–হুঁ, আমিও বুঝতে পারছি, অত সহজে ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢুকবে না। পোয়ারো বুঝি আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন। বললেন, আপনি এক কাজ করুন, আপনার যা দেখার বা বোঝার, সব আমার ওপর সম্পূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিন, আমি এরকুলো পোয়ারো, আমি সে দায়িত্ব নিলাম। আপনি কেবল, আমার কথা মতো কাজ শুরু করে দিন।
পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন রিচার্ডের কাঁধে হাত রাখলেন–যান, আর দেরি নয়, নিজের ঘরে গিয়ে গোছগাছ সেরে নিন। মনে মনে ভাববেন, কিছু দিনের জন্য বাইরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন। রিচার্ডের কাঁধে ছোট্ট চাপড় মেরে পোয়ারো আবার বললেন জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার কাজটা নিজে পেরে না উঠলে, রেনর তো আছেন, তাকে লাগিয়ে দেবেন। যান, যান, সময় অযথা নষ্ট না করে ঝাঁপিয়ে পড়ুন কাজে। আসুন, আপনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয় দিই।
রিচার্ডকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে পোয়ারো তাকে, দরজার সামনে নিয়ে এলেন। রিচার্ড বুঝি মূক হয়ে গেছে, কেবল তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দুটি চোখ একবার পোয়ারোকে দেখল, তারপর ঘুরে গেল ওপরে যাবার সিঁড়িপথের দিকে।
-বাপরে বাপ! কী ঠ্যাটা! ইংরেজ জাতটাই এমন। পোয়ারো মনে মনে আক্ষেপ করলেন। এবার এগিয়ে এলেন খোলা জানলার কাছে। বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলেন, কাউকে দেখতে পেলেন না, দেখা সম্ভবও নয়। ঝোপঝাড় লক্ষ্য করে পোয়ারো জোর গলায় হাঁক দিলেন মাদমোয়াজেল বারবারা, আপনি কোথায়? আমার বন্ধুটিকে কোথায় সরালেন? কম তো সময় নিলেন না, এবার সামনে আসুন, আপনার শ্রীমুখ দর্শন করি।
–ওফ, বুড়োটা গলা ফাটিয়ে কেমন চিল্লাচ্ছে দেখ। একটা বড় ঝোঁপের তলা থেকে বারবারা বেরিয়ে এল। খেঁকিয়ে জানতে চাইল, কী হল? অত হাঁকডাক কেন শুনি? আপনার বন্ধুকে নিয়ে আমি পালিয়ে গেছি? একটু গল্প করছি, সেটাও অসহ্য লাগছে। আপনাদের যা জবাবদিহির পালা চলল, মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। তাই খোলামেলাতে এসে দুজনে বসেছি, গল্প করছি। এতে আপনার আপত্তি কীসের?
–আমায় ভুল বুঝবেন না মাদাম, পোয়ারো মনে মনে একচোট হেসে নিলেন, বললেন, দুঃখিত। বাধ্য হয়ে এভাবে আপনাকে বিরক্ত করছি। গল্প করবেন বলে যাকে টানতে টানতে বাগানে নিয়ে গেলেন, তিনি যে আমার সহকারী, তা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। আমাকে সাহায্য করার জন্যই ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে আমি সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছি। এবার দয়া করে অল্পক্ষণের জন্য তাকে ছেড়ে দিন, মাদমোয়াজেল, বড্ড উপকার হয়, কথা দিচ্ছি, কাজ সেরেই ও ফিরে যাবে আপনার কাছে।
-ও, মতলবটা বুঝলাম। তা আমার বন্ধুটিকে কেড়ে না-নিলে আপনার মন ভরছেনা, তাই না? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল বারবারা।
-ভুল বললেন, কেড়ে নিচ্ছিনা। কয়েকটা দরকারী কথা আছে। তারপরেই ওঁকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।
–বেশ, আপনি যেমনটি চাইছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বড় বড় পা ফেলে বারবারা ঝোঁপের কাছে ফিরে এল। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে উঠল। বলল যাও বন্ধু, তোমার তলব পড়েছে। উনি কথা দিয়েছেন, আবার তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন।
–অসংখ্য ধন্যবাদ, মাদমোয়াজেল। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে হেস্টিংস জানলার দিকে তাকালেন। পোয়ারোকে হাত ইশারা করলেন। একটু বাদেই খোলা জানলা ডিঙিয়ে তিনি পোয়ারোর সামনে এসে দাঁড়ালেন লাজুক মুখে।
আবার, চাপাগলায় ধমকে উঠলেন পোয়ারো, তোমায় একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশিন্ত হয়েছিলাম, ভাবলাম এই অবসরে মাথাটা অন্য ব্যাপারে লাগাব। কিন্তু তুমি দেখছি, সে দায়িত্ব পালন না করে রিচার্ড অ্যামরির খুড়তুতো বোনের সঙ্গে বাগানে গল্প করতে বসে গেছো?
সত্যি বলছি বন্ধু, তোমার এই পরিবর্তন দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।
-বাঃ, বেশ তো বকাঝকা করছ, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস পাল্টা জবাব দিলেন, মেয়েটা যখন টানতে টানতে আমায় নিয়ে গেল, তুমি তো সামনেই ছিলে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে, অথচ মানা করলে না। পেছন থেকে টেনেও তো ধরতে পারতে। করোনি। আসলে তুমিও বেশ মজা পাচ্ছিলে।
থাক থাক, আর আমায় বুঝিয়ে কাজ নেই। পোয়ারো এবার গলার স্বর নামিয়ে বললেন তোমাকে কেন আমি গাল দিচ্ছি জানো। তোমার-আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কারোলি নাকি এঘরে ঢুকেছিল। শুধু তাই নয়, রেনরও। ওরা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে কীসব কথাবার্তা বলছিল। জ্যাপের মুখে কারোলির আসল পরিচয় শুনেছ নিশ্চয়ই। ভাবছি, আমাদের দেখতে না পেয়ে কারোলি কোনো প্রমাণ নষ্ট করে দিয়েছে কিনা কে জানে।
-মাফ করো, বন্ধু। হেস্টিংস আন্তরিকতার সুরে বললেন–এদিকের কথা কী করে যে ভুলে গেলাম, জানি না। বিশ্বাস করো, অতশত মাথায় আসেনি।
যদি কারোলি কোনো ক্ষতি না করে থাকেন, তাহলে জানবে আমার কপালের জোরেই হয়েছে। কিন্তু ভায়া, আর তো বসে থাকার সময় নেই। ভেতর ভেতরে একটা তাগিদ বোধ করছি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমাদের পা বাড়াতে হবে, বুঝেছ হেস্টিংস।
বন্ধুর গাল টিপে পোয়ারো সোহাগ দেখালেন।
-বেশ, চলো, আমি তৈরি, কাজ শুরু করা যাক।
দাঁড়াও, এক্ষুনি নয়। সাবধানী কণ্ঠে পোয়ারো বললেন আমি যে কাজের কথা বলছি, তার সাথে এতদিন যেসব রহস্য সমাধান করেছি, তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। বলা যেতে পারে এই রহস্য গোড়া থেকেই দুর্বোধ্য, তাই অত্যন্ত খারাপ।