–স্যার ক্লড। স্যার ক্লড! লুসিয়ার আর্ত চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল ডঃ, আমি আর পারছি না, অসহ্য, দয়া করে আলো জ্বালতে বলুন।
তখনও ঘর আলোহীন, জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ তখনও নিঃসীম অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসছে, ঠিক এই সময় দরজার বাইরে টোকার শব্দ। সে এক বীভৎস পরিস্থিতি। লুসিয়ার আর্ত চিৎকার আবার শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
দেখা গেল দরজার সামনে রিচার্ড দাঁড়িয়ে, দরজা খুলবে কিনা ভাবছে। মেঝেতে উল্টানো চেয়ার, পাশে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে এডওয়ার্ড রেনর। আর লুসিয়াকে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেল, কিন্তু চোখ-মুখের যা দশা, বুঝি এখুনি ভিরমি খাবে।
একইভাবে স্যার ক্লড বসে আছেন আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে, যেন পাষাণ মূর্তি, চোখের পাতা বন্ধ, উনি কি ঘুমিয়ে আছেন, না জেগে কেউ জানে না।
রেনর প্রথম মুখ খুলল–ওই তো, ওই তো সেই হারানো নিধি। তার কথা শুনে সকলের দৃষ্টি চলে গেল আমচেয়ারের পাশের টেবিলটার দিকে। স্যার ক্লড যে বড় খামটার কথা বলছিলেন, সেটি পড়ে আছে টেবিলের ওপর।
–ঈশ্বর দয়াময়! লুসিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, পাওয়া গেছে তা হলে!
আবার দরজায় টোকা, কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা, ধীরে ধীরে দরজার কপাট খুলে গেল। কয়েক জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি এখন দরজার কাছে এসে আটকে গেছে।
সকলে দেখল ট্রেডওয়েলকে, সঙ্গে একজন অচেনা অজানা লোক। আগন্তুক ঘরের ভেতরে ঢুকলেন, ট্রেডওয়েল ফিরে গেল নিজের কাজে।
পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা লোককে বেঁটে বলা যায় না, তবে ছোটখাট, মাথায় মস্ত এক টাক, এক ফালি মিলিটারি গোঁফ নাকের নীচে শোভা পাচ্ছে, যেন মুরগির ডিম। আভিজাত্যপূর্ণ পোশাক। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন,–সবমিলিয়ে এমন এক ব্যক্তিত্ব আছে মানুষটার মধ্যে, যার সামনে আপনিই মাথা অবনত হয়ে আসে।
ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন আমি এরকুল পোয়ারো, মাথা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকিয়ে বললেন–আপনাদের সেবা করার জন্যই আমার আগমন।
আর এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন হুঁশিয়ারি পদক্ষেপে, লম্বা চওড়া মিলিটারি মার্কা চেহারা, মধ্যবয়সী।
পোয়ারো চোখের ইশারায় তাকে দেখিয়ে বললেন–ইনি ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমার বন্ধু ও সহকারী।
রিচার্ড এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে দিল, দু’জনে হাত মেলালেন। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–আমি কি স্যার ক্লডের সঙ্গে কথা বলছি? পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুধরে নিলেন না, ঠিক বলিনি, যা বয়স আপনার, তাতে আপনাকে স্যার ক্লডের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে, কি ঠিক বলেছি?
রিচার্ড হেসে ঘাড় নেড়ে সায় দিল। পোয়ারো তার সঙ্গীকে নিয়ে চলে এলেন একেবারে ঘরের মধ্যখানে।
ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর সঙ্গে রিচার্ড হাত মেলাল। ক্যাপ্টেন মনে মনে বললেন–বাঃ, দারুণ সুন্দর সাজানো ঘর।
রিচার্ড এগিয়ে এল পোয়ারোর সামনে মাফ করবেন মশিয়ে পোয়ারো, রিচার্ড আমতা আমতা করে বলতে লাগল–বলতে খারাপ লাগছে, একটা ভুল বোঝাবুঝি আর কি, ওই কারণেই আপনাকে ডাকা হয়েছে। মিটে গেছে, আপনাকে আর দরকার নেই।
-তাই বুঝি। পোয়ারো জবাব দিলেন।
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। বলতে খারাপ লাগছে, সেই লন্ডন থেকে আপনাকে শুধু-শুধু ডেকে আনা হল। এসবের কোন মানে হয় না। যাক গিয়ে, আপনার প্রাপ্য পারিশ্রমিক, এমনকি আপনার এখানে আসা ও ফিরে যাওয়ার খরচও আপনি পেয়ে যাবেন। ভাববেন না।
-না, ভাবছি না। পোয়ারো নীরস কণ্ঠে বলতে থাকেন, আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমার পারিশ্রমিক বা যাতায়াত খরচ নিয়ে আমি একটু-ও চিন্তিত নই।
-তাহলে? তাহলে আপনি কী করতে চাইছেন, মশিয়ে পোয়ারো।
একই ভঙ্গিতে পোয়ারো জবাব দিলেন, মিঃ অ্যামরি, আমার বক্তব্য পরিষ্কার। যিনি আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, সেই স্যার ক্লড কোথায়। ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। উনি যদি না-চান, তাহলে চলে যাক।
-হ্যাঁ, তাইতো, বাবার মুখ থেকে না শুনে….. রিচার্ড আর্মচেয়ারের কাছে চলে এল, যেখানে স্যার ক্লড পাথরের মতো গা এলিয়ে বসে আছেন।
-বাবা, মশিয়ে পোয়ারো এসেছেন। রিচার্ড জোরালো গলায় ডাকতে লাগলেন। তোমার যে ওঁনাকে আর প্রয়োজন নেই, তা বলে দাও। উনি চলে যাবেন। বাবা, তোমার মুখ থেকেই কথাটা উনি শুনতে চাইছেন, না-হলে উনি লন্ডনে ফিরে যাবেন না বলছেন।
বাবার মধ্যে কোন ভাবান্তর না দেখে গলার পর্দা আর একটু বাড়িয়ে রিচার্ড ডেকে উঠল–কি হল বাবা, তুমি শুনতে পাচ্ছ না? চোখ খুলে তাকাও।
না, ছেলের ডাকাডাকিতে বাবার চোখ খুলল না।
রিচার্ড এবার ঘাবড়ে গেল। বাবা’ বাবা’ বলে সে স্যার ক্লডের বুকের বাঁদিকে নিজের কান রাখল। পরক্ষণেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। চিৎকার করে ডঃ কারোলিকে ডাকল–শিগগির এদিকে আসুন, ডঃ কারোলি।
ভাইপোর ভয়ার্ত চিৎকার শুনে ক্যারোলিন আতঙ্কিত হল, মুখ হল বিবরণ।
দ্রুত পায়ে ডঃ কারোলি ছুটে এলেন, স্যার ক্লডের হাতের শিরা টিপে ধরলেন, পরীক্ষা করলেন, সামান্য ঘাড় নাড়লেন, এবার স্যার ক্লডের হৃৎপিন্ডে কান পাতলেন। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। গম্ভীর মুখে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ডঃ কারোলি। পকেট থেকে ছোট্ট টর্চ বের করলেন, চোখের পাতা টেনে ধরলেন, টর্চের আলো ফেললেন। টর্চ নিভিয়ে দিলেন। ঘরের সকলের দিকে তাকালেন, নিরাশার ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন।