জ্যাপ তার কনস্টেবলকে ঘরের দরজা ভেতর থেকে ভালোভাবে বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দিলেন।
এপর্যন্ত ক্যারোলিন জ্যাপের নাম কেবল শুনেছেন, এখন ওই রাশভারী ইন্সপেক্টারের সাথে পরিচয় হতে ঘাবড়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে ভাইপোর কাছে জানতে চাইলেন–অবশেষে স্কটল্যন্ড ইয়ার্ড থেকে হানা দিতে হল? কেন বলতে পারিস?
–কেন? তাহলে শোনো, পিসিমা। রিচার্ড বলল, ডঃ গ্রাহামের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাবার মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয়। সেখানে কাটাছেঁড়া করে ওরা যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা বলা হয়েছে, এ স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বিষ মেশানো কফি খাইয়ে খুন করা হয়েছে।
একথা শুনে ক্যারোলিন ডুকরে চেঁচিয়ে উঠলেন।
–মি. অ্যামরি, এসব কী বলছেন? রেনর ভুরু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে বললেন–শেষ পর্যন্ত খুন, তাও যেমন–তেমন নয়, একেবারে বিষ খাইয়ে হত্যা।
-হাঁ, করোনার রিপোর্ট পরিষ্কার লেখা হয়েছে, রিচার্ড কেটে কেটে জবাব দিল বাবার পেটে বিষ মেশানো কফির নমুনা মিলেছে। হিসকোসিন, যা খাইয়ে তাকে খুন করা হয়েছে।
-কী, হিসকোসিন? রেনর চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সংযত হলেন–আমি জানি, দেখেছিও। ব্যাস, রেনর মুখে কুলুপ আঁটলেন। কেবল বাঁকা চোখে লুসিয়াকে জরিপ করতে লাগলেন।
এবার ইন্সপেক্টার জ্যাপ এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, কী হল, থামলেন কেন? কী জানেন, কী দেখেছেন, বলুন, মি. রেনর।
-না-না, কিছু জানি না, কিছু দেখিও নি। রেনরকে তখন বুঝি বোবাতে পেয়েছে, অসংলগ্নভাবে জবাব দিলেন।
ঘরের সকলে চুপ, কেবল একটা উসখুসানি শুরু হয়ে গেছে বোঝা গেল। মি. রেনর কী জানেন বা কী দেখেছেন–সেটাই হল মুখ্য প্রশ্ন।
মি. রেনর, জ্যাপ আবার বলেন, আপনি যে কোনো কিছু গোপন রাখতে চাইছেন, তা স্পষ্ট। আমরা আপনার সহায়তা চাইছি। কী এখানে সেদিন ঘটেছিল, ভোলা মনে ভালোয় ভালোয় বলে ফেলুন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে আমাদের বাধ্য করবেন না। যা জানেন বলে ফেলুন।
–বিশ্বাস করুন, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নয়, রেনরের সেই হেঁয়ালি পূর্ণ, কথাবার্তা আমার বক্তব্য হল খুব স্বাভাবিকভাবে এর কিছু যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে বলে আমি মনে করি না।
ব্যাখ্যা! কীসের ব্যাখ্যা? জ্যাপ গম্ভীর মুখে রেনরের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন মশাই, এখনও সময় আছে, মুখ টিপে থাকবেন না। আসল কথাটা সকলকে শুনিয়ে দিন। নয়তো আপনার ভোগান্তির অন্ত থাকবে না আবার বলছি, যা জেনেছেন দেখেছেন, ঘর ভর্তি লোকের সামনে প্রকাশ করুন।
জ্যাপের ধমক খেয়ে রেনর তার দিকে তাকালেন, কী বলতে গিয়ে ঠোঁট খুললেন বটে, কিন্তু পরক্ষণে তা বন্ধ হয়ে গেল। উনি যে খুব ভয় পেয়েছেন, বুঝতে কারো বাকি রইল না।
-কী হল? বোবা হয়ে গেলেন যে, বলুন। জ্যাপের গর্জনে রেনর চমকে উঠলেন।
–হ্যাঁ বলছি। রেনর ঢোক গিললেন, তারপর বললেন, দেখেছিলাম একটা ওষুধের টিউব থেকে কয়েকটা ছোট বড়ি বের করে মিসেস লুসিয়া অ্যামরি হাতের মধ্যে লুকিয়ে রাখছে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললেন রেনর।
-কখন ঘটেছিল? জ্যাপ জানতে চাইলেন।
–গতরাতে। ডিনার শেষ করে সবাই এঘরে বসে গল্পগুজব করছিলেন। গ্রামোফোনে একটা পুরনো রেকর্ড চালিয়ে দিয়ে বারবারা নাচছিল ফক্সট্রট নাচ। বারবারাকে ঘিরে সকলে বসে আছে। বাজনার আওয়াজ আমার কানে গেল। স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলাম। বারবারার অনুরোধে আমিও ওর সাথে নাচতে শুরু করলাম। তখনই নজর পড়ল লুসিয়া অ্যামরির ওপর। দেখি ওষুধের বাক্স থেকে একটা টিউব বার করলেন। এসময় কোনো দিকে নজর ছিল না তার। টিউব উলটে ধরলেন বাঁ হাতের চেটোতে। আমার ধারণা, ওগুলো হিসকোসিন। এরপরেই স্যার ক্লডের ডাক পড়ল। আমি ফের স্টাডিতে এসে ঢুকলাম।
-আপনি এতসব জানেন, অথচ বলেননি, কেন? জ্যাপ পুলিশি কায়দায় জানতে চাইলেন–মঁসিয়ে পোয়ারো এখানে ছিলেন, তাকে অন্তত বলতে পারতেন।
রেনর অবশ্য পালটা কোনো কথা বললেন না। তিনি চুপ করে বসে রইলেন। লুসিয়া কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়াল। তা বুঝতে পেরে জ্যাপ হাত ইশারায় থামতে বললেন মিসেস অ্যামরি, আপনার পালা এখনও আসেনি। মি. রেনরের সঙ্গে কথা বলা শেষ হোক, তারপর আপনার বক্তব্য শুনব।
-আপনি যাই বলুন, অফিসার, রেনর বলতে শুরু করলেন, আসলে এই ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মি. রিচার্ড অ্যামরির মুখে কফির সঙ্গে হিসকোসিন পাওয়ার খবরটা শুনে মনে পড়ে গেল। অবশ্য মিসেস লুসিয়া অ্যামরির হাতের বড়িগুলো হিসকোসিন নাও হতে পারে, অন্য কোনো ওষুধ হবে হয়তো।
-বুঝলাম, এবার জ্যাপ তাকালেন লুসিয়ার দিকে। বললেন–আপনি কী বলতে চাইছিলেন, এবার বলুন, ম্যাডাম।
-আসলে, আমি ওই বাক্সের ওষুধের টিউবগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম, এমন ওষুধ খুঁজছিলাম, যার একটা খেলে খুব ভালো ঘুম হবে, এক ঘুমেই রাত কাবার।
জ্যাপ এবার রেনরের দিকে তাকালেন–আপনি বললেন, টিউবের ভেতরের প্রায় সব বড়ি হাতে ঢেলে নিয়েছিলেন, তাইতো?
-হ্যাঁ, তেমনটাই দেখেছিলাম।
-ম্যাডাম, জ্যাপ আবার লুসিয়াকে জেরা করতে শুরু করলেন, একটা কী দুটো বড়িই ভালো ঘুমের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু অতগুলো বড়ি কী করলেন আপনি? বলুন।
-কী করলাম, মনে পড়ছে না। লুসিয়া একটু থামল, পরক্ষণে কী বলতে গিয়ে বাধা পেল।