টেবিলের ওপর তখনও গত রাতের একটা কফির কাপ পড়েছিল। খালি নয়। সেদিকে আঙুল তুলে পোয়ারো জানতে চাইলেন–এটাই আপনার কাপ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু কাপে ঠোঁট ঠেকানো হয়নি বুঝতে পারছি, কিন্তু মাদাম, নিজেকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন বলে যে বিষ মেশালেন, সেই কফি শেষ পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখলেন না, কেন?
সে অবসর পেলাম কোথায়? রিচার্ড এসে পাশে দাঁড়াল, লুসিয়া বলল, ও ফিসফিসিয়ে সবার অলক্ষে বলল, আমায় নিয়ে ও এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথায় চলে যাবে। এজন্য টাকার ও জোগাড় করবে। তখন মনে বাঁচার তাগিদ অনুভব করলাম, ঠিক করলাম, জীবনকে আর একটা সুযোগ দেওয়া যাক। তাই বিষ মেশানো কফি যেমন কি তেমনই পড়ে রইল।
আমার এই কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন, আপনাকে জানিয়ে রাখি, স্যার ক্লডের মৃতদেহের পাশে যে কফির কাপটা পড়েছিল, আজ সকালে ডঃ গ্রাহাম এসে ওটা পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছেন।
-তাই বুঝি? লুসিয়া হকচকিয়ে গেল।
-তবে ওরা যতই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করুক না কেন, বিষের ছিটেফোঁটাও পাবে না, পাবে কেবল কফির তলানিটুকু, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। পোয়ারো কথা আর বাড়ালেন না।
–ঠিকই ধরেছেন, লুসিয়া আনমনে জবাব দিল।
–আচ্ছা মাদাম, পোয়ারো আবার বলতে শুরু করলেন, ওরা গতকাল রাতেই কাপটা নিয়ে যেত, তাহলে কী হত? এ প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। উত্তরটাও আমার জানা। কথা শেষ করে পোয়ারো পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন দরজার দিকে, যেখানে চারা গাছ সমেত টবটা রাখা আছে। নিঃশব্দে টবের আলগা মাটি সরিয়ে ফেললেন, বের করলেন একটা কাপ। কাপটা আঙুলের মাথায় আঁকশির মতো ঝুলিয়ে নাচাতে নাচাতে বললেন–এমনও হতে পারত, ডঃ গ্রাহাম এই কাপটা নিয়ে গেলেন, তাহলে? তাহলে কী হত, মাদাম?
–সব তথ্যই দেখছি আপনার হাতে চলে এসেছে।
লুসিয়া নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না, দু-হাতে মুখ ঢাকল, বোঝা গেল লজ্জাজনিত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে তার দু-চোখ থেকে।
পোয়ারো পায়ে পায়ে আবার চলে এলেন লুসিয়ার কাছাকাছি আগেই বলেছি, ডঃ গ্রাহাম সকালে যে কফির কাপটা নিয়ে গেছেন, তা থেকে ওরা কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু এই কাপটা আপনাকে জানিয়ে রাখি, এর তলানির কিছুটা আমি আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম, যার মধ্যে পাওয়া গেছে মারাত্মক হিসকোসিন বিষ, এটাই স্যার ক্লডের কফির কাপ, যা খেয়ে ওনার মৃত্যু হয়েছে।
লুসিয়া একথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠল–আপনি ধরে ফেলেছেন আমার কারসাজি? হা, হা, আমিই আমার শ্বশুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমিই তাকে হত্যা করেছি, হিসকোসিন বিষ আমিই কফিতে মিশিয়ে দিয়েছিলাম।
উন্মাদের মতো লুসিয়া ছুটে এল টেবিলের ওপর, সেখানে তখনও কফি ভরতি কাপটা পড়েছিল। সে সেটা তুলে নিতে নিতে বলল–এটার মধ্যে কোনো বিষ নেই। কথা শেষ করেই কফিতে চুমুক দিতে উদ্যত হল, কিন্তু তার সে প্রয়াস ব্যর্থ হল।
পোয়ারো এক লাফে এগিয়ে এসে ছোঁ মেরে তুলে নিলেন সেই কফি ভরতি কাপ। টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন।
কী হল মঁসিয়ে পোয়ারো, ওটা কেড়ে নিলেন কেন? লুসিয়ার চোখ আবার জলে ভরে উঠল।
-আমি নিশ্চিত, ওই কফি নির্ভেজাল নয়, বিষ আছে। পোয়ারো তাকালেন লুসিয়ার দিকে, স্নেহার্দ্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কেন চিরদিনের জন্য চলে যেতে চাইছেন, অসময়ে?
