ডিনারের শেষে ডেসার্ড পরিবেশনের পালা। ট্রেডওয়েল এগিয়ে এল। ঠিক এই সময় স্যার ক্লড বাটলারকে উদ্দেশ্য করে সবাই যাতে শুনতে পায়, এমন কণ্ঠস্বরে বললেন ট্রেডওয়েল, ম্যাকসনের গ্যারেজে একবার ফোন কর। রাত আটটা পঞ্চাশের ট্রেনে লন্ডন থেকে আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক আসবেন। স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর।
এখুনি ফোন করছি, স্যার ক্লড। ডেসার্ডের পাত্র টেবিলের মাঝখানে রেখে ট্রেডওয়েল কয়েক পা পিছনে সরে গেল।
ঠিক এই সময় লুসিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল–কিছু মনে করবেন না, দুঃখিত, আমাকে এবার উঠতে হচ্ছে। কথা শেষ করে কোন দিকে না তাকিয়ে লুসিয়া পা ফেলে এগোল। ঘটে গেল এক সংঘর্ষ–ট্রেডওয়েল ও লুসিয়া।
লুসিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে পথ ছেড়ে দিল। ট্রেড-ওয়েল ডিনার হল থেকে বেরিয়ে গেল।
লুসিয়াও সেখান থেকে অদৃশ্য হল। সিঁড়ি টপকে নেমে এল নীচে, বসার ঘরে। স্যার ক্লড-এর স্টাডিরুম এর পাশেই। মাঝের দরজা দিয়ে ঢোকা যায়। এ ঘরে আছে ফায়ার প্লেস, বেশ বড় সড়ো। ম্যান্টেলপিসে রাখা দম দেওয়া ঘড়িটা বনেদিয়ানার পরিচায়ক, রয়েছে ফুল রাখার একটা পাত্র, অবশ্য ফুলের পরিবর্তে রয়েছে মোমবাতি আর কাগজের টুকরো, যা ফায়ার প্লেসের কাঠে আগুন ধরাতে ব্যবহার করা হয়।
বসার ঘরকে লাইব্রেরী বলা চলে। ঢাউস সাবেকি একটা বইয়ের শেলফে অসংখ পুরনো আমলের বই সাজিয়ে রাখা আছে। শেলফের ওপারের তাকে একটা খালি টিনের বাক্স। ডেক্সের ওপর টেলিফোন, সামন টুল, বসে কথাবলার জন্য। খানিক দূরে ছোট টেবিলের ওপর পুরনো একটা গ্রামোফোন ও কিছু রেকর্ড। সাবেকি কফি টেবিলও রয়েছে। একটা বড় মাপের টেবিল রয়েছে, কয়েকটা ছাপানো বই একপাশে সাজানো। দুটো সাদামাটা চেয়ার, আর একটা আরামকেদারা রয়েছে জানলার পাশে, মন চাইলে পা ছেড়ে আরাম করা যায়। ছোট্ট একটা চারা গাছ বোতল-টবে সাজিয়ে ছোট টেবিলের ওপর রাখা। এই হল অ্যামরি পরিবারের বসার ঘরের আসবাবপত্রের বর্ণনা। এখানে সবকিছুই সাবেকি, কিন্তু প্রাচীন বা অ্যান্টিক বলা যায় না।
রিচার্ড অ্যামরির স্ত্রী লুসিয়া চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক সুন্দরী তরুণী। ঘন কালো ডগা ছাঁটা চুলগুলো কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। অত্যন্ত চাপা তার চোখের চাউনি, যা আবেগে অবর্ণনীয় ভাবে জ্বলছে।
ত্রস্ত চরণে সে বসার ঘরের ঠিক মাঝখানে চলে এল। ফ্রেমে বাঁধানো জানলার পর্দা সরাল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাতের কালো আকাশের দিকে, অসংখ্য তারা মিটিমিটি জ্বলছে।
ইতিমধ্যে ডিনার হল থেকে পিসিমা ক্যারোলিন বেরিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সোজা বসার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ফায়ার প্লেসের আগুনে ঘরে আবছা আলোর সৃষ্টি হয়েছে।
ক্যারোলিন দ্রুত পায়ে লুসিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে একপ্রকার জোর করে জানলা থেকে সরিয়ে আনলেন। একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। বললেন এখানে শান্ত হয়ে বসো, ক্যারোলিন বুঝি লুসিয়ার মা, এমনই শাসনের সুরে বললেন–দুমিনিট সময় দাও, দেখবে সুস্থ লাগবে।
-সত্যিই তাই, পিসিমা, লুসিয়ার কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সুর, কিন্তু মুখে বিষণ্ণতার ছোঁয়া ওটা আর হবে না। ইংরাজি তার মাতৃভাষা নয়, তার আনাড়ি কথা শুনলেই বোঝা যায়।
তোমার ফিটের অসুখ আছে জানি। তুমি বেরিয়ে আসতেই আমার সন্দেহ হল। তাই তো পেছন পেছন সোজা এখানে চলে এলাম, ক্যারোলিন বলতে থাকলেন, এসে দেখলাম সত্যিই তাই। ভাগ্যিস আমি এসে পড়েছিলাম, যেভাবে আকাশের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ছিলে…… টেনে হিঁচড়ে ওখান থেকে সরিয়ে আনতে বাধ্য হলাম। লুসিয়া, সোনা আমার বিশ্বাস কর, কোন কুমতলবে আমি এখানে আসিনি।
–পিসিমা, ওভাবে বলবেন না, লজ্জিত হল লুসিয়া। ভাগ্যিস আপনি টের পেয়েছিলেন, তাই ছুটে এলেন, নয়তো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকতে হত আমায়। তবে একটা কথা আমি বুঝে পাই না, কেন যখন-তখন আমি ভিরমি যাই বলুন তো?
কথা বলতে বলতে লুসিয়া তার হাতব্যাগ থেকে রুমাল বের করল, ওতে ওষুধ মাখানো আছে। নিজের চোখে মুখে ভাল করে রুমালটা দিয়ে মুছে নিল, আবার সেটা সম্মুখে রেখে বলল–পিসিমা, আপনি এখন নিশ্চিন্তে ওপরে যান। আমিও আসছি।
তুমি আমায় এড়িয়ে যেতে চাইছ, ক্যারোলিনের গলায় কতৃত্বের সুর, বিকেলবেলাতেই আমি লক্ষ্য করেছি, তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে, বেশ ভালোরকম, বুঝেছি ইটালি! হাতব্যাগটা পাশে সরিয়ে রেখে লুসিয়া বলল–ইটালি–তা?
–এ আর নতুন কথা কি হল, বাছা, ক্যারোলিনের স্নেহের হাতের পরশ তখন লুসিয়ার গায়ে মাথায় খেলে বেড়াচ্ছে, নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘর-সংসার করছে, মন তো খারাপ হবেই। আমি কি তা জানি না?
–পিসিমা, আপনার ধারণা ভুল। আপনি কিছু জানেন না লুসিয়া বেশ জোরালো কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, ইটালির জন্য মন আমার খারাপ হয় না। আমি সে দেশের কথা ভুলে গিয়েছি, কখনো মনে পড়ে না।
লুসিয়ার কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। সে তখনও চেঁচিয়ে বলে চলেছে ইটালির প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নেই। ইংল্যান্ড আমার কাছে স্বর্গসমান। এখানে কোন কিছুর অভাব নেই আমার। আপনার মতো দয়ালু আত্মীয়দের আমি পেয়েছি, স্নেহ-ভালবাসার জোয়ারে আমি সর্বদা ভাসছি। আমার আদরযত্নের প্রতি আপনাদের সজাগ দৃষ্টি আছে। একমাত্র এই দেশ ছাড়া। নাটক-উপন্যাসে স্বর্গসুখের অপূর্ব বর্ণনার কথা পড়েছি বটে, কিন্তু বাস্তবে তা দেখতে পাচ্ছি।