লুসিয়া এবার থামল। একটানা কথাগুলো বলে সে তখন হাঁফাচ্ছে।
-তারপর? তারপর কী হল? পোয়ারো লুসিয়ার কাছাকাছি বসলেন–শেষ পর্যন্ত ফর্মুলাটা ওঁর হাতে তুলে দিলেন, তাই তো?
জানি, হাজার সত্যি বললেও আপনি বিশ্বাস করবেন না। লুসিয়ার মুখ শুকনো, তবুও যা করিনি, তা মানব কেন? ফর্মুলা আমি হাতাই নি, এক বিন্দুও মিথ্যে বলছি না।
পোয়ারো সরাসরি তাকালেন লুসিয়ার দিকে, দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে সহানুভূতি। নরম লুসিয়াকে আশ্বাসবাণী শোনালেন। নরম কণ্ঠস্বরে বললেন–আবার বলছি মাদাম, হতে পারি আমি কাঠখোট্টা এক গোয়েন্দা, কিন্তু মন বলে কিছু আমারও আছে। আমি আপনার বাবার বয়সী। আপনার মনে যথেষ্ট সাহস আছে, এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে, মন শক্ত করুন। আপনার প্রতিটি কথা বিশ্বাসযোগ্য। তবু আবার জানতে চাইছি, সত্যিই কি আপনি ফর্মুলা চুরি করেন নি?
-না। লুসিয়া এবার কেঁদে ফেলল, আপনাকে কী করে যে বোঝাই, ডঃ কারোলি ফর্মুলা চুরি করার কথা বলেছিলেন ঠিকই, আমিও সেটা হাতাবার জন্য তোড়জোড় করছিলাম, করা হয়ে ওঠেনি।
-তোড়জোড় করছিলেন? কীভাবে?
–ডঃ কারোলি একটা চাবি তৈরি করেছিলেন, ওটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, স্টাডিতে ঢুকে সিন্দুক থেকে ওটা নিয়ে আসতে।
আচ্ছা, হ্যাঁ, পোয়ারো পকেটে হাত ঢোকালেন, একটা চাবি বের করলেন, এই চাবিই তিনি এডওয়ার্ড রেনরকেও দেখিয়েছিলেন, বললেন, দেখুন, চিনতে পারেন কিনা। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখুন।
লুসিয়া চাবিটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখল–খুব সম্ভবত। তারপর কী হল, বলি। চাবি হাতে নিয়ে ঢুকলাম গিয়ে স্টাডিতে, সিন্দুকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি কী দাঁড়াইনি, ঠিক এই সময় মূর্তিমান বিভীষিকার মতো স্যার ক্লড এসে ঢুকলেন। ওইভাবে সিন্দুকের পাশে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। ভাবতে পারবেন না, তখন ওঁর মুখের চেহারা কী কদর্য হয়ে উঠেছিল। বিফল হয়ে ফিরে এলাম। তারপর কে কী ভাবে ওটা হাত সাফাই করল, বিশ্বাস করুন, আমার জানা নেই।
–মানছি আপনার প্রতিটি কথা সত্যি, চাবিটা স্বস্থানে রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন, তার মানে আপনার শ্বশুর আপনাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। তাই স্যার ক্লড অন্ধকার ঘরে আসল চোরকে ফর্মুলা ফিরিয়ে দেবার সুযোগ দিলেন, তখন আপনি আপত্তি করলেন না, তাইতো?
এছাড়া আমি আর কী বা করতে পারতাম, বলুন। ওঁর প্রস্তাবে সায় না দিলে শুরু হত খানাতল্লাসী, আমার কাছে তখন রয়েছে ডঃ কারোলির দেওয়া চাবি আর একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো। ওগুলোর কথা ওরা জেনে ফেলত।
–ওই কাগজের টুকরোতে কী লেখা ছিল?
–ডঃ কারোলির নিজের হাতে লেখা কয়েকটি শব্দ–যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছি, সেটা তুমি করেছ?
