বারবারার কথাশুনে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস চমকে উঠলেন। তার বিস্ময়ের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। একফাঁকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল দুটি অস্ফুট শব্দ–কী বলছেন?
বারবারা হাত ইশারায় বাধা দিয়ে বলল–থামুন তো। সত্যি যা, তাই বলছি। অত ঢাক গুরগুর কীসের? আমি স্পষ্ট কথা বলতেই ভালোবাসি। জ্যেঠুর স্বভাব চরিত্রের বদগুণ না বলে, আমি যদি কালো পোশাক পরে শোক পালন করতাম, তাহলে আপনার নিশ্চয়ই পছন্দ হত, তাই না? ন্যাকা গলায় বলতাম–আহা-হা, আমার জেঠুর মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি দেখা যায় না। আমাদের সবার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করেছেন।
-সত্যি, আপনার এসব কথা শুনে যে কেউ অবাক হবে।
-তাই বুঝি, কিন্তু আমার তো লজ্জা-সঙ্কোচ হচ্ছে না। আসলে কী জানেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমি মেয়েটাই এরকম, বারবারা বেশ ফলাও করে বলতে লাগল–সারাজীবন নিজের কাজ গোছাবার জন্য গাদা গাদা মিথ্যে বলব, আর এক-আধবার লোকদেখানো ভালোমানুষ সাজব,–এমনটাই ছিলেন আমার জ্যেঠু। মোদ্দাকথা, ওনার দুর্ব্যবহারই ওনাকে সকলের কাছে অপছন্দের করে তুলেছিল। তাই ওনার মৃত্যু, কারো মনে শোক-তাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন, এই পরিবারের সকলের ভাবখানা এমন–যাক, আপোদ বিদেয় হয়েছে গোছের। ক্যারোলিন পিসির কথাই ধরুন না। আহা বেচারী। জ্যেঠি মারা যেতে পিসিমা এসে জ্যেঠুর সংসারের হাল ধরলেন বটে, কিন্তু শান্তিতে ছিলেন কি? পিসিমা পর্যন্ত তার ভাইকে পছন্দ করতেন না, জ্যেঠুর জন্য তার মনে জমে আছে একরাশ বিতৃষ্ণা। সব কিছু মুখ বুজে তবুও তাকে সহ্য করতে হয়েছে, কারণ অন্য কোনো আশ্রয় তার নেই।
বারবারা থামল, দম নিল, কী যেন চিন্তা করল। তারপর আবার বলতে শুরু করল আমার এক-একবার কী মনে হয় জানেন তো, পিসিমাই তার ভাইকে খুন করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় জ্যেঠুর হার্ট অ্যাটাকের যে ব্যাপারটা ঘটল, এখনও ভাবতে অবাক লাগে, বিশ্বাসই হয় না হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পিসিমার ওপর দিনের পর দিন ক্লড জ্যেঠু মানসিক অত্যাচার চালিয়ে গেছেন। পিসিমা একবারও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি, নিজেকে সামলে রেখেছেন, আর মনের ভেতর তৈরি হয়েছে আক্রোশের পাহাড়। হয়তো আমাদের অগোচরে কোনো একদিন ভাই-বোনের মধ্যে এমন কিছু ঘটে গেছে, যা পিসিমার সহ্যের ঠাই ভেঙে দিয়েছে। জমে থাকা আক্রোশের চাপে পড়েই পিসিমা হয়তো তার ভাইকে বারবারা তার কথা শেষ করল না।
–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, হলেও হতে পারে। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস চাপা গলায় বললেন।
-তারপরে ওই ফর্মুলা চুরির ব্যাপারটাও ভেবে দেখুন। সকলের সন্দেহের আঙুল ওই ইটালিয়ান ডাক্তারের ওপর। কিন্তু আমার তাত মনে হয় না। ট্রেডওয়েলকেই আমি সন্দেহ করি।
–ট্রেডওয়েল, মানে আপনাদের বাটলারের কথা বলছেন! ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন–ট্রেডওয়েলকেই আপনার সন্দেহ হয় কেন? বাড়িতে তো আপনাদের কাজের লোকের অভাব নেই, তারা কি ভালো মানুষ?
