–বাঃ, কি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে মেপে মেপে কথা বল তুমি, এমন শোভনীয় আচরণ, নিশ্চয়ই তোমার মায়ের সুশিক্ষার ফল। এই পরিবারের একজন হতে পেরে তুমি যে সত্যিই নিজেকে সুখী বলে মনে কর, তাও আমার অজানা নয়। তবে এখানে একটা জিনিসের অভাব! মা বলে ডাকার মতো কেউ নেই তোমার।
–ছাড়ুন না, পিসিমা, লুসিয়া ক্যারোলিনকে থামিয়ে দিল। বলল, মায়ের সম্পর্কে কোন কথা শুনতে চাই না। ওসব বাদ দিন।
বেশ, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, এ বিষয়ে কোন কথা কখনও বলব না, আমতা আমতা করে বলতে থাকেন ক্যারোলিন–তোমায় দুঃখ দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই, মিথ্যে বলছি না। বিশ্বাস কর। লুসিয়া…… মানে…..তুমি যদি চাও, আমার কাছে ভাল স্মেলিং সল্ট আছে, নিতে আরো।
ধন্যবাদ, পিসিমা। ওসব লাগবে না, লুসিয়া সহজভাবে বলে চলল, শরীর আমার ভালই আছে, চিন্তা করবেন না।
-খুব ভাল স্মেলিং সল্ট, বুঝেছ। ক্যারোলিন বলতে থাকেন, সুন্দর ছোট্ট একটা শিশিতে কড়া আঁঝের জিনিস। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এখন স্যাল অ্যামোনিয়া সম্ভবত। স্টিরিট অব সল্ট মনে হচ্ছে। তবে যাইহোক না কেন, তোমার ওই স্নানের জলে গোলা জিনিস নয় এটা।
লুসিয়া নীরব হল, কেবল ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল।
ক্যারোলিন বিষয়ান্তরে চলে এলেন। এপাশ-ওপাশ ছড়িয়ে পড়া গদিগুলোকে স্বস্থানে গুছিয়ে রাখতে রাখতে তিনি বললেন–এই তো আজ সকালেও তুমি বহাল তবিয়তে ছিলে, হঠাৎ কোথা থেকে ঠাণ্ডা লাগালে যে, নাকি ওই ইটালিয়ান ডঃ ক্যারোলিনকে হঠাৎ দেখে মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের দেশের কথা। তাই হয়তো শরীরটা খারাপ হয়েছে। তোমার।
এসব কথাবার্তার মাঝখানে ও ঘরে এসে ঢুকল রিচার্ড। পিসি ক্যারোলিন ভাইপোকে দেখতে পাননি। কিন্তু লুসিয়া তাকে দেখে হকচকিয়ে গেল। নিশ্চয়ই পিসির বলা কথাগুলো রিচার্ড শুনেছে। কি যে হবে এবার। ভয়ে তার বুকটা ধড়াস করে উঠল, দু’চোখ কেঁপে কেঁপে উঠল।
ক্যারোলিন বলল–কি হল, বাছা? আবার নিশ্চয়ই শরীর খারাপ হচ্ছে?
দরজা বন্ধ করার আওয়াজ হল। ক্যারোলিন ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। রিচার্ডকে দেখতে পেলেন। বছর তিরিশের এক যুবক, মাঝারি উচ্চতা, বাদামি বর্ণের চুলে মাথা ঢাকা, পেটানো চেহারা, নিয়মিত ব্যায়ামের ফল–এক সুপুরুষ ইংরেজ। এক সময় সামরিক বাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার পদে নিযুক্ত ছিল। ক্যারোলিন জানে, এই ইংরেজ যুবক তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না, তাই যতটা সম্ভব তিনি তাকে এড়িয়ে চলেন।
–পিসিমা, এ কেমন তোমার ব্যবহার। খাওয়া শেষ না করে উঠে এলে, রিচার্ড কৈফিয়তের সুরে বলে চলল, বাবার খাওয়া এখনও শেষ হয়নি, আর তুমি তো খুব ভাল ভাবেই জানেনা, খাওয়া শেষ না করে উঠে যাওয়া বাবার একেবারে পছন্দের নয়। এসব কথা তোমাকে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। যাও, ওপরে যাও। আমি আছি লুসিয়ার কাছে। ও খুব শিগগির ভাল হয়ে উঠবে।
-বাঃ, খুব ভালই হল। তুমি এসে গেছ, আমার আর থাকার দরকার নেই বল। ক্যারোলিন উঠে দাঁড়ালেন এবার আমাকে যেতেই হচ্ছে। ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন রিচার্ড, আমার খাওয়া শেষ না করে এভাবে চলে আসা ছাড়া, তার গলায় তিক্ততা ঝড়ে পড়ছে, ওঁর গবেষণার কাছে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, তার সবকটিই কিন্তু তোমার বাবার অপছন্দের, বিশেষ করে ওই অচেনা অজানা অতিথিটি, বলা নেই কওয়া নেই এসে জুটেছেন, তাকে তো একেবারেই নয়।
লুসিয়া আর রিচার্ড চুপ, হাড় জ্বালানো মহিলা ক্যারোলিন, কান ভাঙিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন।
তুমি পৃথিবীর এই প্রান্তে ঘর-সংসার পেতে বসেছ, যোগাযোগ না-থাকলে ওই লোকটা, মানে ডঃ ক্যারোলি জানবেন কি করে? চাপা হিসহিসানি কণ্ঠস্বর ক্যারোলিনের অ্যাবটস ক্লিভের কাছাকাছি কোন সরাইখানাতে উঠেছেন খবর পেয়েই তুমি তাকে নিয়ে এলে জামাই আদর করে। ডঃ ক্যারেলিও তোমার পিছু পিছু ঢুকে পড়লেন, আমার দাদার অতিথি হয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন, নড়বার নাম নেই।
বজ্জাত পিসিমার এমন অপমানসূচক মন্তব্য শুনে লুসিয়া মনে মনে রেগে গেল, কিন্তু তা প্রকাশ করল না। বলল–সত্যি ঠিকই বলেছেন, পিসিমা, অবাক হবার মতোই ঘটনা।
–যাই বল বাপু, তোমার ওই, ইটালিয়ান বন্ধুটি দারুণ সুদর্শন, তাই কিনা?
–পিসিমা, ভুল, ভুল। আপনার সবটাই ভুল, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা গেল লুসিয়ার আপনি সেই থেকে ডঃ ক্যারোলিকে আমার বন্ধু বলে চালিয়ে যাচ্ছেন, আগেও বলেছি, আবার বলছি, ওনার সঙ্গে আমার কোনরকম বন্ধুত্ব নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে, তা অনেক দিন আগের কথা। সেই খাতিরেই ওঁকে নেমতন্ন করে এখানে এসেছি। ওঁর সঙ্গে কথা বলে খুশি হয়েছিলেন গৃহকর্তা স্বয়ং, তার অনুরোধ ফেলতে পারেননি ডঃ ক্যারোলি। ব্যাস, এই পর্যন্ত। এব্যাপারে, আপনার সঙ্গে আর কোন কথা বলতে চাই না।
রিচার্ড নীরবে সব শুনছিল। বুঝল, ক্যারোলিন ও লুসিয়ার মধ্যে ঝগড়া বাঁধতে দেরি নেই। ক্যারোলিনকে ভেজানো দরজা খুলে দিয়ে ওপরে চলে যেতে ইঙ্গিত করল।
তবু আমি দেখেছি, কিছু কিছু বিদেশী নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশের বাইরে পা বাড়ালে প্রথমে চেনা-জানা বন্ধুর খোঁজ করে, খাওয়া-থাকার খরচটাতে বাঁচল। ক্যারোলিন বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন। থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালেন–তবে আমাদের লুসিয়ার কথা আলাদা, বিদেশী বটে, তবে পুরোপুরি ইটালিয়ান এখন আর নেই। ব্রিটিশ আর ইটালিয়ান–আধাআধি।