-থামবেন না, এগিয়ে যান।
–দুম করে ঘরের আলোগুলো নিভে গেল। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গুপ্ত জায়গা থেকে চাবিটা ছুঁড়ে দিলাম, গিয়ে পড়ল ওইখানে। লুসিয়া আঙুল তুলে দেখাল, অর্থাৎ গত সন্ধ্যায় এডওয়ার্ড রেনর সে চেয়ারে বসেছিল, তার তলাটা।
–আর কারোলির লেখা কাগজের টুকরোটা? ওটা কী করলেন?
-ওটা আমার কাছেই ছিল, আমার জামার পকেটে লুকিয়েছিলাম। আজ সকালে পকেট থেকে বের করে এই বইটার ভেতর রেখে দিয়েছি।
টেবিলের ওপর থেকে নির্দিষ্ট বইটির পাতা উলটে কাগজটা বের করে লুসিয়া এগিয়ে দিল পোয়ারোর দিকে।
-না না, ওটা আমার লাগবে না। আপনার কাছেই থাক।
লুসিয়া কাগজের টুকরোটাকে কুচিয়ে হাতব্যাগে রেখে দিল।
–আর একটা প্রশ্ন আছে। পোয়ারো জানতে চাইলেন, আপনি কি কাল সন্ধ্যায় অন্ধকারের মধ্যে আপনার জামা ছিঁড়ছিলেন?
–জামা! আমি! না না, ওসব করার দরকার পড়েনি। লুসিয়া অবাক হল।
–ও, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই পোশাক ছেঁড়ার আওয়াজ শুনেছিলেন?
-হ্যাঁ, শুনেছিলাম। লুসিয়া একটু ভেবে জবাব দিল, আমিও অন্ধকারের মধ্যে পোশাক ছেঁড়ার আওয়াজ শুনেছিলাম। হবে হয়তো পিসিমা বা বারবারার কাজ, তবে আমি নই।
হুঁ, স্যার ক্লডের কাপে গত সন্ধ্যায় কে কফি ঢেলে দিয়েছিল, বলতে পারেন, মাদাম?
-কেন বলতে পারব না? আমি নিজেই তো ঢেলেছিলাম। লুসিয়ার সোজা জবাব।
–নিজের কাপের পাশে টেবিলে ওটা রেখেছিলেন তো?
–হ্যাঁ।
ব্ল্যাক কফি পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কী করলেন? হিসকোসিন বিষটা কোন কাপে মিশিয়ে ছিলেন, মাদাম?
তীর খাওয়া পাখির মতো লুসিয়া আঁতকে উঠল, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে তার শরীর–একথা কে বলল…
মাদাম, পোয়ারো মোলায়েম সুরে বললেন, ভুলে যাবেন না, আমি একজন। গোয়েন্দা, সব কিছু জানাই আমার কাজ। এমনকি লোকে যা দেখতে পাচ্ছে না, আমার কঠিণ দৃষ্টিতে তার ধরা পড়ে। বাদ দিন, দেরি না করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন, কোন কাপে মিশিয়ে ছিলেন?
–আমার কাপটাতে…..লুসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
–আমার কাপে। কথাটা বুঝি পোয়ারোর বিশ্বাস হল না। জানতে চাইলেন, কিন্তু কেন, মাদাম?
আমি নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিলাম না, তাই। ডঃ কারোলির আসল উদ্দেশ্য রিচার্ডের কাছে ছিল অজানা। ওর ধারণা, আমার সাথে ডঃ কারোলির অবৈধ প্রণয় আছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, ওই লোকটা আমার চক্ষুশূল, একদণ্ড ওঁকে সহ্য করতে পারতাম না। অবশেষে যখন ওঁর কথামতো ফর্মুলা চুরি করতে অসফল হলাম, তখন অসহায় বোধ করলাম। একটা ভয় আমার আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল নিশ্চয়ই ডঃ কারোলি রিচার্ডকে সব বলে দেবে। তখন রিচার্ডের সামনে কোন মুখে দাঁড়াব। তাছাড়া ওর বাড়ির লোকেরা? ছেড়ে কথা বলবে না। তাড়িয়ে ছাড়বে।