তথ্যগুলি পড়ে পোয়ারোর মনে পড়ে গেল স্যার ক্লডকে–হ্যাঁ, এদেশের, এক নামজাদা পদার্থবিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরকারি কাগজ হঠাৎ লোপাট হয়ে যাবার ঘটনাটি মনে পড়ে গেল তাঁর। সরকারি গোয়েন্দারা ওইসব দলিলের খোঁজ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্যার ক্লডের সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। স্যার ক্লড সরাসরি কোন খবর দেননি, কেবল আভাস দিয়েছিলেন কোথায় পাওয়া যেতে পারে কাগজপত্রগুলি। তার দেওয়া সূত্রের পথ ধরে গোয়েন্দারা অবশ্য হারা নিধির সন্ধান পেয়েছিল। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ও দামী দলিলগুলো অন্য দেশের কাছে পাচার হয়ে গেলে এ দেশের সমূহ বিপদ। তাই এত তৎপরতা।
কদিন আগের দৈনিক টাইমস-এর কথা ভাবলেন তিনি। এক জায়গায় স্যার ক্লড অ্যামরি সম্বন্ধে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। সংক্ষেপে ঘটনাটি ছিল এইরকম–স্যার ক্লড অ্যামরি বর্তমানে যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন, তা ভবিষ্যতের যুদ্ধ-বিগ্রহের পক্ষে সাংঘাতিক কিছু একটা হবে। তবে স্যার ক্লডকে নিয়েই যত ঝামেলা। উপযুক্ত নিরাপত্তার অভাব। গ্রামের বাড়িতে ব্যক্তিগত গবেষণাগারে একমনে কাজ করে চলেছেন।
কিন্তু লোকটা বড্ড একরোখা বিড়বিড় করে বললেন পোয়ারো যুদ্ধবিগ্রহ-অস্ত্রশস্ত্র আমার বিষয় বহির্ভূত, তাহলে ……….. বইখানা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলেন, যদি স্যার ক্লড এখন……••••
ভাবনারা অটকে গেল টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছুরিটার দিকে। কাগজ কাটার ছুরি, তবে বেশ লম্বা। ছুরিটা তার জন্মদিনে পাওয়া উপহার। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পুরনো সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস দিয়েছিলেন। নিরাপত্তা সংক্রান্ত বহু সংখ্যক জিজ্ঞাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি পাঠানো মুখবন্ধ খাম নিত্য দিন পোয়ারোর টেবিলে এসে পড়ছে। ওই সরু, লম্বা ছুরি দিয়ে তিনি খামের মুখ কাটেন।
সকাল দশটা–গ্র্যান্ডফাদার ঘড়িটা সেকথাই বলছে। অর্থাৎ পোয়ারোর পেশাদারী কাজকর্ম শুরু হল। অবশ্য কাজের খাতিরে মাঝে মধ্যে নিয়মের হেরফের করতে হয়েছে। যেমন দ্য বিগ-ফোর’ নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র সম্পর্কে তদন্তের কারণে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু ও সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। অপরাধের তদন্ত ও তার মূলে আঘাত করাই ছিল তাদের যৌথ প্রয়াসের লক্ষ্য।
তারপর ক্যাপ্টেন ফিরে গেছেন আর্জেন্টাইনে। সেখানে তার খামার আছে। চাষবাস, পোষা পশু পাখি আর বউ-ছেলেমেয়ের নিয়ে দিব্যি আছেন। তবে খবরটা পোয়ারোর কাণে এসেছেকদিন আগে বন্ধু লন্ডনে এসেছেন। ফসল বেচতে তাকে এখানে আসতে হয়।
এসময় বেজে উঠল পুরনো মডেলের টেলিফোন। পোয়ারো রিসিভার তুলে নিলেন। কাণের কাছে রাখলেন। ওপাশ থেকে জর্জের গলা ভেসে এল–স্যার, ক্লড অ্যামরি আপনাকে চাইছেন।
-দশটা না বাজতে বাজতেই……নিজেকেই নিজে কথাটা শোনালেন। তারপর একটু চড়া আওয়াজে বললেন–জর্জ, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলছি, তুমি লাইনটা এঁকে দিয়ে নিজের কাছে যাও। দেখো, ডাকলেই যেন সাড়া পাই।
–হ্যালো, আমি এরকুল পোয়ারো। ধীর কণ্ঠে পোয়ারো বললেন আপনি?
–পোয়ারো। একটি রাশভারি গলা ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠল। আমি, আমি ক্লড অ্যামরি বলছি আপনার সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল আগে, ভুলে যাননি নিশ্চয়ই?
না, ভুলিনি। সেই সরকারি দলিল খুঁজে বের করার ব্যাপারটা তো। আপনি ছিলেন সেই সময়।
পোয়ারোর মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি।
-হ্যাঁ। শুনুন পোয়ারো, যেজন্য আপনাকে আমি যোগাযোগ করছি, স্যার ক্লডের কণ্ঠে উদ্বেগের আভাস–কঠিন এক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে আমার জীবনে। টেলিফোনের মাধ্যমে সবিস্তারে বলা সম্ভব নয়। আসলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমন এক বিষয় নিয়ে আমি কিছুদিন যাবত গবেষণা করছি। পৃথিবীর বিনাশ ঘটাতে প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমা ও মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে, এ যে পরমাণু ব্যবহার করা হয়, তা ধ্বংস করার অস্ত্র আবিষ্কার করাই আমার কাজ। এক ফর্মুলা বের করেছি। শুধু পরমাণু ধ্বংস নয়, এই ফমূলা মানবকল্যাণমূলক কাজেও অত্যন্ত কার্যকরী। তবে বলতে খারাপ লাগছে, আমার পরিবারের কোন একজন ওই ফর্মুলা চুরি করার মতলব করেছে। অন্য দেশকে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামাবে আর নিজের দেশের ধ্বংস ডেকে আনবে।
একটু থেমে স্যার ক্লড আমায় বলতে শুরু করলেন–মিঃ পোয়ারো, আপনি যদি আমার বাড়ি আরটস ক্লিভে একবার আসেন, তাহলে ভাল হয়। আপনার হাতে ওই ফর্মুলা আমি তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই। লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিভাগের কোন বড়কর্তার হাতে তুলে দেবেন। আপনার ওপর আমি ভরসা করতে পারি। আসুন উইক এন্ডে। আমার নিমন্ত্রণ রইল।
নিজের গুণাবলীর প্রশস্তি কে না শুনতে পছন্দ করে। পোয়ারোও এর ব্যতিক্রমী নন। ঘাড় ফেরালেন। আয়নায় তার মুখের প্রতিচ্ছবি চুলবিহীন মস্ত এক টাকওয়ালা মাথা, চকচকে চওড়া গোঁফ গর্বে তার বুক ফুলে উঠল। স্যার ক্লড অ্যামরি! যশস্বী বিজ্ঞানী, তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করা কি কম কথা! তার ওপর উপরি পাওনা ওই ফর্মুলা প্রতিরক্ষা দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া–এ কাজে দেশপ্রেমের ছোঁয়া আছে, রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
ঠিক আছে, স্যার ক্লড, আয়নার দিক থেকে ঘাড় ঘোরালেন, এই উইক এন্ডেই যাব। শনিবার বিকেল নাগাদ আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাব। রবিবার থেকে পরদিন সোমবার লন্ডনে ফিরে আসব। এই সময় আপনার জিনিসটা দিয়ে দেবেন। যাকে দিতে বলবেন, তাকেই দিয়ে দেব। আর কিছু?