ট অত্যন্ত ভালো ছিল। তাঁর কথায়, হার্টফেল নয়, অন্য কোনো কারণ। সেটা কী? উনি খুঁজে না পাওয়ায় ডেথ সার্টিফিকেট দিতে রাজি হননি। তিনিই করোনারের কাছে আবেদন করে স্যার ক্লডের মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মর্গে ডাক্তাররা মৃতদেহের পেট চেরাই করে কফির নমুনা সংগ্রহ করেন। তা ল্যাবোরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়, দেখা যায় ওই কফির সঙ্গে হিসকোসিন হাইড্রোব্রোমাইড নামক মারাত্মক বিষ মিশে আছে। অর্থাৎ স্যার ক্লডকে কফির সঙ্গে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি একটি খুনের মামলায় পরিণত হল। সম্ভবত স্যার ক্লড অ্যামরির শবদেহ সৎকারের কাজটি দু-একদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। তারপরেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে গোয়েন্দারা আসবেন। এবাড়ির প্রতিটি কোণ খুঁজে বেড়াবেন। খানাতল্লাশি চালিয়ে স্যার ক্লডের ব্যক্তিগত কাগজপত্র, ডায়েরি যেখানে যা পাবেন সব নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেবেন। এমনকি তার শেষ উইলটিও বাজেয়াপ্ত হবে। সমস্ত কাগজপত্রের প্রত্যেকটা তারা শ্যেন দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। অবশেষে তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে আসবেন। পোয়ারো আড়চোখে তাকালেন সহকারীর দিকে বলো তো, সেটা কী? আন্দাজ করো।
হেস্টিংস চুপ। পোয়ারো আবার বলতে শুরু করলেন–সিদ্ধান্ত হল এই যে, স্যার ক্লড যে ফর্মুলা তৈরি করেছেন বলে চারদিকে চাউর হয়ে গেছে, কোনো এক রাষ্ট্রের টাকার গোলাম হয়ে ডঃ কারোলির মতো জঘন্য অপরাধী যা চুরি করতে এখানে এসে জুটেছিলেন, সেই মহামূল্যবান ফর্মুলার নোটগুলো এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়েছে অর্থাৎ পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি। এই সম্ভাবনাকে ধরে নিয়ে একটা প্রশ্ন জোরালো ভাবে দেখা দেবে, তা হল স্যার ক্লড ফর্মুলা তৈরির কাজ আদৌ শেষ করতে পেরেছিলেন কিনা! চোরের মস্ত এক সুবিধা হবে। সেটা কী?
পোয়ারো থামলেন, ঝেকে আক্রান্ত, আপনমনে বলে চললেন–সেটা হল নিরাপত্তা। ফর্মুলা চোর নিজেকে নিরাপদ ভাববে। সন্দেহভরা চোখ তার দিকে আর তাকাবে না। সে এবার নিশ্চিন্তে তার বাকি কাজটুকু গুছিয়ে নেবে। অসম্পূর্ণ হলেও স্যার ক্লডের স্টাডির সিন্দুক থেকে ফর্মুলা চুরি করে সেটা জুতসই জায়গায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। যে জায়গার দিকে কেউ কোনোদিন ফিরে তাকায় না, খোঁজার প্রশ্নই ওঠে না। এবার চোর বামাল সমেত পালাবার জন্য সুযোগ খুঁজবে। সকলের চোখে ধুলো দিয়ে চো চো দৌড়, সোজা গিয়ে হাজির হবে তাদের কাছে, যাদের কাছ থেকে সে টাকা খেয়েছে। এইভাবে এই মূল্যবান ফর্মুলা চলে যাবে অন্য এক হাতে। তার গ্যাড়াকলের কলটা যে এভাবে নড়বড়ে হয়ে যাবে, বাছাধন তা কল্পনাও করতে পারিনি।