ততক্ষণে ওদিকে সোফা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছেন ডঃ কারোলি। হিংস্র দৃষ্টিতে লুসিয়ার দিকে তাকালেন। ঘৃণা ভরা কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন–ইন্সপেক্টার, ব্যাপারটা দেখলেন তো? আমাকে খামোখা সন্দেহ করে শুধু-শুধু আটকে রাখলেন আপনি এখনও। বুঝতে পারছেন না, ওই কাঁচুমাচু মুখে বসে থাকা মহিলাটিই হল আসল খুনি, যে তার শ্বশুর স্যার ক্লড অ্যামরিকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে।
কারোলির চিৎকার চেঁচামেচি বারবারার সহ্য হচ্ছিলনা। সে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তক্ষুনি ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতে দেখা গেল, ভঙ্গী দেখে মনে হল, একমাত্র তিনিই পারেন এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বারবারাকে রক্ষা করতে।
ইন্সপেক্টার জ্যাপ হাত তুলে ডঃ কারোলিকে সংযত হতে ইঙ্গিত করলেন। বললেন আপনার কথাই শেষ কথা নয়, জানবেন। তাছাড়া আপনার সাথে, চেনাজানার ব্যাপারটা আমার কম দিনের নয়, অতএব আপনি কতটা সৎ বা অসৎ, তা জাহির না করলেও চলবে।
-আপনার মন চাইলে, ইচ্ছে মতো বলতে পারেন, আপত্তি নেই। ডঃ কারোলি গলার স্বর একটুও নামাল না। একই ভঙ্গিতে বললেন–আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি না। আসল কথাটা জেনে নিন, ইন্সপেক্টার তাছাড়া আপনি তো জানতে চেয়েছিলেন, কোন মতলবে এ বাড়িতে ঢুকেছি? ওই মহিলা, মানে মিসেস লুসিয়া অ্যামরির ডাকেই আমি এখানে এসেছিলাম, অবশ্য তখন আমার মাথায় কোনো বদ মতলব ছিল না। উনি আমায় বললেন, ওঁনার শ্বশুর স্যার ক্লডের তৈরি করা ফর্মুলা হাত সাফাই করে আমার কাছে বেচে দেবেন। আপনি ভালো করে জানেন ইন্সপেক্টার, এসব কাজে আমি অভ্যস্ত। তাই ওঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
নিজের দোষ ঢাকবার জন্য বেশ গল্প কেঁদেছেন দেখছি, জ্যাপ আবার ধমকে উঠলেন। আপনি হলেন পুরোনো পাপী। আপনার গুণের কি শেষ আছে, মশাই! ইন্সপেক্টার এবার লুসিয়াকে প্রশ্ন করলেন–ওই লোকটা যা যা বলবেন, সব কি সত্যি, ম্যাডাম?
লুসিয়ার মুখ সাদা হয়ে উঠল, কে যেন বুঝি এক লহমাতে তার পায়ের রক্ত শুষে নিয়েছে। রিচার্ড তাকাল বউয়ের মুখের দিকে, সে ঘাবড়ে গেল, কী জানি বাবা, এক্ষুনি না জ্ঞান হারায়। তার ভীষণ রাগ হল। সে গলা চড়িয়ে বলল–অফিসার, এসবের মানে কী? দেখছেন, আমার স্ত্রীর শরীর ভালো নেই, নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। এসব আমি মোটেই হতে দেব না, বলে রাখছি।
জ্যাপ চোখ রাঙিয়ে বললেন–আপনি কেন বাধা দিচ্ছেন, মি. অ্যামরি? ম্যাডামের আত্মপক্ষ সমর্থনে যদি কিছু ওনার বলার থাকে, তাহলে ওঁকেই বলতে দিন, আপনি দয়া করে থামুন।
লুসিয়া তাকাল রিচার্ডের দিকে, অবশ্য সরাসরি নয়, উঠে দাঁড়াল, কিছু বলবে বুঝি।
ঠিক এই সময় ডঃ কারোলি রাগত স্বরে বলে উঠলেন উনি আবার কী বলবেন? বলার কী আছে। দেখছেন না সব ফাঁস হয়ে যাওয়াতে কেমন মরা মাছের মতো মুখখানা হয়ে গেছে। ওই মহিলা কার রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছে জানেন? শুনলে আপনারা চমকে উঠবেন। ওর মা সেলমা গেতজ, কুখ্যাত নারী গুপ্তচর। নিজের ঘৃণিত পরিচয় গোপন রেখে স্যার গ্লডের ছেলেকে এটা-সেটা বুঝিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করছে। তারপর আদর্শ গৃহবধূর ভান করে ঘর-সংসার করছে। ওইমহিলাকে বিশ্বাস নেই, যখন তখন যার তার সর্বনাশ করতে পারে, ওর সংস্পর্শে না-আসাই মঙ্গল।
-চুপকর, বদমাইস। শার্টের হাতা গুটিয়ে রিচার্ড চেয়ার ঠেলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। কারোলিকে লক্ষ্য করে হুমকি দিল–তুই আমায় চিনিস নারে, শয়তান। এমন ঘুষি লাগাব, নাকটা আর নাকের জায়গায় থাকবে না। তোর ওই মোটা শরীরের হাড়গুলো আস্ত থাকবে না জানিস। তোর হাল বারোটা করে ছাড়ব।
জ্যাপ দু-হাত তুলে রিচার্ডকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন মি. রিচার্ড, আপনি যদি আগে ভাগে ওর হাড়গোড় গুঁড়ো করে দেন, তাহলে আমাদের ভাগ্যে কী জুটবে। মনে রাখবেন, ও একটা ক্রিমিনাল, পুলিশের খাতায় ভুরি ভুরি অভিযোগ আছে ওর নামে। বর্তমানে কারোলি আমার হেপাজতে। কয়েকদিনের মধ্যে ওকে আদালতে হাজির করা হবে।
রিচার্ড নিজের চেয়ারে আবার বসে পড়ল। এবার জ্যাপ তাকালেন লুসিয়ার দিকে। বলেন–ম্যাডাম, আমরা এই মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে চাইছি। আর আপনারা যদি এভাবে ব্যাগড়া দেন, তাহলে কি কাজ এগোবে। আপনাকে বলছি ম্যাডাম, কারোলির কথা বাদ দিন, আপনার কী বক্তব্য আছে, তাই শুনতে চাইছি আমরা।
লুসিয়া নীরবে ঘুড়ে দাঁড়াল, আড়চোখে রিচার্ডের দিকে তাকাল। পরক্ষণে পোয়ারোর দিকে তাকাল, দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে অসহায়তা, পরক্ষণে কী মনে করে একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে।
পোয়ারো তাকালেন লুসিয়ার দিকে। মাদাম, ঘাবড়ে যাবেন না, মনে বল আনুন। পোয়ারো তাকে সাহস জোগালেন আপনাকে গোড়াতেই বলেছি, আমি আপনার বাবার বয়সী, আপনি নিঃশঙ্কচিত্তে আপনার বক্তব্য পেশ করুন। যা কিছু মিথ্যে ছিল, সব প্রকাশ্যে এসে গেছে। এখন শুধু সত্যি জানার সময় এসেছে। মনে রাখবেন, হাজার চাপা দিয়েও সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না, একদিন না একদিন তার প্রকাশ ঘটবেই। তাই বলছি, মাদাম, যা কিছু বলতে চান, বলে ফেলুন, নিজেকে হালকা করুন।
পোয়ারো তার জায়গা ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন খোলা জানলার সামনে, কিন্তু কান খাড়া।