হা, ট্রেডওয়েলকেই জ্যেঠুর খুনী বলে মনে হয় আমার, কারণ সে জ্যেঠুর স্টাডির পাশে পাশেই আসেনি, তাই।
–তাহলে কেন আপনার মনে এই ধারণা হল?
ক্যাপ্টেন হেস্টিংস হালকা সুরে জানতে চাইলেন।
–জানেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অনেক মিল আছে। আপনার মতোই গোঁড়া আর সেকেলে। নিরীহ গোবেচারা গোছের লোকেরা হয় সবচেয়ে বেশি শয়তান, অথচ মুখে ভালো মানুষের মুখোশ আঁটা। অনেক গোয়েন্দা এসব ব্যাপারকে আমল দেন না। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সকলের চোখে ট্রেডওয়েল এক শান্ত ভদ্র, নিরীহ, নিরাপরাধ লোক।
–কিন্তু সেভাবে ভেবে দেখলে শুধু ট্রেডওয়েল কেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, আপনার নামটাও সন্দেহভাজনদের তালিকায় থাকা উচিত বলে মনে করি। নিরীহ আর নির্দোষ যুবতীর মুখোস এঁটে বেমালুম সহজভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
-তাই বুঝি, বারবারা সামান্য হাসল, মনের ভেতর কোনো গলদ না রেখে পেট ঝেড়ে সব বলে দিলাম কিনা–সত্যি আজব এক লোক বটে আপনি!
–আজব হলাম কী ভাবে?
ক্যাপ্টেন হেস্টিংস নিজের চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন।
–হ্যাঁ, জবাব দেব, কিন্তু তার আগে, বারবারাও তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। খোলা জানলার দিকে চোখ বেঁকিয়ে বলল, উত্তর পেতে চান, তাহলে বাইরে চলুন। বদ্ধ ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আসুন, বাগানের খোলা হাওয়াতে বসে গল্প করি।
বারবারা একটা খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর দিকে এগিয়ে গেল কই, আসুন।
–কিন্তু আমি তো যেতে পারব না। হেস্টিংস সহজ সুরে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ায়োর নিষেধ আছে, এঘর পাহারা দেবার জন্যই আমাকে বসিয়ে গেছেন।
-ওসব বাজে কথা ছাড়ুন, আসলে এঘরের মায়াতে জড়িয়ে পড়েছেন আপনি, তাই খোলা আকাশের নীচে যেতে মন চাইছে না। বেশ, গত রাতের কথাই বলি। ভাবুন ক্লড জ্যেঠুর কথা। ওইখানে, ওই আরাম চেয়ারে উনি বসে আছেন, আমরা সকলেই এখানে উপস্থিত। অথচ আমরা কেউ টের পাইনি বিষক্রিয়ায় ওনার হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বন্ধ হতে চলেছে, বা অনেকক্ষণ আগেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে। শুধু এটুকু জানতে পেরেছি, জ্যেঠুর সিন্দুক থেকে রহস্যজনকভাবে তারই তৈরি একটা ফর্মুলা চুরি হয়ে গেছে। সত্যি, অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। ঠিক এই সময় আপনার পদধূলি পড়ল এঘরে। ঘরের চারদিকে চোখ বুলোলেন, মোহিত হলেন। রিচার্ডকে বললেন, বাঃ, কী চমৎকার ঘর মি. অ্যামরি। আর আপনার সঙ্গের ওই মাঝবয়সী বেঁটে লোকটা। মাথা জুড়ে মস্ত এক টাক, উঁহু-হুঁ, মুরগির ডিম। কত লম্বা হবে? বড়ো জোর পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। বাটকুল হলে কী হবে, লোকটার এলেম আছে, ওঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, তাকানোর ভঙ্গিমা, কথা বলার স্টাইল সব মিলিয়ে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন পুরুষ। আমার মতো মেয়েকেও কাত করে দিয়েছিলেন, মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। আর আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল, আপনি অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক। আচ্ছা, আপনার জন্ম কবে? গেল মহাযুদ্ধের পরে কি?