-না, আর কিছু নয়। সাক্ষাতে সব কথা হবে। অনেক ধন্যবাদ, মিঃ পোয়ারো। আজ রাখছি, গুড ডে।
–গুড ডে, স্যার ক্লড। ঘটাং করে ক্রেডেলের ওপর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন খুঁদে গোয়েন্দা। ভৃত্যের খোঁজ করলেন।
জর্জ সামনে এসে দাঁড়াল।
-শোনো জর্জ, ড্রাই ক্লিনিং-এ এক্ষুনি যাও। আমার ভারী টুইডের স্যুট, ডিনার জ্যাকেট আর দুটো ট্রাউজার্স কাঁচতে দিয়ে এস। শুক্রবার রাতের মধ্যে ওগুলো আমার চাই, অন্যথা যেন না হয়। ওদের কথাটা বলে আসবে। ওখান থেকে এসে আমার পুরনো সার্ভিস রিভলভার দুটোর নলকে পরিষ্কার করে রেখ। ভুল যেন না হয়।
জর্জ ঘাড় নেড়ে বিদায় নিল।
পোয়ারো টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। নাম্বার ডায়াল করলেন ওপ্রান্ত থেকে সাড়া এল, চেনা গলা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস? আমি বলছি, হারে বাপু হা, এরকুল পোয়ারো। ক্যাপ্টেন, তুমি আমার খোঁজ খবর রাখ না জানি, কিন্তু তুমি যে ফসল বেচতে লন্ডনে এসেছ, সে খবর আমার কাছে আছে। শহর থেকে এসময় লোকে হাওয়া পরিবর্তনের জন্য গ্রামে ঘুরতে বেড়াতে যায়। প্রকৃতি এই সময় নবসাজে ফুলে ফলে সেজে ওঠে, যেন অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ। এই শনিবার শহরে যাচ্ছি। অন্যবারের মতো নিশ্চয়ই তুমি আমার সঙ্গী হবে, তাই তো?
.
০২.
শুক্রবার। একটু আগে সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশে একটি দুটি তারার ভিড় শুরু হয়েছে।
অ্যারটস ক্লিভ। স্যার ক্লডের পৈত্রিক বাড়ি। একতলায় পূর্বদিকের ঘরটি তার স্টাডি। তিনি চুপ করে বসে আছেন।
ক্লডের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল বাটলার ট্রেডওয়েল।–মাফ করবেন, স্যার ক্লড। ডিনারের ঘণ্টা বেজে গেছে। আপনি যাচ্ছেন না দেখে ডাকতে এলাম মনে হয় আওয়াজ শুনতে পাননি।
-ট্রেডওয়েল, তোমার অনুমান ঠিক। মাথা না তুলে স্যার ক্লড বলতে থাকলেন। ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম, তাই ঘণ্টাধ্বনি কানে পৌঁছয়নি। বাড়ির অন্যান্যরা নিশ্চয়ই ডিনার টেবিলে পৌঁছে গেছে। তুমি যাও, আমি হাতের কাজটা সেরে যাচ্ছি।
ট্রেডওয়েল নিঃশব্দে বিদায় নিল।
স্যার ক্লডের বুকের খাঁচা থেকে উঠে এল স্বস্তির নিঃশ্বাস। উঠে দাঁড়ালেন। ডেক্স-এর ড্রয়ার টানলেন। হাতে তুলে নিলেন একটা নোটবুক, টেলিফোন নম্বর লেখা। পাতা ওল্টালেন। হ্যাঁ, এই নম্বর। ফোনের বোতাম টিপলেন–হ্যালো এক্সচেঞ্জ? ৩১৪ নম্বর মার্কেট ক্লিভ থেকে বলছি, লন্ডনের এই নম্বরে কথা বলতে চাই।
ফার-লন্ডন শহর থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে, দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান। এ অঞ্চলটা আগে অজ পাড়া গাঁ ছিল। ধীরে ধীরে কলকারখানা গড়ে উঠেছে, বেড়েছে মানুষের বসতি। এমন কি কয়েকটি বড় বড় অট্টালিকাও তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ভারিক্কী চেহারা লাভ করেছে। ফার-এর মার্কেট ক্লিডেলের গায়ে এখন গরীব তকমা পড়েছে।
স্যার ক্লড অ্যামরির পিতা-পিতামহ ছিল এখানকার জমিদার। সেই কোন কালে তারা এখানে প্রাসাদসম অট্টালিকা গড়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন অ্যাবটস ক্লিভ। তাদের শিল্প সৌন্দর্যের তারিফ করতে হয়। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। সর্বত্র। মস্ত ফটক। নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে বাড়িতে ঢোকার দরজা পর্যন্ত। পথের দুপাশে নানা রকম গাছ আর ঝোপঝাড়। বাড়ির পেছনে ঢালু লন দীর্ঘ বারান্দার নীচ দিয়ে চলে গেছে। লনের শেষে বাগান, অযত্ন ও অবহেলায় আজ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
স্যার ক্লড অ্যামরি খাবার ঘরে এসে ঢুকলেন। ডিনার টেবিলের একপ্রান্তের চেয়ারে বসলেন। তার হোটবোন ক্যারোলিন অ্যামরি। অবিবাহিতা। দাদার-স্ত্রী মারা যাবার পর এসংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাই বিয়ে করে ঘর-সংসার করা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি, ক্যারোলিনা মনে মনে তাই ভাবেন। আসলে তিনি বহুবল্লভা, নিত্য নতুন পুরুষসঙ্গীকে প্রেম নিবেদন করেন।
ক্যারোলিন বসেছেন দাদার মুখোমুখি অন্যপ্রান্তের চেয়ারে। রিচার্ড–স্যার ক্লডের একমাত্র ছেলে। সে বাবার ডানদিকের আসনে, তার পাসে ক্লডের ভাইঝি বারবারা। ডঃ কারেলি বর্তমানে অ্যামরি পরিবারের অতিথি, জাতে ইটালিয়ান, একটু তফাতে। এডওয়ার্ড রেনর–স্যার ক্লড-এর সেক্রেটারি, ক্যারোলিনের ডানপাশে বসেছে। লুসিয়া-ক্লডের পুত্রবধূ, রিচার্ডের স্ত্রী, রেনরের পাশের চেয়ারটিতে তাকে দেখা যাচ্ছে।
স্যার ক্লড দুপুর ও রাতের খাবার মুখ বুজে খেয়ে নেন–এটা তার স্বভাব। আজও তার অন্যথা হল না। অথচ অন্য সাতজনের মুখেও নেমেছে ঘোর অমানিশা। কোন কথা না-বলে যে যার খাওয়া সেরে নিলেন।
পুরুষ মানুষের সঙ্গ না পেলে ক্যারোলিনের আবার পেটের খাবার হজম হয় না। পারিবারিক অতিথি ডঃ কারোলির কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনরের সঙ্গে ফস্টি-নষ্টি শুরু করলেন।
এডওয়ার্ড নিরীহ গোবেচারা গোছের মানুষ। নোংরা ইয়ার্কি তার পছন্দ হয় না। হঠাৎ বিষম খেল। এক গ্রাস ঢক্ করে খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ক্যারোলিনের কাছে ক্ষমা চাইল।
পিসিমার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন বদরসিকতা, বিশেষ করে ওই গোবেচারা মানুষটার সঙ্গে, রিচার্ড মোটেও সহ্য করতে পারছিল না। সে বারে বারে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছিল, অর্থাৎ পিসিমাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা কর। কিন্তু বেচারী লুসিয়া, ব্যাপারটা এখন আর তাই হাতের মধ্যে নেই, অতএব চুপ করে থাকতে হল।