-হ্যাঁ, লুসিয়া চুপ করল, খানিকটা সময় কেটে গেল, হয়তো বা মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিল। পরক্ষণে শোনা গেল লুসিয়ার ধীর ও স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর–সেলমা গেতজ আমার মা, আমি তার গর্ভস্থ সন্তান। ডঃ কারোলির কথানুযায়ী এপর্যন্ত সত্যি। তারপরের যা কিছু, সেগুলো ওনার মনগড়া গল্প। উনি ইচ্ছে করে ওনার দোষটা আমার ঘাড়ে ফেলে দিতে চাইছেন। আসলে ব্যাপারটা ঠিক উলটো। ওঁকে এখানে আসার জন্য আমি পীড়াপীড়ি করিনি, স্যার ক্লডের ফর্মুলা চুরি করে বিক্রি করা কথাটাও সম্পূর্ণ মিথ্যে। ওনার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ব্ল্যাকমেল করা। প্রচুর টাকা কামানোর ধান্দায় এই পরিবারের জাল অতিথি হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন।
-কী বলছ, লুসিয়া? রিচার্ড আগুন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল, লোকটা তোমায় ব্ল্যাকমেল করতে এসেছে?
রিচার্ড লুসিয়ার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল।
-হ্যাঁ, রিচার্ড। লুসিয়া জোরে জোরে বলতে লাগল, আজ আমি সত্যি বলতে আর ভয় পাই না। উনি সব সময় আমায় ভয় দেখাতেন–ফর্মুলা যদি ওনার হাতে তুলে না দিই, তাহলে আমার অতীত বাড়ির সকলকে বলে দেবেন। কিন্তু ফর্মুলা হাতিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, বিশ্বাস করো তুমি। ফর্মুলা-চোর হিসাবে আমার সন্দেহ হচ্ছে ওনাকেই, কারণ যখন-তখন স্টাডিতে ঢোকার সুবিধা উনি পেতেন এখন বুঝতে পারছি, উনি কেন আমার কানে কানে শুনিয়েছেন হিসকোসিনের ক্ষমতার কথা। ওটা নাকি খুব ভালো ঘুমপাড়ানি ওষুধ। আসলে ডঃ কারোলি ধরেই নিয়েছিলেন, আমি হিসকোসিন খেয়ে মরব। ব্যাস, আর ওনাকে পায় কে! চাউর করে দেবেন ফর্মুলা চুরি করে ধরা পড়ার ভয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছি। শয়তানিতে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। হাড়ে হাড়ে চিনি ওঁকে, কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছেন, তা আর কী বলব।
লুসিয়া নিজেকে আর সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।
রিচার্ড তাকে নিজের কাছে টেনে নিল–শান্ত হও, ডার্লিং। তোমার এই ছোট্ট বুকের মাঝে কত চাপ ধরে রেখেছ, অথচ আমার সঙ্গে ভাগ করোনি। সব যন্ত্রণা একাই বহন করেছ।
কিন্তু ততক্ষণে লুসিয়া বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। পিসিমা ক্যারোলিন ছুটে এলেন। রিচার্ড তার সহযোগিতায় লুসিয়াকে ধরে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিল।
পোয়ারো এবার জানলা ছেড়ে চলে এলেন ডঃ কারোলির সামনে। বেশ আয়েস করে গদিতে বসেছিলেন ডঃ কারোলি। পোয়ারো এক ঝটকায় কারোলিকে হটিয়ে দিয়ে গদিটা হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে নিলেন। সেটা হাতে নিয়ে এলেন টেবিলের কাছে। লুসিয়ার মাথার গদির ওপরে তুলে দিয়ে ফিরে গেলেন আবার আগের অবস্থানে।
ঘটনাটা এত চটজলদি ঘটে গেল যে, নিষ্ফল আক্রোশে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ডঃ কারোলির কিছুই করার নেই।
রিচার্ড এগিয়ে এল ইন্সপেক্টার জ্যাপের সামনে। বলল–আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
জ্যাপের সম্মতি পেয়ে রিচার্ড তার কানের কাছে মুখ এনে অত্যন্ত নীচু স্বরে কী যেন বললেন, যা অন্য কেউ শুনতে পেল না।
-অবশ্যই, জ্যাপ বললেন, উনি আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, যান, ওনাকে নিয়ে নিজের ঘরে শুইয়ে দিন।
জ্যাপের ইঙ্গিতে কনস্টেবল দরজা খুলে দিল। ক্যারোলিন আর রিচার্ড, দুপাশে দু’জন লুসিয়াকে ধরে দোরগোড়ায় এল। ঠিক এই সময় রেনর উঠে দাঁড়ালেন। ব্যথাহত কণ্ঠে বললেন–মাফ করবেন, মি. অ্যামরি, সত্যিই আমি দুঃখিত। তারপর মিনমিনিয়ে বললেন, সত্যিই, মনে হচ্ছে–কথা শেষ না করে রেনর নেমে গেলেন।
রিচার্ড একবার ঘাড় ফিরিয়ে ঘৃণাভরে রেনরকে দেখল। তারপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জ্যাপকে লক্ষ্য করে রেনর বললেন–আমি কি একটু বাইরে যেতে পারি?
নিশ্চয়ই, যেতে পারেন, তবে বাড়ির বাইরে নয়, মনে রাখবেন।
জ্যাপকে ধন্যবাদ জানিয়ে এডওয়ার্ড রেনর ঘর থেকে বিদায় নিলেন।
বাইরে বেরোনোর দরজাটা হাট করে খোলা, অতএব ডঃ কারোলি সময় নষ্ট না করে টেবিল থেকে নিজের টুপি আর স্যুটকেস হাতে নিয়ে ওদিকে এগিয়ে গেলেন। পোয়ারোর দিকে নজর পড়ে গেল। তাচ্ছিলের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। ইন্সপেক্টার জ্যাপ লক্ষ্য করলেন সবই, দেখলেন, ডঃ কারোলি কেবল চোরের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে, অবশ্য, কারোলিকে টের পেতে দিলেন না।
ডঃ কারোলি বসার ঘর থেকে অদৃশ্য হলে জ্যাপ তার কনস্টেবল জনসনকে ডেকে জানতে চাইলেন–বাড়ির সদর দরজায় কোনো পাহারার ব্যবস্থা আছে কিনা।
জনসন জানাল–ওখানে সি আই ডি কনস্টেবল হারল্ড আছেন, স্যার। আপনি যেমনটি বলেছেন, তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
-তোমার মোবাইল ফোনে হারল্ডের সাথে যোগাযোগ করে ক্যারোলির চেহারার এক নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে বলল, ও যেন লোকটাকে অনুসরণ করে। লন্ডনে ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওকে যেন পাকড়াও করে ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হ্যাঁ, আর একটা কথা। লোকটা যেন পাকাল মাছের মতো হাত ফসকে পালিয়ে না যায়। সেদিকে সতর্ক থাকে যেন।
-স্যার, মুচকি হাসল জনসন, ওই লোকটার চেহারার সাথে হারল্ডের পরিচয় আছে। তবু বলছেন যখন, আমি বলে দিচ্ছি।
কথা শেষ করে কনস্টেবল জনসন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি জানিয়ে দিল সি আই ডি কনস্টেবল হারল্ডকে। তারপর ভেতর থেকে। দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিল।