-ইন্সপেক্টার জ্যাপ এ ব্যাপারে আপনাকে সমর্থন করবেন না জানি।
-কী বললেন? জ্যাপ? পোয়ারো সামান্য হেসে বললেন, উনি অবিবেচক নন, এটা যেমন ঠিক, তেমনই উনি যে সেই মহিলা নন, যিনি নিজের স্বামীকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন এটাও তেমন বেঠিক।
পোয়ারোর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে রিচার্ড বোকার মতো তাকিয়ে রইল। পোয়ারো তা লক্ষ্য করে বললেন–আপনাকে বোঝানোর মধ্যে আমার খামতি রয়ে গেছে বুঝতে পারছি। এজন্য আমাকে একটা পুরোনো ঘটনার সাহায্য নিতে হচ্ছে। আশা করি, তখন আপনার মাথায় সবই ঢুকবে। এর সঙ্গে সাধারণ মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট সম্পর্ক আছে, বলে দিলাম।
পোয়ারো থামলেন। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিলেন, ধোঁয়ার রিং করে বাতাসে ছেড়ে দিলেন। তারপ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন–আমি সে রাতে এখানে এসে পৌঁছবার পর, আমায় দেখে আপনার পরিবারের সকলে খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। স্যার ক্লডের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও ফর্মুলা চুরির ব্যাপারে আমি তদন্ত করি সেটাতে এ বাড়ির সকলের আপত্তি ছিল, এমনকি আপনিও। সেরাতেই আমাকে লন্ডনে ফিরে যাবার জন্য আপনি আমায় অনুরোধ করেছিলন, আশা করি ভুলে যাননি। কিন্তু আপনার স্ত্রী বাদ সাধলেন। তিনি একা আমার সঙ্গে কথা বললেন। তার প্রবল ইচ্ছের কথা জানালেন। তার আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য আমাকে একান্ত অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। এবার প্রশ্ন হল, মাদাম লুসিয়া যদি সত্যিই অপরাধ করে থাকেন, তাহলে কেন আমাকে তদন্তের কাজ চালিয়ে যেতে বলবেন, বলুন? ভেবে দেখেছেন কী? আপনি তো একজন সামরিক ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত মানুষ–তলিয়ে দেখুন, জবাব মিলে যাবে।
রিচার্ড খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল–তাহলে আপনি বলতে চান…..
রিচার্ডকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি, আর সময় নষ্ট করবেন না, মঁসিয়ে অ্যামরি। কাল ভোরে আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে মাফ চাইবেন। আপনি আপনার আচরণের জন্য কতটা অনুতপ্ত তা তাকে বুঝিয়ে বলবেন। আপনি যে অহেতুক তাকে অপরাধী ভেবে অন্যায় করেছেন, তাও তার কাছে খুলে বলবেন।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি তো আপনার উদ্দেশ্য কী, বুঝতে পারছি না।
–অত নাই-বা বুঝলেন। মঁসিয়ে, আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি আপনাদের শুভাকাঙ্খী। অতএব আপনাদের দুজনকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমার। আমি এরকুল পোয়ারো বলছি। অতএব যেমনটি বলছি, তেমনটি করুন।
-বেশ, আপনার পরামর্শ মেনে নিলাম, কিন্তু আপনি কি অমার স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারবেন? রিচার্ডের অস্থির চিত্ত তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।
-আপনাকে আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, মঁসিয়ে অ্যামরি। পোয়ারোর গলায় কঠিন সুর, তবে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যে কত কঠিন কাজ, তা আগে বোধগম্য হয়নি। কিন্তু সময় ক্রমশ সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে, যা কিছু করার এর মধ্যেই শেষ করতে হবে। কিন্তু তার আগে আমি যা বলব, তা পালন করতে হবে। বলুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, শপথ নিন, যা বলব, তাই করবেন, কোনো প্রশ্ন করা চলবে না, কোনো ওজোর-আপত্তি শুনব না, ঠিক আছে?
-বেশ, শপথ নিলাম।
পোয়ারো বুঝলেন, রিচার্ড অনিচ্ছার সঙ্গেই কথাটা বলছে
এবার শুনুন, সিগারেটের শেষ অংশটা ফেলে দিয়ে পোয়ারো বললেন, মন দিয়ে শুনুন। কাজটা আপনারা করে ফেলতে পারবেন, আমি জানি। জ্যাপের কথার সুর শুনে বুঝতে পেরেছি, উনি সহজে আপনাদের ছেড়ে দেবেন না, নাচিয়ে ছাড়বেন। আজকালের মধ্যেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা এখানে এসে পড়বে। কেবল ওপর-ওপর তল্লাসী চালিয়ে ওরা ক্ষান্ত হবেন না, সারা বাড়ি তোলপাড় করে ছাড়বেন। ওদের শ্যেন দৃষ্টির হাত থেকে ঘুপচি-ঘাপচিও বাদ যাবে না। আসলে কী জানেন, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে আমিও তো একসময় চাকরি করেছি, অভিজ্ঞতা কম হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, ওদের দৌরাত্মে আপনাদের তিষ্ঠোনো দায় হয়ে দাঁড়াবে। তাই বলছি, এখান থেকে আপনারা অন্য কোথাও চলে যান কয়েক দিনের জন্য, এ আমার অনুরোধ।
–কিন্তু এ বাড়ির দায়িত্ব কার ওপর দিয়ে যাব? পুলিশের ওপর?
রিচার্ডের প্রশ্নের জবাবে পোয়ারো বললেন আপনারা কি এই অঞ্চল ছেড়ে অনেক দুরে কোথাও চলে যাবেন? এখানকারই কোনো হোটেলে ঘর ভাড়া নেবেন। সেখানেই কয়েকদিন থাকবেন। ফলে পুলিশ এবং বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হবে না। কোনো জিজ্ঞাসাবাদ থাকলে সহজেই যোগাযোগ করা সম্ভব হবে।
-স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা কবে আসবে? এ সম্পর্কে আপনার কি কোনো ধারণা আছে?
-যে কোনো দিন, যেকোনো সময়। আগামীকাল দিনের বেলাতেই যদি ওদের আগমন ঘটে, সেটা অপ্রত্যাশিত হবে না।
ব্যাপারটা কি সকলে সহজভাবে মেনে নেবে?
–আপনি নিশ্চয়ই তাই ভাবছেন। না, কেউ এটাকে বিশ্রী ব্যাপার ভেবে মাথা ঘামাবে না। বরং আপনি এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবেন। বাড়ির লোকেদের চোখের সন্দেহপূর্ণ চাউনি, চাপাগলায় সমালোচনা, সারা বাড়িময় ফিসফিসানি আর গুজগুজানি, আপনাকে জ্বালিয়ে মারবে। তখন তুচ্ছ কারণেও অনর্থ বেঁধে যাবে। তার চেয়ে, আমার পরামর্শ মেনে নিন, বাড়ির বাইরে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসুন।
–তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ইন্সপেক্টর জ্যাপ, উনি কি সহজে। আমাদের ছেড়ে দেবেন? রিচার্ডের গলায় অবিশ্বাসের সুর। তাছাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও কতখানি লাভ হবে, বুঝতে পারছি না।