ট্রেডওয়েল চলে যেতে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আরাম কেদারায় বসলেন। কিছুক্ষণ বাদেই ট্রেডওয়েল এসে ঢুকল, ব্রেক ফাস্ট চিলতে সরু টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিল।
–মশিয়ে পোয়ারোর কি খবর? কোন হাঁকডাক শুনতে পাচ্ছি না, হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন, এখনও ঘুম ভাঙেনি, নাকি ঘরের মধ্যে বসে আছেন?
সেসব কিছুই না, স্যার। ট্রেডওয়েল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে চলল, উনি অনেকক্ষণ আগে বিছানা ত্যাগ করেছেন। ব্রেক ফাস্ট সেরে এই একটু আগে গ্রামের দিকে গেলেন, কি যেন দরকার আছে।
-হুম, একটা গম্ভীর আওয়াজ করলেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। দেখলেন, বারবারার কফি পান এখনও চলছে। তিনি এবার খবরের কাগজে মন দিলেন। স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যু সংবাদ নিশ্চয়ই কাগজে ছাপা হয়েছে–শোকসংবাদ কলমে চোখ বোলালেন, না, কিছুই বেরোয়নি। সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়তে শুরু করলেন। খানিকবাদে তার তন্দ্রা এল দু’চোখের পাতায়, ঢুলে পড়লেন, চোখ মেলার চেষ্টা করলেন, ধীরে ধীরে হাত থেকে খবরের কাগজটা আপনা-আপনি পড়ে গেল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর খেয়াল নেই, তিনি তখন নরম রোদের আভা লাগিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছন।
এর পর কেটে গেল প্রায় তিরিশ মিনিট।
-বাঃ, দারুণ। এই সাত সকালে খবরের কাগজ ছেড়ে দিয়ে কিভাবে যে মানুষ ঘুমোয় জানি না।
পরিচিত কণ্ঠস্বর। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকালেন, দেখলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে এরকুল পোয়ারো, ঠোঁটে স্মিত হাসি।
-কে বলল, আমি ঘুমোচ্ছি! ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন, আমি ঘুমোইনি, আসলে ব্রেকফাস্ট সেরে কাগজে চোখ রেখে ভাবছিলাম, কাল সন্ধ্যে থেকে অব্দি এখানে যা যা দেখেছি, সেইসব ঘটনা পরম্পরা হয়তো বা তন্দ্রা লেগেছিল একটু।
-তন্দ্রা আসতেই পারে, এ অস্বাভাবিক কিছু নয়। পোয়ারো বললেন, শুধু স্যার ক্লডের খুন নয়, ওই সঙ্গে ওঁর ফর্মুলা চুরির ব্যাপারটাকেও মাথায় রাখতে হবে, হেস্টিংস প্রথমটার মতো দ্বিতীয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
-তাইতো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন, কতটা কাজ হল?
–সামান্যই, একজনকে আমি সন্দেহ করছি, জানি না ঠিক কিনা। পোয়ারো বলতে থাকলেন। সন্দেহটাকে মজবুত করার জন্যই গ্রামে গিয়ে ছিলাম একা। দেরি নেই, মনে হয় টেলিফোন মারফত খবর আসবে। তখন বলা যাবে, ঠিক পথে এগোচ্ছি কিনা।
–দোষী বলে কাকে তোমার মনে হচ্ছে পোয়ারো? ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন।
–ধীরে বন্ধু, ধীরে, পোয়ারো সামান্য হেসে জবাব দিলেন–এ বড় প্যাচানো গেরো, আনমনে দূরের দিকে তাকালেন। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেল অনেক দূর, বললেন, খোলার উপায় তাড়াতাড়ি বলা যাবে না। তুমি বরং চোখ কান খুলে রেখে সব কিছু শুনে যাও, ক্যাপ্টেন, এ এক ম্যাজিক, বুঝেছ।
পোয়ারো আবার হাসলেন–বাদ দাও এসব কথা। শোনো বন্ধু, আজ দুপুরে স্যার ক্লড অ্যামরির ছেলে রিচার্ড অ্যামরিকে দেখা করতে বলেছি। ওইসময় নীচের লাইব্রেরী ঘরে থেকে আমায় সহায়তা করো। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হল। তোমার কাজ, মনে থাকে যেন।
নিশ্চয়ই, পোয়ারো। আমি সর্বদা তোমার পাশে আগেও ছিলাম, এখনও আছি, পরেও থাকব।
.
কিছুক্ষণবাদে কয়েকজন লোক এল স্থানীয় করোনারের মর্গ থেকে। ডঃ গ্রাহামের নির্দেশে তারা এসেছে, স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত দেহ নিয়ে তারা চলে গেল।
এরকুল পোয়ারো ও তার সহকারী লাঞ্চে বসে বিশেষ কিছুই খেতে পারলেন না, কারণ ব্রেকফাস্টেই পেট ভরা ছিল। অতএব সামান্য একটু চিকেন সুপ আর টোস্ট খেয়ে টেবিল থেকে উঠে এলেন।
দুপুরের খাওয়া সেরে পোয়ারো সোজা নীচে নেমে এলেন, সঙ্গে বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। তারা এসে ঢুকলেন লাইব্রেরিতে।
কিছুটা সময় কেটে গেল। দেখা গেল রিচার্ড অ্যামরিকে। পোয়ারোর কথা মতো সে এসে ঢুকল লাইব্রেরিতে। আজ সকাল পর্যন্ত যে আরাম কেদারায় স্যার ক্লডের দেহ পড়েছিল, সেখানে রিচার্ড বসল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, পোয়ারো একটা চেয়ার টেনে তার উল্টোদিকে বসলেন, কাপ্টেন হেস্টিংস সামান্য দূরে একটা চেয়ার দখল করলেন। ওদের আলোচনায় যোগ দিলেন না বটে, কিন্তু কান থাকল ওদের কথার দিকে।
পোয়ারো প্রথম কথা বলতে শুরু করলেন–মঁসিয়ে অ্যামরি, তিনি রিচার্ডের দিকে সরাসরি স্পষ্ট চোখে তাকালেন, আমি এখানে আসার আগে যা ঘটেছিল তা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই, এমনকি স্যার ক্লড কি করেছিলেন, তার মানে আপনি যা দেখেছেন, আপনার সঙ্গে তিনি কি কি কথা বলেছিলেন, সব আমায় পরপর বলুন। তবে হ্যাঁ, কোন কিছু গোপন রাখার চেষ্টা করবেন না।
গতকাল রাতে রিচার্ডকে যেমন অস্বাচ্ছন্দ্য দেখা গিয়েছিল, আজ তার উল্টো ঘটনা। এমনকি পোয়ারোর সঙ্গেও তুলনামূলকভাবে ভাল ব্যবহার করছে। পোয়ারো এখানে পৌঁছবার আগে যা যা ঘটে ছিল, এমনকি তার বাবা তাকে কি বলেছিল, সব রিচার্ড শুনিয়ে দিল। তার কথাবার্তায় এতটুকু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ল না। পোয়ারো কঠিন মুখে নিবিষ্ট চিত্তে নীরবে সব শুনলেন।
রিচার্ডের কথা বলা এক সময় শেষ হল। সে জানতে চাইল, বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে আশা করি সব ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছি?