-পোয়ারোকে ওপর-ওপর ওরকমই দেখতে লাগে। হাসতে হাসতে হেস্টিংস বললেন। আসলে লোকটা অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিখুঁত পরিপাটি ভাবে সবকিছু দেখতে চান। অনেক জিনিস আছে, যেগুলো আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনি না, পড়ে থাকলেও ঘুরে তাকাই না, সেইসব তুচ্ছ জিনিসকে উনি মহামূল্যবান বলে মনে করেন, সাজিয়ে গুছিয়ে সেগুলো তুলে রাখেন। যেমন তেমন করে সাজানো গয়নার সেট বা কারো পোশাকে একটু ধুলো–এসব পোয়ারো একেবারেই বরদাস্ত করতে পারেন না। মনে মনে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়, যা আপনাকে বোঝানো যাবে না। এককথায় লোকটা অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। আমি মাঝে মাঝে ওঁকে দেখি আর ভাবি, দীর্ঘদিন ধরে ওঁর সঙ্গে মেলামেশা করছি, অথচ ওঁর মতো খুঁতখুঁতে স্বভাবের হতে পারিনি কেন?
–অর্থাৎ, আপনাদের দুজনের স্বভাবের মধ্যে বিস্তর ফারাক, বলতে পারেন একেবারে উলটো। বারবারা হেসে ফেলল।
হেস্টিংস বিরক্ত হলেন–আপনার হাসি পাচ্ছে? আর ওঁর কাজ? প্রতিটি কাজ সুশৃঙ্খলের পরিচায়ক। সম্পূর্ণ নিজের পদ্ধতিতে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করেন। অনেক গোয়েন্দাকে দেখেছি, অপরাধীর পদচিহ্ন কোথায় পড়েছে, কোথায় সে সিগারেটের ছাই বা চুরুট ফেলেছে, এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, এসব নাকি রহস্য সমাধানে সাহায্য করে না, অথচ পোয়ারোর মতে, তদন্তের কাজ করে গোয়েন্দার মাথা আর তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা………..
-দারুণ! গোয়েন্দাদের দাদাঠাকুর, বারবারা হাসতে হাসতে বলল। তাইতো এমন কথা বলতে পারেন। তবু বাঁচোয়া, আপনার মতো সুরেলা মোলায়েম স্বরে বলেননি, কী চমৎকার ঘর, মি. অ্যামরি’! নিজের কৌতুকে বারবারা আর এক দফা হেসে উঠল।
-এখনও আমি বলছি, মাদাম, এ দুদিনে ঘরটার ওপর দিয়ে কম ঝড় বয়ে গেল না, তবুও আমার চোখে আগের মতোই খাসা চমৎকার হয়ে আছে।
–আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, বিচার বিবেচনার সঙ্গেও কারো মিল নেই, আমি স্বতন্ত্র কথা শেষ না করেই বারবারা টানতে টানতে হেস্টিংসকে নিয়ে এল খোলা জানলার কাছে। তারপর ফিক করে হেসে বলল–আর দেরি নয়, চলুন, বাগানে যাই। মেলা জ্ঞান শুনেছি আপনার, চুপ করে মাথা ধরে গেছে। বাইরের খোলাবাতাস না হলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা করে, তারপরে অন্য কথা। কী হল, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, আসুন বলছি।
বারবারার কণ্ঠে স্নিগ্ধ ধমকানির সুর।
নিজেকে বারবারার কবল থেকে মুক্ত করে অসহায়ের মতো ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন–আপনার অনুরোধ আমি মানতে পারছি না। কেন, তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, মঁসিয়ে পোয়ারো না ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে এই ঘরেই থাকতে হবে।
-আশ্চর্য, বারবারা হেস্টিংসের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিসে বলল–ক্যাসাবিয়াংকার কথা জানেন তো? আহা বেচারা, আপনার অবস্থাও ঠিক তাই
…দ্য স্টুড অন দ্য বার্নিং ডেক…… হোয়েন অলবাট হি ব্যাড ক্লেড…….. কিন্তু বন্ধু, আপনার এ হাল কেন, খুলে বলুন তো।
-আপনি আসলে কী করতে চাইছেন বলুন তো, কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে হেস্টিংস বললেন, মাঝে মাঝে আপনার কান্ডকারখানা দেখে তাজ্জব বনে যাই।
-বাজে কথা রাখুন, বারবারার ঠোঁটে হাসি–সত্যি বলছি, আপনার সান্নিধ্য পাবার জন্য মন আমার ছটফট করছে। পুরুষ মানুষ তো কম দেখিনি, কিন্তু আমার চোখে আপনি তাদের মতো নয়, সম্পূর্ণ আলাদা।
–আপনার মতো অদ্ভুত মার্কা মেয়ে জীবনে এই প্রথম আমি দেখলাম।
–এমন খুশির খবর আগে কেউ দেয়নি আমায়। এটা সুলক্ষণের একটা নমুনা। বারবারা আবার হেস্টিংসের হাতে হাত রাখল, ছেলেদের মুখে এমন কথা শুনলে আমার মতো মেয়েদের মনোবল বেড়ে যায়।
কথা শেষ করে বারবারা হেস্টিংসের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। একসময় তারা। দুজনেই এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নীচে, বাগানের মধ্যে।
১৩. পিসিমা ক্যারোলিন
১৩.
পিসিমা ক্যারোলিন লাইব্রেরি তথা বসার ঘরে এসে পা রাখলেন, হাতে তার সেলাইয়ের থলে। সোফার ধারটাই তার পছন্দ, বসার জন্য তৈরি হলেন। ঠিক এই সময় সেখানে হাজির হলেন ডঃ কারোলি, হাতে টুপি আর একটা ছোট স্যুটকেস।
ডঃ কারোলির চোখে-মুখে বিরক্তির রেখা প্রকাশ পেল, বোঝা গেল বুড়ি ক্যারোলিনই তার বিরক্তির কারণ, তিনি ভেবেছিলেন ঘরটা এখন ফঁকাই আছে, সে গুড়ে বালি।
ডঃ কারোলির উপস্থিতি টের পেয়ে আপন মনে ক্যারোলিন বলতে থাকলেন–সুঁচটা যে কোথায় ফেললাম, চারপাশ খুঁজে বেড়াচ্ছি, এখানেও ভুল করে ফেলে যেতে পারি, দেখি পাওয়া যায় কিনা। তারপর গলার স্বর বাড়িয়ে বললেন–কী হল ডঃ কারোলি, স্যুটকেস নিয়ে কোথায় চললেন? এখানে বুঝি আর থাকতে ভালো লাগছে না?
-কিছু মনে করবেন না, মাদাম, হাতে ধরা টুপি আর সুটকেস একটা চেয়ারের ওপর রাখতে রাখতে বললেন, এখানে তো দু-দিন মজায় কাটালাম, আর থাকাটা সমীচীন নয়, অনেকেরই অপছন্দ। তাছাড়া লন্ডনে আমার কিছু জরুরী কাজ পড়ে আছে, তাই মন না চাইলেও যেতে হচ্ছে।
–আপনাকে কে অনুমতি দিল? এ বাড়ির কাউকে বাইরে যাওয়ার হুকুম নেই বলেই তো জানি।
–চিন্তা করবেন না, মাদাম, অবজ্ঞার সুরে ডঃ কারোলি বললেন, ওসব সামলে নেব।
–একান্তই যখন যেতে হয়, তখন একটা গাড়ি ডেকে দিতে বলি। ক্যারোলিন এগিয়ে এলেন দেওয়ালের দিকে। সেখানেই কলিং বেলের বোতাম।