বারবারা এতক্ষণ চুপ চাপ সব দেখছিল আর শুনছিল। ঘর ফাঁকা হতে সে উঠে দাঁড়াল। পোয়ারোর দিকে তাকাল, উপহার দিল একঝলক দুষ্ট হাসি। তারপর ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে পাকড়াও করল।
নাছোড়বান্দার মতো তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল খোলা জানলার কাছে, হেস্টিংস অসহায় বোধ করলেন, পোয়ারোর দিকে তাকালেন। কিছু বলতে গেলেন বটে, কিন্তু বলা হল না। তার আগেই বারবারার আকর্ষণে তিনি তখন এসে পড়েছেন একেবারে বাগানে। পোয়ারো নীরবে সব কিছু দেখলেন, আর আপন মনে হাসতে থাকলেন।
এরপর কেটে গেল কিছুটা সময়।
রিচার্ড ঘরে এসে ঢুকল, না-ডাকতেই রিচার্ড যে আবার ফিরে এসেছে, একথা ভেবে জ্যাপ মনে মনে খুশি হলেন। পোয়ারোর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–মাফ করবেন মি. অ্যামরি। খানিক আগে মি. রেনর কী বলেছেন শুনলেন তো। অতএব আমাদের সতর্ক হয়ে এগোতে হবে। আপনি বোধহয় কিছু বলতে চান। বলুন, স্বচ্ছন্দে বলে ফেলুন। তবে হ্যাঁ, পোয়ারোর সামনে আপনার স্বীকারোক্তি দিতে, আপত্তি থাকলে আমি শুনব না। আপনার বক্তব্যের একজন সাক্ষী চাই তো।
-বেশ, আমারও আপত্তি নেই, দুজনেই শুনুন। রিচার্ড কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল। তারপর বলল–সত্যিটা বলার সময় হয়েছে বুঝতে পারছি। তাই আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি যে, আমার বাবার খুনী আমি নিজে। আমিই আমার বাবা স্যার ক্লড অ্যামরিকে বিষ খাইয়ে খুন করেছি। আমিই খুনী, বিশ্বাস করুন।
–উঁহু, হল না। জ্যাপ মুচকি হাসলেন। আপনি যে মিথ্যে বলছেন, তা আপনার মুখ চোখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। দেখুন, মি. পোয়ারোও হাসছেন। কেন অন্যের অপরাধ নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন কেন, মি. অ্যামরি? আপনার এই স্বীকারোক্তি আমরা গ্রাহ্য করছি না, দুঃখিত।
-কেন? রিচার্ড অবাক চোখে ওঁদের দিকে তাকাল–আমি যে মিথ্যে বলছি, তার বুঝলেন কী করে?
–আপনি কী ভেবেছেন, বলুন তো, জ্যাপের কণ্ঠস্বর কঠিন হল, আপনি যা বললেন, তা মেনে নিয়ে আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাব ভেবেছেন? মনে করছেন, এভাবেই সমস্যাটা মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, মশাই। আমি জানি, আপনাদের দাম্পত্য জীবন খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। সুন্দরী যুবতী স্ত্রী। জানি তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। তাই বলে নিজেকে ফাঁসি কাঠে লটকে তাকে বাঁচানো। না, মশাই, এ হতে পারে না। আমি জানি, আমার কথাগুলো শুনতে আপনার ভালো লাগছে না। মনে মনে গালিগালাজও করছেন। তবুও না বলে পারছি না, একটা নোংরা খারাপ মেয়ের জন্য নিজের সুন্দর জীবনকে বলি দেবেন, মি. রিচার্ড অ্যামরি?
ইন্সপেক্টার জ্যাপ। রিচার্ড উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, সব কিছুরই একটা সীমা আছে জানবেন।
-মানছি, আর এও মানছি যে, কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মুখে নিজের স্ত্রীর নিন্দা শুনলে আপনার মতো স্বামীরা চটে যান। কী মাসিয়ে পোয়ারো, আমার এই বক্তব্যকে আপনি নিশ্চয়ই সমর্থন করছেন। এখানে আমি কাজ করতে এসেছি। আসল অপরাধীকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়াই আমার আসল উদ্দেশ্য। অপরাধী কে, জানতে পেরেছি। এমন কি তার নামও জানতে বাকি নেই। অতএব মি. রিচার্ড অ্যামরি, দুঃখিত, আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারছি না। যাই, ওদিকের খবরটা নিয়ে আসি, তারপর আসল হত্যাকারীকে ধরা যাবে।
কথা শেষ করে ইন্সপেক্টার জ্যাপ দরজায় প্রহরারত কনস্টেবলের দিকে তাকালেন। ইঙ্গিতে কী যেন নির্দেশ দিলেন। তারপর চলে গেলেন বসার ঘরের বাইরে।
রিচার্ড কাচুমাচু মুখে বসে রইল। কখন যে পোয়ারো জানলার ধার থেকে সোফায় এসে বসেছেন, খেয়াল করেনি। হঠাৎ ঘাড় ফেরাল রিচার্ড। দেখল, সিগারেট হাতে পোয়ারো বসে আছেন।
রিচার্ড এবার উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে পোয়ারোর সামনে এসে দাঁড়াল, আকুতিভরা কণ্ঠে জানতে চাইল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বলেন? ইন্সপেক্টার জ্যাপ যাকে অপরাধী বলে মনে করছেন, আপনার কি তাতে সায় আছে?
-মঁসিয়ে অ্যামরি, সত্যি করে বলুন তো, পোয়ারো সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন–আপনি আপনার স্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না, জানি। এই সন্দেহ প্রবণতা কবে থেকে এল আপনার মনের মধ্যে।
–একদম বাজে কথা বলবেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো। বোঝা গেল রিচার্ডের আসল জায়গায় আঘাত পড়েছে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা পোয়ারোর দেশলাই বাক্সটা সে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল উত্তেজনা দমনের চেষ্টায়। আমি আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করিনি। কখনো তার প্রতি আমার সন্দেহ জাগেনি।
–চিৎকার করে লাভ নেই, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, মঁসিয়ে অ্যামরি। যা সত্যি, দয়া করে তা বলে ফেলুন। আপনি যে আপনার স্ত্রীকে সন্দেহের চোখে দেখেন, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই, মঁসিয়ে অ্যামরি। আমি এখানে আসার আগে থেকেই সেটা শুরু হয়েছিল বুঝতে পেরেছি। কারণ এ বাড়ি থেকে আমাকে তাড়াবার জন্য আপনি মরিয়া হয়ে উঠতেন না। বলুন, আমি বেঠিক কিছু বলেছি? আমি এরকুল পোয়ারো, যার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।
পোয়ারো রিচার্ডের দিকে সরাসরি তাকালেন, স্মিত হাসলেন। দেখা গেল দশাসই চেহারার রিচার্ড বাটকুল পোয়ারোর সামনে দয়া ভিক্ষা করার ভঙ্গিতে অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
ফের সেই কথা। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনিও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাবেন না। লুসিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে পুলিশ আপনাকে আদালতে তুলতে পারে। কেন বলছি, শুনুন। আপনার বাবা বেঁচে থাকাকালীন আপনার প্রচুর টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল, সেই টাকা জোগাড় করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। স্যার ক্লডের কফির কাপ আপনিই একবার হাতে নিয়েছিলেন, মনে পড়ে? মারাত্মক জীবন নাশক ওষুধগুলো নিয়ে আপনি নাড়াচাড়া করেছিলেন, ব্যাপারটা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। তবে হ্যাঁ, আপনার কাঁধে সব অভিযোগ চাপানোর জন্য একজনকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে।