নিশ্চয়ই, মাসিয়ে অ্যামরি। চেয়ারে হেলান দিয়ে পোয়ারো নড়েচড়ে বসলেন, আপনার বলা ঘটনাগুলো এখন পরস্পর ছবির মতো আমার চোখের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তো, স্যার ক্লড অ্যামরি ওই আরাম কেদারায় বসেছিলেন, এখন আপনি যেটাতে বসে, তারপর একসময় সারা ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল, বাইরে থেকে দরজায় ঢোকার শব্দ, আপনাদের কানেও গেল। সত্যি, এ এক নাটকীয় ক্ষণ স্বীকার করতেই হয়।
–তাহলে আমার কাজ শেষ, যা জানতে চেয়েছিলেন জানা হয়ে গেছে আপনার। আমি এখন
কথা বলতে বলতে রিচার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
পোয়ারো ইশারায় তাকে বসিয়ে দিলেন–আরে, বসুন, বসুন, আরও কিছু জানার আছে।
-বেশ বলুন, কি জানতে চাইছেন? রিচার্ড পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল, যা-যা চেয়েছিলেন, সব তথ্য তো পেয়ে গেছেন।
-না, গতকাল সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি কি ঘটেছে, তা জানা বাকি থেকে গেছে। আমি বলতে চাইছি, ডিনারের ঠিক পরেই কি ঘটেছিল, বলুন।
–আচ্ছা বলছি, একটু হেসে রিচার্ড বলল, আসলে মামুলি ব্যাপার, তাই আপনাকে বলার প্রয়োজন করিনি। তবে আপনার না জানলেই যখন নয়, তখন বলছি, ডিনারের পরে আমরা সবাই এই বসার ঘরে এসে ঢুকি, আর বাবা তার সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনরকে নিয়ে তার স্টাডিতে চলে গেলেন।
–তারপর আপনারা কি করলেন?
–কি আর করব, ডিনারের পরে যেমনটি হয়ে থাকে। সকলে মিলে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলাম। মেয়েরা পরচর্চা পরনিন্দায় মেতে উঠল। আমার খুরতুতো বোন বারবারাকে তো দেখেছেন। বড্ড খেয়ালি। পুরনো আমলের গুচ্ছের খানেক রেকর্ড বের করল। ফক্সট্রট রেকর্ডটা পছন্দ হল। গ্রামোফোনে লাগিয়ে দিয়ে বাজনার তালে তালে নাচতে শুরু করে দিল। খানিকবাদে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এডওয়ার্ড রেনর ওর নাচের সঙ্গী হল। ওরা একসঙ্গে নাচতে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা সেই সন্ধ্যায় কি ঘটেছিল? পোয়ারো সন্ধানী দৃষ্টিতে রিচার্ডকে জরিপ করতে লাগলেন, মনে করার চেষ্টা করুন, মঁসিয়ে অ্যামরি। দেখুন, তেমন কিছু বাদ চলে গেল কিনা।
না, মনে রাখার মতো কিছু ঘটেনি, রিচার্ড চটপট জবাব দিল, যা বললাম, ওই পর্যন্তই।
-ডিনারের কত পরে কফি পরিবেশন করা হয়েছিল?
–ডিনারের ঠিক পরেই।
–বাটলার ট্রেডওয়েল নিজে কফি তৈরি করে এনেছিল, নাকি জগ ভরতি কফি দিয়ে গিয়েছিল?
-মনে নেই।
–ঘরের সকলে কফি পান করেছিলেন?
পোয়ারোর প্রশ্নের জবাবে রিচার্ড তড়িঘড়ি জবাব দিল–হ্যাঁ, সকলেই তবে একজন ছাড়া এডওয়ার্ড রেনর, কফি ওর চলে না।
–আর আপনার বাবা? ওনার কফি কি স্টাডিতে দিয়ে আসা হয়েছিল?
-হ্যাঁ, তেমনই মনে পড়ছে এবার রিচার্ড সত্যিই বিরক্ত হল। জানতে চাইল, এসব সাদামাটা ব্যাপার শুনে আপনার কোন কাজে লাগবে?
-মঁসিয়ে অ্যামরি, বুঝতে পারছি, আপনি আমার ওপর চটে যাচ্ছেন। পোয়ারো একটু থামলেন–আসলে কি জানেন, আপনার মুখ থেকে শোনা ঘটনাগুলো আমার মনের ক্যানভাসে ছবি করে ধরে রাখতে চাইছি। তার চেয়েও জরুরি যেটা সেটা হল আপনার বাবার চুরি হয়ে যাওয়া ফর্মুলা উদ্ধার, আপনারা সকলে তো তাই-ই চান, নয় কি?
-মনে হয়। রিচার্ড অবহেলা ভরে উত্তর দিল। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই, আমরা সকলেই চাই ফর্মুলাটা ফেরত পেতে।
–বেশ, পোয়ারো খুশি মনে জানতে চাইলেন, স্যার ক্লড অর্থাৎ আপনার বাবা কখন। স্টাডি থেকে এঘরে এসে ঢুকেছিলেন?
-ওরা যখন দরজাটা খোলার চেষ্টা করছিল, তখন।
–ওরা, অর্থাৎ কারা?
ঘরের সকলে।
–কে প্রথম দরজা খুলতে চেয়েছিলেন, মনে আছে?
-মনে আছে, আমার স্ত্রী লুসিয়া, রিচার্ড বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল, সমস্ত সন্ধ্যেটা ও অসুস্থ বোধ করছিল তাই।
উনি এখন কেমন আছেন? আশা করি গতকালের তুলনায় ভাল। পোয়ারোর কণ্ঠে সহানুভূতির ছোঁয়া তার সাথেও কয়েকটা কথা বলতে চাই।
-মনে হয় না, আপনার চাওয়া পূরণ হবে। ব্যস্ত হয়ে রিচার্ড জবাব ছিল–আজ সকাল থেকে মুখ টিপে বসে আছে, চেনা অচেনা কারো সঙ্গে একটি কথাও বলছে না। তার নীরবতার কারণও বলছে না। আমার মনে হয় না, এমন কোন প্রশ্নের উত্তর কেবল এর জানা আছে। আপনি বরং আমায় প্রশ্ন করুন। বলুন আর কি জানতে চান।
-বুঝেছি, পোয়ারো ঘাড় কাত করে বললেন–তবে কি জানেন মঁসিয়ে মেয়েদের একটা স্বভাব। যা পুরুষদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যা পুরুষদের নজরে পড়ে না, অথবা পড়লেও গুরুত্ব দেয় না। ছাড়ুন ওসব কথা। আপনার পিসিমার খবর বলুন। প্রয়োজনে ওঁকেও আমি প্রশ্ন করতে পারি।
পিসিমার কথা কি আর বলব, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার মা গত হবার পর থেকে পিসিমাই আমাদের সংসারটাকে ধরে রেখেছেন। ভাইয়ের আচমকা মৃত্যু, কোন বোন সহ্য করতে পারে বলুন। গতকাল রাত থেকে বিছানাই হয়েছে তার পরম আশ্রয়। ট্রেডওয়েল বহুবছর ধরে এ বাড়িতে আছে। পিসিমার ভাবগতিক তার জানা আছে। সে জোর করে সকালের ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে এসেছে। লাঞ্চও তার ঘরে দিয়ে এসেছিল।
–এরকমই হবার কথা। পোয়ারো আবার ঘাড় নেড়ে রিচার্ডের কথায় সায় দিলেন।
আরাম কেদারা ছেড়ে রিচার্ড এগিয়ে গেল ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর দিকে। দুটোই বন্ধ। রিচার্ড বলল–ভেতরটা বড্ড গুমোট হয়ে আছে, বাইরের খোলা বাতাস ঢুকলে ভাল হয়।