-হা অদৃষ্ট! লুসিয়া কুশনে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।
–আপনি আমায় এপর্যন্ত যা বললেন, সব বিশ্বাস করছি, তবে এখনও একটা প্রশ্নের উত্তর জানা হয়নি, পোয়ারো আন্তরিকতার সুরে বললেন, আমি জানি, আপনি নিজের কফিতে হিসকোসিন মিশিয়ে ছিলেন। অন্য আর একটি কফির কাপেও ওই একই বিষ মেশানো হয়েছিল। এই কাজ কে করেছে, আপনি জানেন কি?
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কেন আমাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন? কাঁদো কাঁদো গলায় লুসিয়া জানতে চাইল, অন্য কেউ নয়। আমি ওটাতেও হিসকোসিন মিশিয়ে ছিলাম। আমিই অপরাধী।
বুঝতে পারছি, আপনি একজনকে বাঁচাতে চাইছেন, কিন্তু কে সে? তার নাম কী?
এমন সময় দরজায় টোকার শব্দ।
–ওরা এসে গেছে, মানে পুলিশ। স্বাভাবিক কণ্ঠে পোয়ারো বললেন, আর কিছু জানার নেই আমার। যাওয়ার আগে একটা কথা জেনে যান, আপনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।
-কিন্তু আমিই তো স্যার ক্লডের খুনি, লুসিয়ার কণ্ঠস্বর কাঁপছে, তাহলে কেন আমাকে……..
-আবারও বলছি, আপনাদের মানে আপনি এবং আপনার স্বামী রিচার্ডকেও রক্ষা করব, এ আমার অঙ্গীকার।
লুসিয়া অবাক হল, কোনো কথা বলল না, কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চোখে কেবল তাকিয়ে রইল সামনের বেঁটে খাটো চেহারার গোয়েন্দা ভদ্রলোকের দিকে।
এইসময় দরজাটা খুলে গেল। মুখ বাড়াল বাটলার ট্রেডওয়েল। জানাল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জ্যাপ এসেছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
.
১২.
ইতিমধ্যে খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো গলিয়ে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বসার ঘরে এসে প্রবেশ করেছেন।
জ্যাপের সঙ্গে এক ছোকরা কনস্টেবল, নাম জনসন। মাঝবয়সী জ্যাপের হাতুড়ি পেটা চেহারা।
তিনি জনসনকে উদ্দেশ্য করে বললেন–জনি, এনাকে তুমি চেনো। খ্যাতনামা গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো। উনি বেলজিয়ান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন, সেই সময় থেকেই ওনার সঙ্গে আমার ভাব জমে উঠেছে। দুজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রহস্যানুসন্ধানে মেতে উঠেছি। অপরাধীকেও ধরেছি একসঙ্গে। ও, সেসব দিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। সেই যে, অ্যাবারক্ৰম্বি’ জালিয়াতি কেসটা, বলুন না মঁসিয়ে পোয়ারো, আরে যে লোকটাকে আমরা দুজনে মিলে ব্রসলেসে ধরলাম, মনে পড়ছে না? তারপর ব্যারণ অ্যালটারা? কী দুর্ধর্ষ লোক! ইউরোপের প্রায় সব দেশের পুলিশ ওর পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ ধরতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত অ্যালট ওয়ার্ডে লোকটাকে পেলাম, আমরা দুজনে মিলে ওকে ধরে ফেললাম, নিশ্চয়ই মনে পড়ছে আপনার! তারপরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, আপনি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। লন্ডনেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু হল। ফলে দেখা সাক্ষাত প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আপনি তো এখানে এসেই স্টাইলস-এর সেই অদ্ভুত রহস্যের কিনারা করেছিলেন, তাই না? আপনার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় দু-বছর আগে। এক ইটালিয়ান ভদ্রলোককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রহস্যের জট ছাড়া আপনি-আমি একসঙ্গে কাজ করেছিলাম, তাইতো মঁসিয়ে পোয়ারো? তারপর আজ, এখানে। আপনাকে দেখে, বিশেষ করে আপনার সাথে কাজ করছি ভেবে মনটা ভারি খুশি-খুশি লাগছে।