পোয়ারো চুপ, কেবল আলতোভাবে ঘাড় নাড়লেন, লুসিয়া বুঝি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
-কিন্তু মাদাম, পোয়ারো সামান্য ঝুঁকে পড়ে চোখ ছোট করে জানতে চাইলেন, আপনি যে কখনোই জেনোয়াতে যাননি, তাহলে..
আচমকা ধরা পড়ে যাওয়ায় লুসিয়া নিজেকে গুটিয়ে নিল। পোয়ারোকে নিরীক্ষণ করতে থাকল। আর পোয়ারো? তিনি পকেট থেকে নোটবইটা আবার বের করলেন বটে, পরক্ষণে সেটা জ্যাকেটের চোরা পকেটে রেখে দিলেন।
-কই, ফটোটা দেখান তো?
লুসিয়ার প্রশ্নের জবাবে পোয়ারো বললেন তা সম্ভব নয়, কারণ আমার কাছে কোনো ফটো নেই। সত্যি বলছি, তবে কুখ্যাত গুপ্তচর সেলমা গেতজ যে গতবছর নভেম্বরে জেনোয়ার বন্দী শালায় মারা গেছে, এ তথ্য নির্ভুল। সত্যি বলেই জানবেন। আর বাদবাকি যা বলেছি, অর্থাৎ আমার ওই ফটোগ্রাফার বন্ধু আর তার ফটো–এসব সবই আমার মনগড়া গল্প ছিল।
তার মানে আমার পেটের কথা বের করার এটা আপনার একটা মতলব, তাই না?
–হ্যাঁ, পোয়ারো সামান্য হাসলেন, মাফ করবেন, এই টোপ না ফেললে আপনার আসল পরিচয় জানতে পারতাম না।
কিন্তু এসবের সঙ্গে স্যার ক্লড অ্যামরির হত্যার কী সম্পর্ক, বলতে পারেন? লুসিয়া চাপা গলায় জানতে চাইল।
শুনেছি, পোয়ারোর কণ্ঠস্বর গম্ভীর, কিছুদিন আগে আপনার একটা দামী হীরের নেকলেস হারিয়ে গিয়েছিল, খবরটা কি ঠিক?
লুসিয়া পোয়ারোর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল–আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি। বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, স্যার ক্লডের মৃত্যুর সাথে এর কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক তো আছেই, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার দামী হীরের নেকলেস, কদিন বাদে স্যার ক্লডের মূল্যবান ফর্মুলা উধাও দুটোর কোনোটাই অদামী নয়, আপনি অস্বীকার করতে পারেন?
-আপনি কী বলতে চাইছেন, মঁসিয়ে? লুসিয়ার মুখ ফ্যাকাশে। বুকে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেছে।
–না বোঝার মতো তো কিছু নেই, মাদাম। জলের মতো সোজা ব্যাপার। পোয়ারো গম্ভীর হলেন। বলুন, ডঃ কারোলি আপনার কাছে এবার কত টাকা দাবি করেছিলেন?
টাকা–কেন? কেন? লুসিয়া ছিটকে সরে যেতে যেতে কোনো রকমে বলল।
-বুঝতে পারছি, আপনি ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন।
-কখখনো নয়। সেই থেকে আপনি আবোল-তাবোল বলে চলেছেন। বুঝতে পারছি না, ডঃ কারোলিকে টাকা দেওয়ার প্রশ্নটা আসছে কোত্থেকে?
–আপনাদের দুজনের মঙ্গলের জন্য। সর্বোপরি ডঃ কারোলিও যাতে মুখ না খোলেন, তার ব্যবস্থা হিসাবে। কুখ্যাত নারী গুপ্তচর বাহিনীর সেলমা গেতজ-এর সুন্দরী কন্যা আভিজাত অ্যামরি পরিবারের ঘরণী হয়েছে, এই ঘৃণিত খবরটা পাঁচ কান হয়ে গেলে সর্বনাশ। আপনারা দুজনেই জানেন বাড়ির কেউ ব্যাপারটা মেনে নেবেন না। তাই আপনারা একটা রফা করলেন। ডঃ কারোলি টাকার বিনিময়ে আপনাকে সুখ দিলেন। আপনি হলেন ওঁর ব্লাকমেলের শিকার। ব্যস, এই পর্যন্ত।
লুসিয়া বড় বড় চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাল, যেন আগুন ঝরে পড়ছে। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে নিল। দু-হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। মিনমিনিয়ে বলল–রিচার্ডকে এসব জানিয়েছেন নাকি?
-না, এখনও ওনাকে কিছু জানানো হয়নি।
-দোহাই আপনার, ওকে কিছু বলবেন না। লুসিয়া তখন অসহায় হয়ে পড়েছে। হাত জোড় করে আকুতি জানান, মঁসিয়ে পোয়ারো, রিচার্ডকে কিছু বলবেন না। আমার অতীত ওদের বংশগরিমাকে কালিমালিপ্ত করবে। ও আমার আসল পরিচয় জানে না। ইচ্ছে করেই বলিনি। কী করব বলুন। এছাড়া ভালো মতো বেঁচে থাকার উপায় আমার জানা ছিল না। তখন আমি আমার নিদারুণ দুর্ভাগ্যকে বহন করে চলেছি। সহায়-সম্বলহীন এক মেয়ে। মায়ের ঘৃণিত জীবন আমাকে সর্বদা কুরে কুরে খেত। বিশ্বাস করুন, সর্বদা ভাবতাম, কীভাবে এই অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু হায়, কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে ঈশ্বর বুঝি সদয় হলেন। দুরারোগ্য ক্যানসারে মায়ের মৃত্যু হল। শোক হলনা, বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্তরাত্মা উল্লসিত হল। এই ঘটনার কিছুদিন পর রিচার্ডের সাথে আমার দেখা হল। তারপর পরিচয়, প্রেম এবং অবশেষে বিয়ে। কিন্তু আমার ঘৃণিত অতীত কাহিনী সাহস করে ওকে বলতে পারলাম না। অথচ মনের মধ্যে চলছে দোলাচল। এক গুপ্তচর নারীর রক্ত আমার ধমনীতে, একথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারতে পারলাম না। অতএব…..।
বুঝলাম, পোয়ারো গম্ভীর গলায় বললেন, আপনাকে বধুবেশে রিচার্ড নিয়ে এলেন এই বাড়িতে। দাম্পত্য জীবন বেশ সুখেই কাটছিল। হঠাৎ একদিন ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন ডঃ কারোলি। তিনি আপনাকে চিনতে ভুল করেননি। গুপ্তচর সেলমা গেতজের সুন্দরী কন্যা স্যার ক্লড অ্যামরি পরিবারের বউ–উনি তখন আপনাকে ভয় দেখাতে শুরু করেন। টাকার দাবি করেন। আপনি যদি ওঁর দাবি না মেনে নেন, তাহলে সবকথা ফাঁস করে দেবেন। সর্বক্ষণ এই কথা বলে আপনাকে উত্যক্ত করে তুলত, তাই না?
-আপনার অনুমানই ঠিকই, কিন্তু অত টাকা আমি কোথায় পাব লুসিয়া গড়গড় করে বলে চলল, কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দামী হীরের নেকলেসটাই বিক্রি করতে হল, ওটা রিচার্ড আমায় উপহার দিয়েছিল বুঝলেন। ডঃ কারোলিকে শান্ত করলাম, কিন্তু ডঃ কারোলির ওই টাকাতে পেট ভরে নি, তার আরও চাই। গত সন্ধ্যায় উনি এ ঘরে এসে হাজির হলেন, সকলের সামনে এমন ভান করলেন, যেন উনি আমার পরিবারের বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী। রিচার্ডের বাবা আর পিসিমা ওর মন গলানো কথাবার্তায় ভিজে গেলেন। তারা তাঁকে এই পরিবারে কদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। ডঃ কারোলির তখন পোয়া বারো। তিনি তখন বড় দাও মারার জন্য ঠুকঠুক করছেন। স্যার ক্লড যে মারাত্মক শক্তিশালী পরমাণু বোমার ফর্মুলা আবিষ্কার করেছেন, এখবরটা ওঁর কানে পৌঁছে গিয়েছিল, জানি না, কে বলেছিল। উনি আমাকে সেই ফর্মুলা চুরি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকলেন।