ইন্সপেক্টর জ্যাপ এবার কাজের কথায় এলেন–আমি এসে শুনলাম, আপনি এক সুন্দরীর সাথে কথা বলছেন, পরে দেখলাম, সম্ভবত রিচার্ড অ্যামরির স্ত্রী ঠিক বলেছি? আসলে কি জানেন, ওইসব বিষ-টিষ খাইয়ে হত্যা করার ব্যাপারগুলো, আমার মোটেও পছন্দ হয় না। এই ধরনের মামলায়, তদন্তের কী আছে বলুন? কেবল ওই ঘোড়-বড়ি-খাড়া। কেবল মৃত ব্যক্তি কী খেয়ে ছিল, কী পান করেছিল, এসব তাকে কে দিয়েছিল, এসব মামুলি তথ্য ছাড়া উর্বর মস্তিষ্ক খাটানোর কী আছে? ডঃ গ্রাহাম জানিয়েছেন, কফিতে বিষ মেশানো হয়েছিল, যা সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। করোনারের রিপোর্টের সঙ্গে যদি তার বক্তব্য মিলে যায়, তাহলে স্বীকার করছি, এতথ্য নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এর বাইরেও বহু কাজ আছে।
কথা বলতে বলতে জ্যাপের সন্ধানী চোখ দুটো ঘরময় বাঁইবাঁই করে ঘুরছিল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন–এ ঘরে যা দেখার দেখে নিয়েছি। এবার জিজ্ঞাসাবাদের পালা প্রথমে রিচার্ড অ্যামরি, তারপরে ডঃ কারোলিকে ঝামা ঘষতে হবে। ওই ব্যাটা কারোলিকেই আমার কালপ্রিট মনে হচ্ছে, অবশ্য তথ্য প্রমাণাদি বিচারের পর। একটা কথা সবসময় মনে রাখতেই হবে, খোলা মন ও খোলা চোখ দিয়ে সব কিছু বিচার করব।
জ্যাপ বাইরে খাবার জন্য পা বাড়ালেন। কী খেয়ালে পেছন ফিরে পোয়ারোকে লক্ষ্য করে বললেন–কী, আপনি যাবেন না?
নিশ্চয়ই, পোয়ারো সহজ কণ্ঠে বললেন, আমি তো সর্বদা আপনাদের সাথেই আছি।
–আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, ইশারায় তাকে দেখিয়ে বললেন–উনি কি খাবেন না?
–জ্যাপ, ওকে ছেড়ে দাও। পোয়ারো চট করে জবাব দিলেন।–ও বেচারার বোধহয় এখানে থাকতেই ভালো লাগছে।
-হ্যাঁ, পোয়ারো ঠিকই বলেছেন, বন্ধুর মনোভাব আঁচ করতে পেরে হেস্টিংস বললেন–এখানে থাকাই আমার পক্ষে মঙ্গল।
জ্যাপ, কনস্টেবল জনসন আর পোয়ারো বসার ঘর থেকে বেরিয়ে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি ধরলেন।
অন্যদিকে ঠিক একই সময়ে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে ভেতরে এল বারবারা। গোলাপি রঙের ব্লাউজ আর হাল্কা রংয়ের স্ন্যাকস তার পরণে।
-আঃ, বড়জোড় বাঁচালেন, বারবারা সরাসরি তাকাল ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দিকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঢুকল এ বাড়িতে, কী বলেন।
বারবারা ধপ করে বসে পড়ল একধারে।
-হ্যাঁ, মাদাম। হেস্টিংস জবাব দিলেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে তদন্তের কারণে ইন্সপেক্টর জ্যাপকে পাঠানো হয়েছে। পোয়ারোর সঙ্গে ওনার বহুদিনের পরিচয়, ওঁরা একসঙ্গে বহু রহস্যের কিনারা করেছেন। দুজনেই এখন ওপরে গেলেন, রিচার্ডকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
-বলুনতো, ওঁরা কি আমার সঙ্গেও কথা বলতে চাইবেন?
-খুব সম্ভব নয়। হেস্টিংস তাকে আশ্বস্ত করলেন, বললেন, আর যদি বা করে, তাতে আপনার ঘাবড়ানোর কী আছে?
-না না, ওসব নিয়ে আমার কোনো ভয়-ডর নেই। বারবারা সহজ ভঙ্গিতে বলল, আসলে কী জানেন, এক্ষেত্রে বুদ্ধিই হল আসল। তলিয়ে দেখতে হবে, এর মধ্যে আবেগের মিশেল আছে কিনা। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনি কি আবেগের ধার-ধারেন না? ইচ্ছে করে না আবেগে মনকে ভাসিয়ে দিতে?
-মানে, হেস্টিংস ঢোক গিললেন, হ্যাঁ, করে বৈকি। আবেগ তলিয়ে দেখতে আমিও ভালোবাসি।
–আপনাকে মাঝে মধ্যে বুঝে উঠি না, কেমন জটিল প্রকৃতির লোক বলে মনে হয়। হঠাৎ গলার স্বর চড়িয়ে সে জানতে চাইল আগে আপনি কোথায় থাকতেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?
দক্ষিণ আমেরিকায়। বলতে পারেন জীবনের তিন ভাগ সেখানেই কেটে গেছে। আমার। হেস্টিংস-এর ঠোঁটে হাসির আভাস।
–জানতাম, আপনি এই জবাবই দেবেন। দক্ষিণ আমেরিকা! কী দারুণ জায়গা, না? যেদিকে চোখ যায়, কেবল সবুজে ঢাকা মাঠ, মাঝে মধ্যে বনাঞ্চল, কখনো চোখে পড়ে উঠতি বয়সের কাউবয়দের, ঘোড়ায় চেপে চলেছে, হাতে দড়ির ল্যাসো, এ প্রান্ত ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে, চোখে পড়ে নদী, তার ওপর সেতু, তৈরি হয়েছে ছোট গোছের রেলপথ। কয়লার ইঞ্জিন রেললাইন ধরে ঝিকঝিক কণ্ঠে সামনে এগিয়ে চলেছে। মান্ধাতা আমলের রেল গাড়ি। তাই তো বলি, আপনাকে কেন মাঝ মাঝে সেকেলে মনে হয়। এখন বুঝতে পারছি। তবে সেকেলে হলেও আপনি যে রুচিশীল ব্যক্তি, তা স্বীকার করতেই হবে।
তার মানে? ঠিক বোধগম্য হলনা। হেস্টিংস নরম গলায় বললেন।
-বুঝতে পারলেন না, তাই না? বারবারার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক। তার মানে আপনার আচার ব্যবহার। আপনি যেমন যেকোনো পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলা, এই সব আর কী!
–কেন, ভদ্রতা, নম্রতা, দুঃখ, ভালোবাসা, এসব আবেগ কি আপনার মধ্যে নেই।
হেস্টিংস-এর কথাগুলি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল বারবারা আমার কথা ছাড়ুন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। এই বাড়ির লোকগুলোকে তলিয়ে দেখুন। দু-দিনও হয়নি, একটা জলজ্যান্ত লোক মারা গেল, অথচ ছিটেফোঁটা দুঃখ আছে মনে!
-কী বলছেন, মাদাম। হেস্টিংস অবাক হলেন, দুঃখ পায়নি বলছেন?
-হা আমার পোড়াকপাল, বারবারা কপাল ঠুকতে এগিয়ে এল। কফি টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসল–ওই মানুষটা, মানে আমার জ্যেঠুর কথা বলছি, সারা জীবন টাকা রোজগারের পেছনে কাটিয়ে দিয়েছেন, ভুরি ভুরি টাকা জমিয়েছেন। কিন্তু হাত খুলে যে খরচ করবেন, সে মন কোথায়? হাড়কিপটে, বুঝলেন কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ছিল টনটনে জ্ঞান। যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, অথচ লজ্জা শরমের বালাই ছিল না। জ্যেঠুর এইসব বদগুণের জন্য এই বাড়ির লোকদের কতবার সম্মান হানি হয়েছে, কী বলব।