ট্রেডওয়েলের পেছন পেছন পোয়ারোকে এগিয়ে যেতে দেখে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন–তোমরা যাও, আমি এখানেই থাকি কি বল?
হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন হেস্টিংসও তাদের সঙ্গী হলেন।
একে একে তিনজনে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে থেকে দরজার কপাট ভাল করে বন্ধ করল ট্রেডওয়েল।
এরপর কেটে গেছে কিছুটা সময়। হঠাৎ ভেতর থেকে ওই ঘরের দরজা খুলে গেল, বেড়ালের মতো অতি সাবধানে পা ফেলে ঢুকল লুসিয়া। চারপাশে তার সজাগ দৃষ্টি। না, কেউ কোথাও নেই, ঘর একেবারে ফঁকা। নিশ্চিন্ত হল। চলে এল কফি টেবিলের সামনে। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কোন মন্ত্রবলে সে এক ডাইনিতে পরিণত হয়েছে। মুখের কোমল নিরপরাধ ভাব উঠে গেছে, কুটিলতা মাখা মুখে শেয়ালের ধূর্তামি। বয়সটাও এক ধাপে বুঝি অনেকটা বেড়ে গেছে।
খুব সাবধানে নিঃশব্দে স্যার ক্লডের এঁটো কফির কাপটা তুলে নিল। এবার সে কি করবে? কিছু করার আগেই বাইরের দিকের দরজা দিয়ে পোয়ারো ঢুকে পড়লেন ভেতরে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল লুসিয়া।
কিছু মনে করবেন না, মাদাম, পোয়ারো তড়িঘড়ি কফির কাপটা লুসিয়ার থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিলেন।
–আমার ব্যাগটা যে কোথায় গেল, এক নিঃশ্বাসে লুসিয়া কথাগুলো বলল, মনে হয় এখানে রেখেছিলাম, তাই……..।
-ব্যাগ খুঁজছেন? পোয়ারোর ঠোঁটে হাসির রেখা, আপনার এ ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর একটা লেডিস ব্যাগ দেখেছিলাম খুব সম্ভবত। কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি, হা, ওইতো পড়ে আছে সোফার ওপর।
পোয়ারো নিজে ব্যাগটা তুলে এনে লুসিয়াকে দিলেন।
লুসিয়া তাকাল পোয়ারোর দিকে। একগাল মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বিদায় নিল। ভেতরের দরজা দিয়েই সে চলে গেল।
পোয়ারো কি মনে করে স্যার ক্লডের ব্যবহার করা কফির কাপটা সামনে তুলে ধরলেন, কিছুটা তলানি পড়ে আছে, নাকের কাছে এনে গন্ধ নিলেন। পকেট থেকে একটা কাঁচের নল বের করলেন। সাবধানে কিছুটা তলানি টেস্টটিউবে ঢেলে নিলেন। কর্কের ছিপি লাগিয়ে টিউবের মুখ বন্ধ করলেন। জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে সেটা চালান করে দিলেন। কাপটা যথাস্থানে ট্রে-র ওপর রেখে দিলেন। গুণে দেখলেন, ট্রে-তে মোট ছটি কাপ রয়েছে।
পোয়ারো আবার চিন্তার সমুদ্রে ডুব দিলেন। ভুরু কুঁচকে সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ তার মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বুঝিবা কোন পথ পাওয়া গেছে।
পোয়ারো আবার বাইরের দরজাটা ব্যবহার করলেন। বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে সশব্দে দরজার পাল্লা দুটো টেনে দিলেন। দুটো ফ্রেঞ্চ উইন্ডো, পুরু পর্দা লাগানো, জানলা ছাড়িয়ে নীচ পর্যন্ত ঝুলছে।
পোয়ারো নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন একটি পর্দার আড়ালে। বাইরে থেকে সজাগ দৃষ্টি রইল বসার ঘরের ভেতরে।
হ্যাঁ, আবার সে এসেছে। তবে আগের চেয়ে আরো বেশি সাবধানী। একটুও আওয়াজ না করে লুসিয়া ঘরের মাঝখানে চলে এল। জানলার পর্দার আড়াল থেকে পোয়ারো সব কিছু লক্ষ্য করলেন।
লুসিয়া ওই কাপটা তুলে নিল, একটু আগে তিনি যেটি সরিয়ে রেখেছিলেন। ওই কাপটা লুসিয়ার কোন কাজে লাগবে? পোয়ারো দেখলেন, পায়ে পায়ে লুসিয়া চলে এল একটা টুলের সামনে, যেখানে রয়েছে বড় ধাতুর একটা টব, তাতে ঘর সাজাবার বাহারি পাতার চারা গাছ পোঁতা। বাইরে বেরোবার দরজার কাছেই টবটা রাখা।
মাটিটা বেশ শক্ত হয়ে আছে, খুঁড়ে বেশ খানিকটা মাটি ওপর দিকে তুলে ফেলল, একটা ছোট গর্ত সৃষ্টি হল। এবার জল ঢেলে চারপাশের শক্ত মাটিকে নরম করল। হাতের কাপটা বসিয়ে দিল গর্তের মধ্যে, তার ওপর খোঁড়া মাটি ঢাকা দিল। হাত দিয়ে সমান করে দিল, কিছু বোঝার উপায় রইল না।
হাতে লেগে থাকা মাটি জলে ধুয়ে পাত্রটা সরিয়ে রাখল। সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে লুসিয়া বুঝি এবার নিশ্চিন্ত হল।
ঠিক এই সময় ওই ঘরে রিচার্ডকে ঢুকতে দেখা গেল, পেছনে এক সুদর্শন যুবক, হাতের ডাক্তারি ব্যাগই তার পরিচয় জানিয়ে দিল।
আচমকা লুসিয়াকে দেখে রিচার্ড ঘাবড়ে গেল–তুমি? এখানে কি কাজ?
দরকার ছিল, লুসিয়া হাসতে হাসতে বলল, ওপরে গিয়ে ব্যাগটা না পেয়ে ভাবলাম এঘরেই ফেলে রেখে গেছি, তাই আর কি! আরে ডঃ গ্রাহাম যে, ভাল আছেন তো? বাড়ির খবরও নিশ্চয়ই ভাল। দুঃখিত, আমাকে এক্ষুনি ওপরে যেতে হবে। আসি।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তড়িৎ গতিতে লুসিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রিচার্ড বোকার মতো স্ত্রীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল–সত্যি, তোমার মতিগতি বোঝা ভার, মনে মনে বলল রিচার্ড।
পোয়ারোর এবার প্রকাশিত হওয়ার পালা। তিনি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। মৃদু হেসে রিচার্ডের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
-আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, এনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, রিচার্ড বলল আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক, ডঃ কেনেথ গ্রাহাম।
ডাক্তার ভদ্রলোক মাথাটা সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে পোয়ারোকে অভিবাদন জানাল। এবার এগিয়ে গেলেন আর্মচেয়ারের কাছে, যেখানে মৃত স্যার ক্লড আধবসা অবস্থায় পড়ে আছেন। রিচার্ডও ডাক্তারের পাশে এসে দাঁড়াল।
পোয়ারো ওদিকে না গিয়ে ইচ্ছে করে তফাতে রইলেন। কফির কাপগুলো রাখা যে টেবিলে, তার সামনে চলে এলেন, কান তার সজাগ রইল, ওরা কি কথা বলাবলি করে, তা শুনতে হবে বৈকি।